সৌরভ ভট্টাচার্য
27 January 2019
জিভাগোর মৃত্যুর পর যেটা পড়ে রইল সেটা ইতিহাসের কয়েকটা পাতা। জিভাগো সেই পাতাগুলোতে বেঁচে নেই, রেশ রয়ে গেছে। জিভাগো কবি। কারণ বরিস পাস্টেরনাক নিজে একজন কবি। কবি সব কিছু ফাঁকি দিতে পারেন, কবিতাকে না। সে ফাঁকি মৃত্যুর চেয়ে শীতল। বেঁচে থাকা বলে না সেটা আর, জীবিত থাকা কেবল।
জিভাগোতে রাজনীতির কথা আছে। সেই রাজনীতি বিল্পবের রাজনীতি, হিংসার রাজনীতি, অবিশ্বাসের রাজনীতি, বিশ্বাসঘাতকতা, আশা, আশাভঙ্গের রাজনীতি। কিন্তু সবই একটা সংবেদনশীল নির্মোহ বর্ণনায়। কেন্দ্রে মানুষ। ভালোবাসা, দায়িত্ব, দর্শন এবং অবশ্যম্ভাবী মনস্তত্ত্ব। এ সবের কেন্দ্রে এক কবিসত্তা। সময় আর রাজনীতির যাঁতাকলে পিষ্ট কিছু মানুষ।
কোনো মানুষ নিজেকে সম্পূর্ণ পায় না। জিভাগোর জীবনে দুজন মানুষ – টোনিয়া আর লারা। টোনিয়া জিভাগোর স্ত্রী, তার সন্তানদের মা, জিভাগোর কর্তব্য, অবশ্যই ভালোবাসা। কিন্তু সে ভালোবাসা শরতের আলোর মত স্বচ্ছ স্থির ভালোবাসা। লারা এল কালবৈশাখী হয়ে। কিন্তু লারাও তো বিবাহিত? লারার স্বামী লারার থেকে বহুদূরে, তার কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন স্বেচ্ছায়। লারার ভালোবাসা তার স্বামীর কাছে মনে হয়েছিল বড্ড বেশি মহৎ, কারাগারের মত সে মহত্ব তাকে যেন চারদিক থেকে বেঁধে ফেলছে। লারা সব কিছুতেই যেন নিজের মহত্বকেই বেশি ভালোবাসে, তাকে না। একটা রক্তমাংসের সম্পর্ক যেন নয়, যেন চার্চের মত পবিত্র যে সম্পর্ক, তা প্রশংসার যোগ্য, বাসযোগ্য নয়।
দুজন অত্যন্ত সংবেদনশীল মানুষ, অত্যন্ত অস্থির সময়ে নিজেদের কর্তব্য স্থির করতে চাইছে। এই যেন উপন্যাসের মূলসুর। একটা সময়, মানবিকতার সীমারেখায় নিজের গতিপথ খুঁজছে। কিন্তু এত বেশি বেগ, যেন টাল সামলাতে পারছে না। বালিঘরের মত সব ঝরে যাচ্ছে ঝুরঝুর করে। তবু যেন মহাকালের পথের রেখায় তার একটা স্থায়ী দাগ কাটা হয়ে যাচ্ছে কোথাও। কিন্তু সে দাগ যে ছবি আঁকবে সে ছবি দেখার জন্য কেউ বেঁচে থাকবে না। থাকেও না।
এই ক্ষুদ্র কালের গণ্ডিতে সত্য যে ভাষায় ধরা দেয়, তা একমাত্র কবিতা। জিভাগোর মানসলোক যে ভাষায় সব কিছুর অর্থ খোঁজে, সে কবিতা। কবির প্রশ্ন আর দার্শনিকের প্রশ্ন কখনও কখনও এক হয়ে যায়। তখন দর্শন যুক্তির বিশ্লেষণের রাস্তায় না হেঁটে হৃদয়ের ভাষায় নাও ভাসায়, যা স্বজ্ঞা। সে সুক্ষ্ম তর্ক নয়, গভীর স্থির উপলব্ধি। জিভাগো মানুষের মধ্যে শুধু মানুষকেই দেখে। দল, মতবাদ, দেশ কাল ছাপিয়ে দেখে। তার দর্শন, কবিতা মানুষে শুরু হয়ে মানুষেই শেষ হয়। প্রকৃতির বর্ণনাও মানবিক হয়ে যায় তাই। যে মানুষ নিজের মধ্যে নিঃসঙ্গ সে সব কিছুতেই অবশেষে দীর্ঘশ্বাসের দর্শনে এসে দাঁড়ায়। জিভাগো সিনিক হয়ে নিজের মধ্যে নিঃসঙ্গ নয়, জিভাগো আবেগে আত্মহারাও নয়, জিভাগো সংবেদনশীল। সংবেদনশীল মানুষ পক্ষপাতদুষ্ট হয় না, সে সত্যের সাথে হাঁটতে হাঁটতে মাঝে মাঝে মৃত্যুকেও ডিঙ্গিয়ে যেতে চায়। জিভাগো মৃত্যুকে ডিঙ্গিয়ে এসে দাঁড়ালো তার কবিতায়। জিভাগোর একাকীত্ব করুণ হয়ে উঠল মানুষী ভালোবাসার তীব্র বেদনাত্মক আকাঙ্ক্ষায়। সেই তীব্রতাই জিভাগোকে শক্তি দিল। জিভাগো সারাজীবন মানুষের উপর বিশ্বাস হারালো না, ভালোবাসার উপর বিশ্বাস হারালো না, শুধু নিজের জীবনের এতগুলো ঝড়ে বিপর্যস্ত হয়ে নিজেকে গোপন করতে চাইল সব কিছু থেকে। মৃত্যু ছাড়া তার যেন কোনো আড়াল রইল না।
অসম্ভব ভালো অনুবাদ শ্রদ্ধেয় মানবেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় আর মীনাক্ষী দত্তের। কবিতাগুলো অনুবাদ করেছেন বুদ্ধদেব বসু মহাশয়। কয়েকটা অংশ তুলে দিচ্ছি। যে অংশগুলো আমার সাংঘাতিক ভালো লেগেছে, তার কয়েকটা।
১) জিভাগোর স্ত্রী হাস্পাতালের বিছানায় শুয়ে। সদ্য তাদের একটা সন্তান হয়েছে। জিভাগো দূর থেকে তাকে দেখছে, টোনিয়াকে। কাছে যাওয়া যাবে না বাচ্চা আর মায়ের সংক্রমণের ভয়ে। জিভাগো টোনিয়াকে দেখতে দেখতে ভাবছে –
“এক ভেলা যেন টোনিয়া, ইউরির(জিভাগো) মনে হল, মৃত্যুর নদীর ওপর দিয়ে এক অজানা দেশ থেকে জীবনের মহাদেশে দেশান্তরী আত্মা বহন করে নিয়ে এসে বন্দরে বিশ্রাম নিচ্ছে। এইমাত্র নামলো সেই আত্মাদের একজন; শূন্যগর্ভ জাহাজ নোঙর বেঁধে বিশ্রাম নিচ্ছে। তার পরিশ্রান্ত মাস্তুল আর গলুই, তার সমস্ত সত্তা এখন বিশ্রান্ত, আর তার স্মৃতি থেকে সম্পূর্ণভাবে মুছে গেছে সেই অন্য তীরের ছবি, সে ভুলে গেছে তার নদী পার হওয়া, তার তীরে এসে নোঙর বাঁধার কথা।
যে দেশে তার পতাকা সে উড়িয়ে এলো সে দেশে আর কেউ যায়নি, তাই এখন তার সঙ্গে কথা বলার ভাষা কেউ জানে না। “
২) নানা বিপ্লব, মতবাদের মধ্যে বাঁচতে বাঁচতে, সে সবে বিশ্বাস করে চলতে চলতে জিভাগোর উপলব্ধি,
“আমারও বিপ্লবী মনোভাব খুবই ছিল, কিন্তু এখন দেখছি হিংসার দ্বারা কিছুই পাওয়া যায় না। ভালো হতে হবে – তবেই লোকেদের ভালোর দিকে টানা যায়।“
৩) লারার প্রতি জিভাগো তার সর্বগ্রাসী ভালোবাসা জানাতে যে ভাষায় বলে উঠছে,
“আমার হিংসে হয় তোমার চুলের বুরুশটিকে, তোমার গায়ের ঘামের বিন্দুটিকে, যে বাতাসে তুমি শ্বাস নাও তার বীজাণুগুলো, যা তোমার রক্তে মিশে তাকে বিষাক্ত করে তুলতে পারে সেগুলোকেও হিংসা হয় আমার।“
এমনই কবিত্ব, এমনই গভীর আত্মবিশ্লেষণ, এমনই জটিল পরিস্থিতির মধ্যে দাঁড়িয়ে হাতড়ে হাতড়ে আলোর দিকে এগোনোর চেষ্টা, সর্বোপরি একটা আস্তিকতা জীবনের প্রতি, মানুষের প্রতি, সময়ের প্রতি। ডাক্তার জিভাগো, এক অসামান্য অভিজ্ঞতা, দুই মলাটের মধ্যে।
বই – ডাক্তার জিভাগো
লেখক – বরিস পাস্টেরনাক
অনুবাদক – মীনাক্ষী দত্ত, মানবেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়, বুদ্ধদেব বসু
প্রকাশক – প্রতিভাস
মূল্য – ৬০০/-
পাতা – ৫৭৬