সৌরভ ভট্টাচার্য
16 June 2019
সারাদিন অসহ্য গরম। ঝড়বৃষ্টির আশা নেই আবহাওয়া দপ্তর জানিয়েছে। রবিবারের বিকাল। বিজন একটা নীল চেকচেক লুঙ্গী পরে খালি গায়ে একটা হাত পাখা নিয়ে বারান্দায় এসে বসল।
একটু হাওয়া দিচ্ছে? বাইরে বলেই হয়ত। সামনে দুটো গলির মুখ, বটতলা মোড়, একটা শনি মন্দির এই মোড়েই। শনি মন্দিরের গায়ে খুব পুরোনো একটা বটগাছ। বিজনের থেকে হয়ত আরো ষাট বছরের বড়। একইরকম রয়ে গেছে। সব বদলে গেল গাছটা ছাড়া। তাদের একান্নবর্তী পরিবার টুকরো টুকরো হয়ে গেল। ছেঁড়া মেঘের মত। রাস্তার এপারে, ওপারে কতগুলো বাড়ি ভেঙে ফ্ল্যাট হয়ে গেল পরপর। ক্লাবটা একচালা থেকে দু'ঘর হল। রঙ বদলালো। বিজনও সাতান্নতে এসে পড়ল।
শনি মন্দিরের ঘড়িটায় পাঁচটা বেজে দশ। পুরোনো ঘড়ি। সেকেন্ডের কাঁটাটা নেই। মন্দিরের সামনে কতকগুলো ছাগল কালকের পুজোর ফেলে যাওয়া ফুল-পাতা খাচ্ছে। মন্দিরের ডানদিকে সাইকেলের দোকানটা খুলছে ঝন্টু। ওর বাবার দোকান। রাখাল, ঝন্টুর বাবা, এখন আর বসে না। প্যারালাইসিস হয়ে ডানহাতটা পড়ে গেছে। কাজ করতে পারে না। বাঁহাতটা দিয়ে ডান হাতটার উপর বোলায় মাঝে মাঝে। লোকে বলে মুদ্রাদোষ। বিকালে সামনে একটা চেয়ারে বসে রোজ নাতি নিয়ে। একটু পর আসবে।
ঝন্টু একটা লিক সাইকেল দোকান থেকে বের করে, চাকা থেকে টিউবটা খুলল। খালি গা, সবুজ একটা হাফ প্যান্ট পরা খালি। কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমছে। মোটা হয়ে গেছে ছেলেটা বড্ড। কোলেস্টেরল নেই তো?
বিজন এতক্ষণ বারান্দার দেওয়ালে হেলান দিয়ে হাতপাখা নাড়িয়ে নাড়িয়ে হাওয়া দিচ্ছিল নিজের রোগা শরীরটার পাঁজরগুলোয়। কোলেস্টেরলের চিন্তাটায় মনটা গড়িয়ে আটকে গেল। তার স্ত্রী মারা গিয়েছিল আচমকা, লক্ষ্মীপুজোর দিন রাতে। হার্ট অ্যাটাক। কোলেস্টেরল কমানো যাচ্ছিল না কিছুতেই।
ঘুমের মধ্যে শুনল একটা গোঙানির শব্দ। বিজন ভাবল রাখি হয়ত দুঃস্বপ্ন দেখছে। সন্দেহ হল। নয় তো। চোখদুটো ঠেলে বাইরে বেরিয়ে আসছে। ইশারায় বলছে শ্বাস নিতে পারছে না। বুকে ব্যথা। অসহ্য ব্যথা।
