মানুষটা ঋষিতুল্য জীবনযাপন করে ধনী হতে চাইছিল, সুখী হতে চাইছিল, নামী হতে চাইছিল। একজন রঙীন ঈশ্বরের দিকে তাকিয়ে প্রতিদিন প্রার্থনা করত - হে ঈশ্বর, তুমি আনন্দস্বরূপ, তুমি সুখস্বরূপ, তুমি সর্ব-বিপদহন্তা, তুমি ষড়ৈশ্বর্যসম্পন্ন, আমায় সুখে রেখো, বিপদমুক্ত রেখো, আমায় দারিদ্র্যহীন, রোগহীন, শত্রুহীন, দুশ্চিন্তাহীন রেখো। তুমি সুন্দর, আমায় সুন্দর করে রেখো।
তবু মানুষটার দুশ্চিন্তা ছিল, অসুখ ছিল, ভয় ছিল, আশঙ্কা ছিল। ঈশ্বরের ভাবনা- প্রার্থনার পাশাপাশি এসবই ছিল। মনে মনে সে ভাবত, জীব তো সে নিজে, ঈশ্বরের মত অমন সম্পূর্ণ খাঁটি হওয়া কি সম্ভব তার পক্ষে? সে নিজের এইটুকু দুর্বলতাকে মেনেই নিত। কিছু কিছু সময় এমনকি নিজের শরীরের তৃষ্ণাকেও বলত, ঠিক আছে, ঋষি তো আমি আছিই, এইটুকু সময় না হয় তোকে ছাড়ই দিলাম। তেমন তেমন সুযোগ তাই সে হাতছাড়া কই করত?
সেদিন এক দরিদ্র বয়স্কা রমণী এসেছেন তার কাছে সাহায্যপ্রার্থী হয়ে। তার শীর্ণ শরীরের দিকে তাকিয়ে ঋষি মনে মনে ভাবল, আহা রে, না জানি কোন জন্মের পাপের শাস্তি পাচ্ছেন, নইলে এই বয়সেও এত শ্রম, শুধু জীবনধারণের জন্য? ঈশ্বর তো করুণাসিন্ধুই..এই দেখো নারী, আমি কেমন সুখে আছি...বিনা শ্রমে...শুধু ঈশ্বরের নামগান করি বলে। (আসলে মানুষটা যখন নিজের কথা ভাবত, তখন নিজের দুষ্টুমিগুলোকে খুব সরল নির্দোষভাবেই দেখত, যেন গোলাপের সাথে কাঁটা। সে বুঝত গোলাপটিই তো আসল, কাঁটা তো অভিব্যক্তির পথে অপরিহার্য আবর্জনা।)
দরিদ্র মানুষটি সাহায্য নিল। তারপর ঋষিকে আশীর্বাদ করে বলল, সুখে থেকো বাবা, সুস্থ থেকো, আর আমাকেও নিজেকে সুস্থ রাখতে হবে, নইলে শ্রম ছাড়া জীবনধারণ হবে কি করে?
ঋষি চিত্রার্পিতের ন্যায় দাঁড়িয়ে রইলেন। যে আশীর্বাণী এতদিন ষড়ৈশ্বর্য ঈশ্বরের কাছ থেকে শুনতে চেয়েছেন, সে বাণী এই হতদরিদ্র নারীর কণ্ঠ থেকে কি করে বাজল? সে কি করে এই শ্রমের মধ্যে ঈশ্বরের আশীর্বাদ খুঁজে পেল? কেন তার ভয় নেই, দুশ্চিন্তা নেই? কিসের জোরে তার মধ্যে এই নিশ্চিন্ততা?
ঋষির রঙীন ঈশ্বর মিলিয়ে গেল। একজন গ্রীষ্ণের দুপুরের চড়া রোদের মত ঈশ্বর রমণীর সাথে সাথে তার আশ্রম থেকে বেরিয়ে গেল। কোথাও কোনো ছায়া নেই। যেদিকে তাকাল ঋষি শুধু ঈশ্বর আর ঈশ্বর। ছায়াহীন, কায়াহীন, প্রচণ্ড রুদ্রের বেশে ঈশ্বর। ঋষির চোখে জলের বিন্দু দেখা গেল। তার ভয়, লোভ, দুষ্টুমির কাতুকুতু সব মিলিয়ে গেল। এই তো তিনি সামনে দাঁড়িয়ে। প্রচণ্ড রুদ্রের বেশে। এক তীব্র ক্ষমা, অসহ্য করুণা, প্রবল ভালোবাসা তার সামনে দাঁড়িয়ে বলছে, আয়।
ঋষি এই প্রথম অনুভব করল, নির্ভয় কাকে বলে, অহিংসা কাকে বলে, ভালোবাসা কাকে বলে। সে বুঝল, যার শ্রী-তে রুদ্র নেই, সে মিথ্যা। আর যে রুদ্রে শ্রী নেই সে মিথ্যা ভ্রুকুটি। সেদিন থেকে সে আশ্রম ছাড়ল। পথে পথে ঘুরে বলে বেড়াতে লাগল - ওরে ভয় নেই, ভয় নেই, অন্নপূর্ণার সাথে দিগম্বর মহাদেব ফেরেন একই সাথে, এককে ছেড়ে আরেক থাকতে পারে না রে, ডাক তোর হৃদয়ে, পাবি তাঁকে। ওরে সুখী হতে চাইলে ঈশ্বরের দিকে ফিরিস নে, যদি পূর্ণ হতে চাইবি, তবে ফের সে দিকে, তিনি রুদ্র, তিনিই শ্রী। তিনি সমস্ত নিয়ে সমস্তকে ফিরিয়ে দেন। ডাক, ডাক, ডাক।
সৌরভ ভট্টাচার্য
1 October 2019