Skip to main content
-----
লোকটা প্রতিদিন ওর ছবিটার পাশে এসে দাঁড়ায়। ধূপের গন্ধ টের পায়। ফুলের রঙ চোখ ছোঁয়। শুধু ছুঁতে গেলেই মনে হয় - কেন যে তার শরীরটা নেই? মানে হাত পা আর কি! 
সেদিনও, মানে এই গেল রোববার বিকালবেলা একলা বসে বসে এই কথাটাই ভাবছিল। পশ্চিমের আকাশ এখনো লাল।
আচমকা শুনল, বল হরি, হরি বোল।
আরে ক্ষান্তাপিসী না? হ্যাঁ তো! কখন গেল? কেমন একটা মাথার মধ্যে বিদ্যুৎ খেলে গেল। হুট করে ক্ষান্তাপিসীর শরীরে ঢুকে গেল।
দেখতে দেখতে চোখের মধ্যে তারাভরা আকাশ ফুটে উঠল। মাথার দুলুনিতে একটু একটু গা পাক দিতে লাগল। না না, দুলুনিতে না, কি সব ফুলের আর ধূপের গন্ধ রে বাবা! ইস্!
হাত পা দড়ি দিয়ে বাঁধা। আচমকাই তার হঠাৎ লজ্জা লাগতে লাগল। এ মা! এ যে মেয়েমানুষের শরীর! এটা তো খেয়াল ছিল না। যা! আসলে অ্যাদ্দিন শরীর ছাড়া থাকতে থাকতে মেয়ে-পুরুষ হিসাবটা গুলিয়ে গিয়েছিল! 
"ও নবীন, নামা রে-", আরে! নিজের গলাটাই কেমন অচেনা লাগল! 
তবু যা হোক। কদ্দিন পর কথা বলে বেশ সুখ লাগল কিন্তু।
ওদিকে নীচে হুদ্দুড় পড়ে গেছে। সন্ধ্যে হয়ে গিয়েছিল। ওরা আচমকাই ক্ষান্তা ঠাকুমার গলা শুনে ভেবলে গিয়ে খাট দিল মাটিতে ফেলে। যা হোক জায়গাটা একটু কাদা কাদা ছিল যে বুড়ো হাড়গুলো ভাঙল না। তবু যা জোর লাগল! ক্ষান্তা, মানে আমাদের বিশু "উফ্" করে উঠল।
 
দাঁড়াও আগে খানিক পুরোনো কাসুন্দি ঘেঁটে নিই। এই বিশু হল ভ্যানচালক। ওর বউ কুলকুচো ও বেনেপাড়ার মুদি পাকড়াশির ছেলের সাথে ইন্টুপিন্টু ছিল। তো একরাতে বিশুকে বিষ খাইয়ে ওরা কাজ সেরে নেয়। বিশুর বয়েস তখন কত হবে? আঠাশ। ওই পাকড়াশির ছেলের বয়েস হবে পঁচিশ। আর কুলকুচোর বয়েস ধরো আঠারো। কি বজ্জাৎ মেয়েমানুষ গো!
