সানাই বাজছে বেহাগে। লগ্ন সন্ধ্যায়। এই তো লগ্ন। এই তো সন্ধ্যা। বেহাগের সঙ্গে শুরু হল মন্ত্র উচ্চারণ।
ওরা পাশাপাশি দাঁড়িয়ে, একটু দূরে, যাদের হৃদয় এক সুরে বাঁধা পড়েছে, কিন্তু সমাজ দেখেও দেখেনি। কোনো মন্ত্রও নাকি লেখা হয়নি ওদের জন্যে। তাদের হিতের জন্যে কোনো পুরোহিতের সন্ধান দিতে পারেনি কেউ।
ওরা পাশাপাশি দাঁড়িয়ে। হাতদুটো ধরা। না হয় এভাবেই হোক। আগুন সাক্ষী। আগুন তো দশকৌণিক। দেবে না সাক্ষী?
মন্ত্রোচ্চারণ আসছে ভিড় ভেদ করে; হাসি, হইচই ভেদ করে। তারা একবার নিজেদের দিকে দেখল আড়চোখে। শ্রবণ দশকৌণিক। সানাইয়ের লয় দ্রুত। দু'জনের হৃৎপিণ্ডের দৌড়। তানে মেতেছে বিসমিল্লাহ্। বেহাগ আছড়ে পড়ছে বুকের অমসৃণ তটে। সুখ এসেছে। যেন পরিযায়ী পাখি।
মন্ত্রে বাধা পড়ছে। দু'জনে দেখতে পাচ্ছে, সুক্ষ্ম সোনালী সুতো। মীরা গেয়েছিলেন, চোখের জলে সিঞ্চন করে প্রেমের বীজে অঙ্কুর এনেছিলেন। মীরা! নূপুরের শব্দ আসছে কানে। হৃদয়তটে মীরা সুফি সাধকের মত দুটো হাত আকাশের দিকে তুলে ঘুরছে। এ নাচও দশকৌণিক।
সানাই বাজছে জয়জয়ন্তীতে। পাঁজরগুলো গলে গলে মিশে যাচ্ছে জলে। নোনতা জলে। হাতের আঙুলে জমছে ঘাম। আনন্দের মাদল বুকে। পাগল হয়ে যাবে যে!
একজন একজনের চোখে তাকালো। শুকনো চোখে জমে এত জল! মীরা বুঝল। আর বুঝল রুমি। রুমি বুক ঠেকিয়ে দাঁড়ালো দু'জনের বুকে। জড়িয়ে ধরল। বলল কানে কানে, ভালোবাসার শরীরে ডানার ঝাপট।
সাতপাকে কে ঘোরাবে?
একজন দাঁড়ালো। আরেকজন গেল একবার জল আনতে। একবার গেল কফি আনতে। একবার গেল খোঁজ নিতে, এর-ওর-তার। শেষে আবার আনল জল। ঘুরে নিল সাতবার। যে দাঁড়িয়ে আছে মধ্যে, একা, কেউ জানে না, জানে শুধু রুমি আর মীরা, সে লজ্জায় হল লাল। লজ্জায়, হাসির রেখা পানপাতা হল, বুক উথলে ওঠা কান্নাকে আড়াল করে।
আবার এসে দাঁড়ালো পাশে। এবার সিঁদুর।
বিয়ের মণ্ডপে লালগুড়ো গড়িয়ে নামছে সিঁথি বেয়ে কপাল। তাদের সিঁদুর কই?
একে তাকালো অন্যের দিকে। কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে। দু'জনেরই। এই শীতেও। শীত কই?
ভীমপলাশে বিঁধে যাচ্ছে বুক।
একজন তাকালো। তর্জনী উদ্যত হল। সে আরেকজনের চুল ঠিক করার আছিলায় ছুঁলো কপাল। ভিড়ের মধ্যে চুরি করল ঠোঁটের আদর।
এই সিঁদুর। এই স্পর্শ। এইতেই বুকে উছলে উঠল রক্ত। কপাল লাল হল, লাল হল গাল। সিঁদুরের চেয়েও লাল।
একজন বড় বেশি আরেকজনের কাছে। ডিও-র গন্ধ মিশে যাচ্ছে। কার ডিও-র গন্ধ কোনটা? কার স্বপ্ন কোনটা? কার ব্যথার রঙ কোনটা? সব মিলে মিশে এক।
পেছন থেকে হঠাৎ কে যেন বলল, শুনেছেন, সুপ্রিমকোর্ট থেকে সমকামী বিয়ে নিয়ে রায় দিতে চলেছে। সমাজটা উচ্ছন্নে দিয়েই ছাড়বে এরা!
দু'জনে চমকে উঠল। এতক্ষণ সানাইয়ে ডুবে গিয়েছিল সমাজ। সুর মর্মভেদী। মর্মে জাগে সত্য। সমাজে জাগে ভয়।
একজনের চোখের কোণ বেয়ে নামছে তুষারধ্বস। আরেকজন চুপ। তুষারধ্বস থামাবে কে?
বিসমিল্লাহ্ বাজাচ্ছে দরবারি।
রুমি উড়ছে সাদা চিল হয়ে। মীরা নীলাকাশে চাঁদ হয়ে স্থির।
দু'জনে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে। ছাড়বে না জায়গা। থাকবে দাঁতে দাঁত চিপে। সমাজ নেই, সংসার নেই। দু'জন মানু্ষের মধ্যে দাঁড়াবে এমন স্থান বেঁচে নেই একটুও। এত কাছাকাছি দাঁড়িয়ে ওরা।
ভালোবাসা দশকৌণিক।