ফাঁকা মন্দির। বেশ বড় মন্দির। বিগ্রহ - শ্রীকৃষ্ণ ও রাধার। সন্ধ্যা হয়েছে ঘন্টাখানেক হল। শীতের সন্ধ্যা তাড়াতাড়ি হয়।
প্রণাম করে উঠতেই খেয়াল করলাম একজন বৃদ্ধা পূজার আয়োজন করছেন মন্দিরের এক কোণের দিকে বসে। সাদা শাড়ি। মাফলার জড়ানো মাথা। দেহটা একটু সামনের দিকে ঝোঁকা।
বললাম, দরজাটা একটু খুলবেন, একটা ছবি তুলব। আমার আর আমার আরো দু'জন বন্ধুরই মুর্তিটা খুব ভাল লেগেছিল।
ভদ্রমহিলা উঠে গর্ভমন্দিরের দরজা খুলে দিলেন। আমাদের মুখের দিকে তাকিয়ে একগাল হাসলেন। যেন কত চেনা।
তারপর পাশের একটা দরজা দিয়ে এসে মন্দিরের বারান্দায় দাঁড়িয়ে বললেন, কোত্থেকে আসছেন?
আমরা উত্তর দেওয়ার পর বললেন, তা মন্দিরের উৎসবে এসেছিলেন?
বললাম, না।
খেয়াল করছিলাম ওনার কথাবার্তার মধ্যে গ্রাম্য উচ্চারণের প্রভাব খুব একটা নেই। আচরণটাও ঠিক মন্দিরের এরকম ধরণের মানুষের থেকে কোথাও একটু স্বতন্ত্র।
জিজ্ঞাসা করলাম, এখানেই থাকেন?
বললেন, হ্যাঁ। তা প্রায় পঁচিশ বছর হল। বললাম, তার আগে? বললেন, বর্ধমানের একটা মন্দিরে।
আমি বললাম, ছোট বেলা থেকেই?
হাসলেন। বললেন, না গো। আমার বিয়ে হয়েছিল। ছেলেমেয়ে ছিল।
থামলেন। আমি বুঝলাম অন্ধকার ঝাঁপিতে হাত দিয়ে ফেলেছি অলক্ষ্যে। বেশ করেছি। মানুষের কথা শুনতেই তো এসেছি। শুধু উপরের ক'টা কথায় মানুষের কাছে আসা যায়! তার হাসির পিছনে অনেক দীর্ঘশ্বাস, কান্না। সে ছুঁতে না পারলে মানুষটাই যে অধরা! আর মানুষই যদি রইল অধরা তবে হৃদিবৃন্দাবন শুধুই কল্পনা।
ওই শোনো। ঝাঁপি খুলছে।
আমার জন্ম হয়েছিল বাংলাদেশে। দেশভাগের সময় বাবার সাথে আসলাম এদেশে। রাণাঘাটের চূর্ণি নদীর ধারে ঝুপড়ি। বড় হতে লাগলাম। ধুম করে বিয়ে হয়ে গেল। স্বামীর ঘরে আসলাম। গঙ্গার পাড়ে নতুন ঘর, স্বামীর ঘর। ত্রিবেণীর ওদিকে।
থামলেন। মনে ভাবছি এর পরের অংশটা সুখকর হবে না জানি। তবু শুনতে হবে। না তো কে শুনবে? ওই কাঠের মূর্তির সাথে কথা বলা যায়? জানি না। মন ভরে ওকে সব বলে?
বললাম, তারপর?
ছেলে হল। নয় বছর বয়েস থেকে কি মারণ রোগ ধরল বুঝলাম না। এখেন ওখেন দৌড়াদৌড়ি করে। সব শেষ!
চোখের কোল ভিজল। এখন আমার সামনে যে, সে চন্দন বাটা, মালা গাঁথা বৈষ্ণবী না। সে ছেলে মরা মা। চাপা মানুষের কথা এটা।
খানিক পর বললেন, তার কয়েক বছর পর মেয়েটা গেল।
কেন মারা গেল জিজ্ঞাসা করলাম না। গরীবের মরতে অত কারণ লাগে না এদেশে। শান্ত, নিস্পৃহ মুখটার আড়ালে একটা একটা করে আড়াল সরছে। আমি ভাবছি, এবার থামতে বলব? বলব তাড়া আছে? না বলার তাগিদ ওনারও কম কি? শোকের তো আর মানিব্যাগ হয় না! যে তাকে চাপা দেওয়া যায় বা কেনা যায় বা ভুলিয়ে দেওয়া যায়। সে হালকা হয় বেরিয়ে এসেই, আরেকজন মানুষের কাছেই। আরো আছে শোনো।
স্বামী গেল স্ট্রোকে, হঠাৎ-ই। আমার জমিটা ভেঙে পড়ল জলের তলায়। গঙ্গার পাড় ভাঙা শুনেছেন?