তো সে মরা ইস্তক বিশুর মনে শান্তি নেই। ওরা পরের বছরেই বিয়ে করল। এই গ্রামে সবাই সব জানে, তবু কেউ মুখে রা-টা কাড়ল না! বিশুর ভৌতিক শরীরে কামজ্বালা জ্বলে যেত রোজ ওই হতচ্ছাড়া মাগীটার সোহাগ দেখলে ওই পাঁচুটার সাথে। শালা নিকম্মার ঢেকি! বাপের পয়সায় গিলছে আর তার বউকে.... যা হোক। মুখ দিয়ে খারাপ কথা বার করে না বিশু।
তারপর বিশুর সাথে একদিন হরিমোতোর দেখা। সে গলায় দড়ি দিয়েছিল বছর পাঁচেক আগে। তারটা অন্য কেস। বিয়ে হচ্ছিল না। আর যদিও বা বিয়ে হল, বউ পাগলী। সেই শোকে সে মরেছিল। সেই হরিমোতো বলেছিল, ভাই অসময়ে এই জগতে এসে পড়েছিস যখন গুরু ধর। তরে যাবি। এ তরা অবশ্যি মানুষদের মত তরা না, সেটা সে গুরু ঘামাচিনন্দর কাছে গিয়ে বুঝেছিল তারকেশ্বরে। তিনি একটা বাঁশঝাড়ে একা থাকেন। অনেক কলাকৌশল জানেন। মানে সিদ্ধাই আর কি। তার কাছে বহু দেশ-বিদেশের ভুতপেত্নী আসে। দু'মাস আগে থেকে নাম লেখাতে হয়। বিদেশি হলে চার্জ বেশি। এখানেও একটা অর্থনীতি আছে। সে বড় জটিল। সে গল্প অন্যদিন বলব। তা যেহেতু হরিমোতো ঘামাচিবাবার একটু বেশি কাছের লোক তাই বিশু তাড়াতাড়ি লাইন পেলো।
 
----
বাবার কাছে বিভিন্ন কোর্স আছে। তার মধ্যে যে কোর্সটায় বিশুর মন আটকালো সেটা হল - পুনরাবির্ভাব কোর্স। অন্যের শরীরে ঢুকে মাস তিনেক থাকার কৌশল। বেশিদিন সম্ভব না। কারণ, বেশিদিন হলে আবার স্বর্গে নাকি ডেটা মিসম্যাচ হওয়ার চান্স থাকে।
যা হোক, বিশু ভালই আয়ত্ত করল কোর্সটা। কিন্তু এমনই দুর্ভাগ্য, সেরকম কেউ মরলই না! তাই এই ঝোঁকের মাথায় কি ভুলটাই না করে বসল সে! ইস্, এখন পস্তাচ্ছে ক্ষান্তা, মানে বিশু। 
সে নিজেই দড়িটড়ি খুলে সামনেই পুকুর দেখে শাড়ি খুলে নেমে পড়তে গেল। চারদিকে হইহই শব্দে বুঝল, এই যা! এটা তো হবে না, তার নিজের বুকের দিকে তাকাতেই আঁতকে উঠল, লজ্জাও পেল এক ঘটি। তাড়াতাড়ি শাড়ি জড়িয়ে নিল। ওদিকে যারা তার সৎকার করবে বলে নিয়ে যাচ্ছিল তারা কোনোরকমে ভয় কাটিয়ে সামনে দাঁড়িয়ে ব্যাপারটা বুঝতে চেষ্টা করল, বলি ও ঠাকুমা তুমি মরো নাই? 
ক্ষান্তা মানে বিশু বলল, না রে আপদ!
তারা অমনি বেজায় চোটে গেল মুকুন্দ ডাক্তারের ওপর। শালা আজ এত ভাল একটা ম্যাচ আছে ভারত পাকিস্তানের, দিল পেছন মেরে। মানুষ মরে গেছে কিনাও বুঝতে পারে না? হ্যাঁ রে তোরা না মড়া কেটেই ডাক্তারিটা পড়লি! 
মুকুন্দ ডাক্তার বেচারা বেশ ক'টা মার খেয়েছিল। বিশু বা ক্ষান্তার খুব মনে লেগেছিল যদিও, আহা রে, তারই জন্য তার এমন দুর্দশা হল। 
কিন্তু সে এবার কি করবে? তিন মাসের আগে তো এ শরীর ছেড়ে বেরোতেও পারবে না। 
একটা বিড়ি খাওয়ার ইচ্ছা হল। সে শ্মশানের পাশেই বসেছিল। কে একটা বিড়ি ফেলে গিয়েছিল, সেটাই টানতে টানতে ইয়ে করতে যাবে, ওহ, এখানেও তো ক্যাঁচাল। দাঁড়িয়ে তো আবার করা যাবে না! সে বসল অগত্যা। তার এবার কান্না পেতে লাগল! ও গুরু!