ঝন্টু লিক খুঁজছে। একটা তোবড়ানো রঙচটা গামলায় ময়লা জলের মধ্যে ডুবিয়ে ডুবিয়ে দেখছে ভুড়ভুড়ি কাটে কিনা। এটা দেখতে খুব ভালো লাগে বিজনের। কেউ বলতে পারে না কোন চুবুনিতে ভুড়ভুড়ি কাটবে। সেরকম হলে দু-তিন জায়গাতেও লিক বেরোতে পারে। এত বাতাস, তবু রাখি বাতাস নিতে না পেরে চলে গেল।
রাখিকে যখন নিয়ে আসা হল তখন ঝন্টু এসে দাঁড়িয়েছিল এই সামনেটায়। তখন অবিবাহিত ও। উঠোনের যেখানে রাখিকে শোয়ানো ছিল সেখানে এখন একটা নয়নতারা গাছ হয়েছে। কত ফুল। বিজন তোলে না। তখন ওখানে সিমেন্ট ইট রাখা ছিল, ছাদটা পাকা হচ্ছিল।
রাখি বোবা ছিল। রাখি চলে যাওয়ার পর বুঝল রাখি বোবা ছিল না। তার কত নিজস্ব শব্দ ছিল। চুড়ির আওয়াজ, বাথরুমে কল খোলার আওয়াজ, মাজা বাসন সাজানোর আওয়াজ, রান্নাঘরের অজস্র ঠুকঠাক ঠুনঠান আওয়াজ। এখন ঘরটা বোবা। বিজন কথা বলে না।
লিক একটাই ছিল। রাখাল নাতি নিয়ে বটগাছটার নীচে বসেছে চেয়ারে। চেয়ারগুলো ক্লাব থেকে দিয়েছে। একটা চেয়ারে ঝন্টুর বাচ্চাটা। খালি গা। একটা লাল প্যান্ট পরে। পাশের চেয়ারে রাখাল। বাঁহাত দিয়ে নাতিকে ধরে আছে। ডান হাতটা যেন রাখা আছে পাশে, অসাড়। নাতি চঞ্চল, বারবার বলে রাখাল। বলতে বলতে চোখদুটো জ্বলজ্বল করে ওঠে। নাতি পা দুলাচ্ছে বাবার সাইকেল সারানো দেখতে দেখতে। একবার ডান হাতের তর্জনীটা উঁচিয়ে বলল, ছাইকেল... বাব্বা...
রাখাল বাঁহাত দিয়ে নাতির পেটের উপর ঘের তৈরি করে বলল, হ্যাঁ দাদা... বাবা সাইকেল সারাচ্ছে...
বিজন উঠবে এইবার। মেয়েটা ফোন করবে। ফোনের কাছে বসতে হবে। হঠাৎ দৌড়াতে পারে না, হাঁফ হয়। বিজন ল্যাণ্ডফোনের কাছে এসে বসল। আজ দশ বছর ধরে বসছে। মেয়েটার বিয়ে হয়েছে সাঁকরাইলে, এখান থেকে পাঁচ ঘন্টার পথ। সাড়ে পাঁচটা থেকে ছ'টার মধ্যে ফোন আসে। বিজনের মনে হয় এইটুকু সময় সে বেঁচে আছে। কথা বলে।
আজ দেরি করে ফোন এলো। সাড়ে ছটার পর। তিনবার রিং হল। কেউ ধরল না। বিজন ফোনের পাশে শুয়ে।
বিজনকে যখন সাজিয়ে খাটে শোয়ানো হল, তখন ঝন্টু একটা সাইকেলের স্ট্যাণ্ড লাগাচ্ছিল। রাখাল সবে নাতিকে নিয়ে বসেছে।
নয়নতারা গাছটা বিজনের মৃতদেহের খাটের একটা পায়ায় দুমড়ে গেল। রাখালের নাতি দাদুকে বলল, ফু... গাছ..., কিন্তু রাখাল শুনতে পেলো না... সে বাঁ হাতে নাতিকে আড়াল করে দাঁড়িয়ে। খেয়াল করেনি তার ডানহাতের সাথে হাত ছুঁয়ে দাঁড়িয়ে ঝন্টু, হাতটায় সাড় নেই তো।