না শুনিনি। কিন্তু শব্দ পাচ্ছি। গঙ্গার তীরে না। আমার ভিতরে। দেখতে পাচ্ছি ওনার চোখের মণিতে। আমি অন্যদিকে তাকালাম। টিউবলাইটের আলোগুলোর পাশে পোকা, একটা টিকটিকি। মাঝে মাঝে এই দৃশ্যগুলো খুব মন দিয়ে দেখতে হয়। বুকের চাপটা কমে।
তাকালাম ওনার মুখের দিকে। উনি হাসলেন। কতটা হারালে এতটা উদাসীন হাসি হাসা যায়?
নিজের আঁচলের খুঁটটা হাতে নিয়ে বললেন, সেই রাতে আমি এক কাপড়ে আজও বেরোলাম, কালও বেরোলাম।
এ ভাষা জোগালো কে? আজও বেরোলাম... কালও বেরোলাম! সেদিন থেকে বেরোনোটাই সত্যি ওনার জীবনে। আজ পর্যন্ত কোথাও আর প্রবেশের ইচ্ছা হল না। কারোর সংসারে না। বাইরে এসে দাঁড়িয়েছেন। সব সংসারের বাইরে। বিচার? কে করবে! নালিশ? কাকে জানাবেন! কার বিরুদ্ধে নালিশ?
আমি তাকিয়ে রাস্তার দিকে। দূরে চায়ের দোকানে চলছে আড্ডা। অনেক জায়গায় বর্ষশেষের উত্তেজনাবহুল মাইকের উত্তাল গান। সব এক নিমেষে অন্য জগতের হয়ে দাঁড়াল। আমি আর উনি দাঁড়িয়ে সময়ের একদিকে, অন্যদিকে ওরা।
বললাম, আত্মীয়েরা?
ছিল না তেমন কেউ। বাবা-মা'ও নেই তদ্দিনে। সব জমিজায়গা বেহাত। কই যাই? এমন সময় এক মন্দিরে সেবিকার কাজ পেলাম। শিক্ষা নিলাম। দীক্ষা আগেই হয়েছিল।
তারপর মূর্তির দিকে তাকিয়ে বললেন, যিনি সব কেড়ে নিলেন, তারই পায়ের কাছে আশ্রয় নিলাম। ভালই রেখেছেন। সব শোক ব্যাথা মন থেকে দূরে তো গেছে।
গেছে কি? জানি না। হয়তো গেছে। সত্যিকারের পুতুল খেলা হল না যখন, তখন এই পুতুল খেলাই সই!
আমার থাকার ঘরটা দ্যাখেন এসে?
দেখলাম, মন্দির সংলগ্ন একটা ছোট্ট ঘর। খাটের পাশে মহাপ্রভুর ছবি। একটা চৌকি পাতা। নীচে কিছু বাসনপত্র গুছিয়ে পরিপাটি করে রাখা।
মনে হল, সব হারায়নি। উনি নিজেই আমার সেই মনের ভাবটা কেড়ে যেন বললেন, এ আরো বড়ো সংসার বুঝলেন। কত ভক্ত আসে। নামগান হয়। হেঁটে হেঁটে এবাড়ি ওবাড়ি থেকে ভিক্ষা নিয়ে আসি। গোবিন্দের ভোগ দিই। দু'বেলা চলেই যায়।
ফিরবার জন্য পা বাড়ালাম। ওনার চোখের কোল ভিজল। বললেন, এ ভিখারির মনের দুঃখের কথাগুলো শুনলেন তা হলে! কারেই বা বলি এসব কথা?
আমি চুপ করে থাকলাম মাথা নীচু করে। কে ভিখারি? আমি, ও, না মন্দিরের সে?
তিনি আমন্ত্রণ জানালেন দোলের কীর্ত্তনোৎসবে। বললুম, আসব।