 
----
ছেলেগুলো ফিরে গেছে। ক্ষান্তা ওরফে বিশু শ্মশানেই বসে রইল। চাঁদ মধ্যগগনে। কটা হবে এখন? এই দুটো আড়াইটে হবে। আকাশ ভরতি তারা দেখতে দেখতে সে মাটিতেই শুয়ে পড়ল। এখনো শাড়ির থেকে আতরের গন্ধ আসছে। কে দিল? ক্ষান্তার তিন কূলে কেউ নেই বলেই জানে বিশু। সেই কবে বিয়ে হয়ে এ গ্রামে এসেছিল। বরটা মরেছিল সাপে কেটে। কোনো বাচ্চাকাচ্চা হয়নি। এই এটা সেটা করে, কিছু দূরে বসাকপুর, সেখানে কোনো একটা বাড়িতে নাকি ঝি-এর কাজ করত।
বুকটা ভারী হয়ে আসল বিশুর। এই মেয়েমানুষের শরীরে থাকাটা কেমন যেন একটা লাগছে। তার ছেলেবেলার বন্ধু নিত্য যাত্রায় মেয়েছেলে সাজত। অবশ্য ওর চালচলনও ছিল অনেকটা মেয়েদের মতই। সে রকম দেখাচ্ছে কি বিশুকে? বিশু দেখল আশেপাশে কেউ নেই। শাড়িটা সরিয়ে ধীরে ধীরে নিজের শরীরটা দেখল। ততটাও বয়সের ছাপ নেই যেন শরীরে। ক্ষান্তার শরীরে কি নবযৌবন এলো? বিশুর যৌবনের তেজে এরকমটা হল? বিশু নিজেই নিজের বুকটা ধরল, নীচে হাত দিয়ে দেখল। তার সারা শরীর দিয়ে একটা হিমস্রোত বয়ে গেল। একি গ্যাঁড়াকল ঠাকুর! যা চাইছে তা তো করার ক্ষমতা রইল না!
যখন ঘুম ভাঙল সূর্য অনেকটা উঠে এসেছে আকাশ বেয়ে। এদিকটা খুব শুনশান। বিশু উঠে পুকুরে মুখ-হাত-পা ধুয়ে শাড়িটা পরে এগোতে লাগল গ্রামের দিকে। শাড়িটা পরতে গিয়ে বুকে একটা খোঁচ লাগল। সে কুলকুচোকে আদর করা হয়ে গেলে নিজে শাড়ি পরিয়ে দিত। হারামজাদি মাগী! নাহ্ সক্কাল সক্কাল খিস্তি করবে না। কিন্তু পা আর চলতে চায় না। তার লজ্জায় সব কেমন আড়ষ্ঠ হয়ে আসছে। কি করে যাবে গ্রামে? যা হোক তবু যেতে তো হবেই। আর তাকে চিনবেই বা কে?
 
---
গ্রামের কাছে আসতেই চারদিকে হইহই পড়ে গেল। পাড়ার কুসুমদি, মনোহরদা, পাঁচকড়িদা, বুবেক, পরেশ সব "ও পিসি", "ও দিদি", "ও ঠাকুমা" করে ছুটে এল! দুলালের বউ এমনিতেই ছিঁচকাঁদুনে, সে হাউমাউ করে কেঁদে তাকে জড়িয়ে ধরল - কি ভাগ্য গো দিদি, সাক্ষাৎ যমের দুয়ার থেকে ফিরে এলে। মুকুন্দ ডাক্তারও ফোলা মুখ নিয়ে তাকে পরীক্ষা করতে এগিয়ে এল। 
বিশুর খুব অস্বস্তি লাগছে এবার। নিজেকে কেমন সত্যিই ক্ষান্তাপিসীই লাগতে শুরু করছে মাঝে মাঝে। যা হোক, সে ভুল করে নিজের বাড়ি যেতে গিয়ে আবার সামলে ক্ষান্তাপিসীর বাড়ি চলে এল।
