Skip to main content


সক্কালবেলা জেঠিমা দেখি মুখে সার্জিক্যাল মাস্ক পরে পুজো দিচ্ছেন।
       ভেবে দেখলাম ঠিকই করেছেন। এত বাড়ি, মন্দির, গাছতলা, দোকান, সকালবেলা উনি পুজো নিতে যান.... বলা যায় না...মানুষের শরীরই যদি এমন ধারা সংক্রমণযোগ্য, তবে দেবতনুর সংক্রমণ কদ্দূর পৌঁছাবে কে জানে?
       বিশ্বাস হচ্ছে না তো? একটা গপ্পো শুনুন। চৈতন্যচরিতামৃতে আছে। তখন মহাপ্রভুর অন্তলীলা। মানে জীবনের শেষের দিক। প্রায় উন্মাদ দশায় পৌঁছেছেন। ঘরে ধরে রাখা যায় না। তাই ওনাকে প্রায়ই আটকে রাখতে হয়, রীতিমতো পাহারা দিতে হয়। ভাব তখন তুঙ্গে। প্রায়ই জ্ঞান হারান। আরে ভাই সেকি আর দেহচৈতন্য? সে হল মহাভাবচৈতন্য। তা বিচিত্র আর কি, ইদানীংকালে যদি নায়ক, নেতা মারা গেলে তাদের ভক্তকূল আত্মহত্যা করে বসে আবেগের গুঁতোয়, তবে সে তো দিব্যোন্মাদ দশা।
       তো হল কি, একদিন মহাপ্রভু কি করে, কি করে যেন বাইরে বেরিয়ে গেছেন। খানিকপর টের পেয়েছেন ওনার সঙ্গীসাথিরা। আরে কই গেল, কই গেল? খোঁজ, খোঁজ।
       তখন মধ্যরাত। পূর্ণিমা। কল্পনা করুন, পুরীর সমুদ্রতট কি অপূর্ব লাগে দেখতে পূর্ণিমায়। এখন অবিশ্যি ছানার জিলিপি, মুক্তার হার, ঘোড়া উটের দাপটে সমুদ্রের গর্জন ছাপিয়ে যায় থেকে থেকে... ছেনাপোড়া.... ছেনাপোড়া.... দিব নাকি বাবু.....
       আবার কি কথায় চলে গেলাম। সে যাক। তো পূর্ণিমার সমুদ্রতীর, প্রায় পাঁচশো বছর আগের কথা ভাবুন। কি মনোরম নির্জনতা। সেই সমুদ্রের গর্জন। পুরীর তটে সঙ্গীসাথিরা খুঁজছেন মহাপ্রভুকে। গেল নাকি সমুদ্রে ডুবে? এই এক চিন্তা। হঠাৎ শোনা গেল, কেউ খুব মগ্ন হয়ে ঘন আবেগে, প্রায় কাঁদো কাঁদো হয়ে, হা গোবিন্দ, হা গোবিন্দ গাইছে....কে? কে? এ তো মহাপ্রভুর গলা নয়? কিন্তু এ কে?
       একটু এগিয়ে দেখা গেল, এক মধ্যবয়েসী ধীবর বসে আছে বালির উপর। তার কালো ভেজা শরীরের উপর জ্যোৎস্নার আলো পড়ে চকচক করছে, সাথে গায়ে লেগে থাকা বালিগুলো দেখে মনে হচ্ছে যেন মুক্তো।
       একজন গিয়ে জিজ্ঞাসা করল, কি হয়েছে তোমার? এমন করছ কেন?
       সে বলল, আর বলবেন না। আমরা যারা মাছ ধরতে সারারাত সমুদ্রে থাকি তাদের নানা অপদেবতার ভয় থাকে। আমাদের পূর্বপুরুষেরা বলেন, যেই না ভয় করবে অমনি গোবিন্দ বা কৃষ্ণ নাম করতে।
       তো হল কি, আজ যেই না জলে নৌকা নিয়ে নেমেছি, হঠাৎ জালে লাগল একটা প্রকাণ্ড টান। আমি টান দিয়ে একা তুলতে পারি না। শেষে আমরা কয়কেজন মিলে টেনে দেখি এক অদ্ভুত শরীর মানুষ। জ্যোৎস্না ধোয়া তার গায়ের রঙ। কি লম্বা লম্বা হাত গো। আমরা প্রথমে ভেবেছিলাম মানুষ, কিন্তু দেহ দেখে বোধ হল, না তো গো, এই শরীর তো মানুষের হয় না, এ নিশ্চয় কোনো অপদেবতা, আমাদের সাথে ছল করে আমাদের বিপদ আনবে।
       আমাদের ছেলেপুলে নিয়ে পরিবার। আমি ভয় পেয়ে তাড়াতাড়ি নাম করতে শুরু করলাম ঈশ্বরের। কি বলব গো আপনাদের, অন্যদিন হলে নাম করতে করতেই ভয় ছেড়ে যায় শরীর মন থেকে। কিন্তু এইবেলা হল তার উল্টো। যত নাম করি তত গায়ে কাঁপুনি দিয়ে দেহ অবশ করে ফেলে। আমি জাল ছাড়িয়ে সেই অপদেবতাকে মুক্তি দিতে গিয়েছিলাম, তাই আমার সাথে অনেকবার ছোঁয়াছুঁয়ি হল, তা আর বলি কি গো আপনাদের, যতবার ছুঁই হাতে কাঁটার মত বেঁধে, শরীর অবশ হয়ে যায়, আর নামের বন্যায় যেন পাঁজরগুলো অবধি ভেঙে ভেঙে যায়। আমার অবস্থা দেখে আমার সঙ্গীসাথিরা তো পালালো। আমি আর যেতেই পারছি না। আমার যেন কি সুখ! আমার যেন কি দুঃখ! আমি যেন থামতে পারছি না।
       ব্যস, সঙ্গীসাথিদের আর বুঝতে বাকি রইল না সেই অপদেবতাটি কে? তারা সেই জেলের ইঙ্গিত অনুযায়ী একটু এগিয়ে দেখে, হুম, ঠিক, ওই তো সমুদ্রতটের উপর সেই জ্যোৎস্নাধোয়া দেবতনু, জ্যোৎস্নাস্নাত হয়েই শুয়ে আছেন।
       তো এই হল গপ্পো, যেমন সঙ্গ তেমন গুণ। তাই ফুলের বাজারে ঝুলের গায়েও ফুলের গন্ধ, আর মাছের বাজারে ঘাসের গায়েও আঁশটে গন্ধ।