কেউ কেউ বলল, ও পিসী তোমার হাঁটা, কথা বলার কায়দা তো পুরো বদলে গেছে গো?! হ্যাঁ গো, রাত্তিরে ব্রহ্মদৈত্য ভর করেছিল নাকি শ্মশানে? সব "হো হো" করে হেসে উঠল। আচমকাই বিশুও "হো হো" করে হেসে উঠল। সে হাসির দমক শুনে বাচ্চা বুড়ো বউ চমকে গিয়ে হিক্কা তুলতে তুলতে বাড়ি ফিরে গেল।
বিশু ঘরে ঢুকতেই, মানদা মাসি এলো। ঢুকেই তার গলা জড়িয়ে সে কি কান্না। মানদা মাসি ক্ষান্তাপিসীর বয়েসীই প্রায়। বিধবা। দুই ছেলে, ছেলের বউ, নাতি-নাতনী নিয়ে ভরা সংসার।
কান্না থামিয়ে চৌকিতে বসল মানদা মাসি। চারদিক দেখে, ধীর গলায় বলল, "তুই মরেছিস শুনে, সে মিনসে এসেছিল। সে কি কান্না তোর ঘরে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে। আমি তো ঢঙ দেখে আর বাঁচি না সই।"
বিশু তো কিছুই বুঝতে পারছে না। তবে নিষিদ্ধ কিছুর গন্ধ একটা টের পাচ্ছে। সে হাঁ করে তাকিয়ে রইল মানদার দিকে।
মানদা বলল, "আ মোলো, অমন রসবড়ার মত চোখ করে চেয়ে আছিস কেন? বুঝতে পারছিস না? নাকি ন্যাকা সাজছিস মাগী, এই বুড়োবয়সে এসব আর ভাল্লাগেনা বলে দিলুম কিন্তু।"
বিশু বলল, "না মানে-", তার কথা বলতে আটকাচ্ছে। হাজার হোক মাসি-পিসীর ব্যক্তিগত কথা। সে যে কি করে!
"আরে কিছু একটা গড়বড় হয়েছে আমি তোর চালচলন দেখেই বুঝেছি। যা হোক তুই ক'টা দিন ঘুমা। মরার একটা ধকল আছে না! সব মনে পড়ে যাবে! তবে কি বলিস, বসাকপুরের নাগররে একটা খবর দিই?" বলে মানদা চোখ টিপল! 
বিশু যথারীতি ভ্যাবলা হয়ে চেয়ে রইল।
মানদা, "আর মর মাগী...", বলে উঠে যেতে যেতে বলে গেল, "ক'দিন উনুনের কাছে যাবি না কিন্তু। বউমারা কেউ না কেউ এসে খাবার দিয়ে যাবে। বুঝলি?"
বিশু মাথা নাড়ল। এ তো ভাল দঁ'কে পড়া গেল? কে ক্ষান্তাপিসীর নাগর? যে বাড়িতে পিসী কাজ করত সে বাড়ি? কিন্তু সে বাড়িতে তো শুনেছে একটা বুড়ো আর তার তিন ছেলে, বউমা আর বাচ্চারা থাকে? সেই বুড়ো কি তবে? সব্বনাশ!
 
--- 
 এবার আসল কাজটা সারতে হবে।
প্রতিশোধ নিতে হবে। বিশু দু'দিন ঘর থেকে বেরোল না। দু'দিন পর তাকে নিয়ে কৌতুহলটা খানিক কমল। সে একদিন সকালবেলা বেরোল বেনেপাড়ার দিকে। কুলকুচোর নতুন শ্বশুরবাড়ি।
পাকড়াশি দোকানেই ছিল। পাঁচুর বাবা, হারাধন পাকড়াশি। তাকে দেখেই মিষ্টি হেসে বলল, "এসো ক্ষান্তা। এ যে এক্কেবারে স্বগ্গ দশ্শন করে এলে। কি বলো?"
বিশুর পা থেকে মাথা পর্য্যন্ত জ্বলে গেল। সে বলল, "হুম।" একটা কাষ্ঠহাসি হেসে বলল, "কুলকুচো নেই?"
হারাধন তাকে নিজের ঘরে নিয়ে গিয়ে বসালো। বলল, "কুচো ওই শিবমন্দিরে গেছে, সে পোয়াতি বুঝলে কি না, এই চারমাস হল। ওর শাশুড়ির মা-এর সাথেই গেছে।"
বলতে বলতে হারাধন, তার পাশে এসে বসল খাটে। "মেয়েটা যে কি ভাল কি বলব তোমায় ক্ষান্তু। শালা ওই বিশুটা ওর যুগ্যি ছিল না। তবু এখনো রোজ ওই ওর ছবিতে মালা দেয়, ফুল দেয়, ধূপ দেয়।"
বিশু কিছু শুনছে না। তার কানে একটাই কথা বাজছে, কুলকুচো পোয়াতি! তার সারা শরীর অবশ হয়ে গেছে। কি একটা ঘোরের মধ্যে সে যেন ডুবে গেছে। আচমকাই খেয়াল করল, তার বুকে একটা চাপ। চমকে উঠল। হারাধনের হাত। সে ছিটকে এসে বলল, কি করছেন কাকু!
হারাধন থতমত খেয়ে বলল, কাকু! বলি মাথাটা কি গেছে ক্ষান্তা? আমি কি তোর পর? আমি কি সোহাগ করিনি তোকে আগে? তোর বরটারে মা মনসা ডেকে নেওয়ার পর সব প্রয়োজন কি আমি মেটাই নি তোর? তুই বেশ্যামাগী, ওই বসাকপুরের চ্যাটুজ্জের সাথে আবার নষ্টামি করতে গেলি!
হারাধন চাপা গলায় গজরাতে লাগল। বিশুর সারা শরীর কাঁপছে থরথর করে।
হারাধন তাকে টেনে আবার বিছানায় নিয়ে গেল, বুকটা চেপে বলল, আবার কি করে এমন বানালি রে ক্ষান্তু?
তাকে এক ঝটকায় ঠেলে ফেলে হুদ্দুড় করে বেরোতে গিয়ে দরজায় মুখোমুখি হয়ে গেল কুলকুচোর সাথে। কুলকুচোর পেটে চোখ পড়তেই তার মাথাটা থম্ ধরে গেল। সে কি বলবে বুঝতে না পেরে, তার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকল। কি সুন্দর দেখাচ্ছে কুলকুচোকে! তার বুকের ভেতরটা নরম হয়ে আসছে। চোখের কোলটা ভিজে আসছে।
হঠাৎ পাকড়াশির বউ-এর স্পর্শে তার ঘোর ভাঙল, "ওমা দিদি! আমাদের কি সৌভাগ্য গো! যা শুনলাম। আমি যেতাম দিদি, তবে বুঝতেই পারছেন একার সংসার। তার ওপর আপনাদের বউমা এই চারমাস হল। সবই আপনাদের আশীর্বাদ দিদি। আসুন আসুন ঘরে আসুন।"
একরকম জোর করেই পাকড়াশির গিন্নী তাকে ঘরে নিয়ে গেল। আবার সেই ঘর। পাকড়াশিকে দেখতে পেল না বিশু। একটু পর বাইরে থেকে গলা খাঁকারি দিয়ে পাকড়াশি বলল, শুনছো আমি একটু সদরে যাচ্ছি, মাকু (কর্মচারী) রইল দোকানে। তুমি একটু খেয়াল রেখো।
পাকড়াশির বউ, "ও মা সেকি গো এখন সদরে?" বলে বেরিয়ে গেল। 
ঘরে সে আর কুলকুচো।
 
বিশুর বুকটা ধড়াস ধড়াস করছে। একবার মনে হল, তার কুলুকে একটু জড়িয়ে ধরে। তারপর মনে হল, তার কুলু আর কই। 
"অমনভাবে কি দেখছ পিসী?"
"হ্যাঁ রে তোর বিশুর কথা মনে পড়ে?"
"না পিসী। ওকে আমার কোনোদিন মনে ধরে নাই। ওরে দেখলেই আমার গা গুলাতো। আসলে তুমি তো জানো আমার এই বাড়িতে সেই ছোট্ট বয়েস থেকে যাতায়াত। তা আমরা গরীব বলে আমার এখনকার শ্বশুরমশায়ের অমত ছিল। আর ও মানে তোমার এখনকার জামাইও তখন কেমন উড়ুউড়ু ছিল।
তারপর যেই না বিশুর সাথে বিয়ে হল, এনার পাগল পাগল দশা। তখন ওর বাবা আর ও মিলে আমার বাড়ি একদিন রাত্তিরে এসে আমায় বিষ দিয়ে গেল, বললে ওকে খাইয়ে দিস। আর মুক্ত হয়ে আমার বাড়ি চলে আয় মা। 
তুমি তো জানো পিসী। কেন যে এসব কথা মনে করাও। সেদিন তুমি না আমার পাশে থাকলে আমি একা গুলতে পারতাম ও বিষ! উফ্, এখনও ভাবলে আমার গা হাত পা শিউরে ওঠে! 
ওর মুখ দিয়ে গাঁজলা গাঁজলা বেরুতে লাগল, তুমি ওর মুখে বালিশ চেপে ধরলে। তুমি বলেছিলে তোমার নাকি পুরুষ জাতটার ওপর অনেদিনের আক্রোশ। তোমার শরীটাকে কতজন পুরুষ শিয়াল কুকুরের মত ছিঁড়ে খেয়েছে অবস্থার সুযোগ নিয়ে। না হলে তুমি এই গ্রামে স্বামীর ভিটেতে টিকতেই পারতে না। সব মনে আছে গো পিসি। আমার শ্বশুরমশাইয়ের চরিত্রও ঠিক না গো, ঠিকই বলেছিলে তুমি। আমি স্নান করতে গেলেও আড়াল থেকে দেখে। উফ্। 
তুমি মরেছ জেনে ভাবলাম যাক, তুমি মুক্তি পেলে। আবার কেন ফিরলে পিসী?"
 
----
এই ঘটনার তিনদিন পর ক্ষান্তা ওরফে বিশুর মৃতদেহ পাওয়া গেল ঘর থেকে। এক বাটি পায়েস পাশে শুকিয়ে। ডাক্তারের বলল, বিষ খেয়েছে।
 
ঘটনাটা সত্যিই। সেদিন বিশু একবাটি পায়েসে বিষ মিশিয়ে পাকড়াশিদের বাড়ি গিয়েছিল। উদ্দেশ্য ছিল কুলকুচো আর পাঁচুকে খাওয়ানো।
খাওয়ায় নি। সব শোনার পর তার মাথাটায় কেমন ভোঁ ধরে যায়। ফিরে এসে আর বাঁচতে ইচ্ছা করে না। ক্ষান্তা হয়েও না, বিশু হয়েও না। সে বুঝেছিল, যে ভালোবাসাটা সে কুলোকুচোকে বেসেছিল, কুলো কোনোদিন সেরকম তাকে ভালোবাসেনি। ভাবতে ভাবতে বিশু একটা ভালোবাসার দর্শন আবিষ্কার করে ফেলেছিল প্রায়। সে মনে মনে বলল," দ্যাখ কুলো, আমি তোকে ভালোবেসেছিলাম, টাকা ধার তো দিই নি, যে তুই তা শুধলি না কেন বলে হাত-পা-ছড়িয়ে কাঁদব, তুই তোর মত থাক। আমি এখানেই থাকলাম। আমার মত।" কথাগুলো মনে মনে বলেও বিশুর কোথাও একটা হালকা লাগল নিজেকে। তার মনে হল, ভালোবাসাটা অনেকটা রুমালচোর খেলার মত। কারোর কাছেই বেশিদিন থাকে না। কেউই ধরে রাখতে পারে না চিরটাকাল। সেটা যেন অন্য কারোর দিকে গড়িয়ে যায় ই যায়।
এখন বিশু শ্মশানেই থাকে। উদাস থাকে। সদ্য কেউ মরলে তার সাথে গল্প করে। তারপর যেই কে সেই। সে ঠিক করেছে কুলু মারা যাবার পরেই প্রেতদশা ছাড়ার আর্জি জানাবে। কুলুকে সে একা ফেলে যায় কি করে? যতই কুলু তাকে না চাক, সে তো চায়!