স্বামীজি বলেছিলেন, ধর্মের সার চিত্তশুদ্ধি।
এর উদাহরণ স্বামীজি হয় তো নিজেও আজীবন দেখেছেন কিনা সন্দেহ হয়। বাঙালির ধর্মের সার হল শব্দ উৎপাদন। ঢাক, ঢোল, কাঁসা, শাঁখ, খঞ্জনি, মন্ত্র, হুলুধ্বনি, আধুনিক জগতে মাইক।
শব্দ না হলে দুর্গা, কালী, কার্তিক, জগদ্ধাত্রী, বিশ্বকর্মা যেই হোন কেন তিনি তুষ্ট হন না, এমন কথা নিশ্চয়ই কোথাও লেখা থাকবে। এত শাস্ত্র এক জীবনে পড়ে শেষ করা তো যায় না, তাই হয় তো হবে আমার পড়া হয়নি। থেকে থেকেই কোথাও নানাবিধ শব্দ উৎপন্ন হলেই বুঝি কোথাও দেবতার আগমন হয়েছে।
তবে যে সাধকেরা হিমালয়ের গুহায় সেঁধোতেন ঈশ্বরলাভের জন্য তবে তিনি কোন ঈশ্বর? যিনি ঢাকের তালে কোমর দোলা দেখতে আসেন? না যিনি চিত্তকমলে দীপশিখায় প্রজ্জ্বলিত হয়ে ওঠেন নিঃশব্দে? রবি ঠাকুর যে লিখেছিলেন, যে ভক্তি তোমারে লয়ে ধৈর্য না মানে, মুহূর্তে বিহ্বল হয় নৃত্যগীতগানে…. সে কি বোষ্টুমদের দিকে কটাক্ষ করে লিখেছিলেন? কিন্তু তিনিই বা বাঁচলেন কি? তেনার জন্মদিনেই খোলকরতাল, ডুগিতবলা নিয়ে সক্কলে সুরে - অসুরে যে কোলাহল তৈরি করে, সেও কি কম গা!
তো যা নিয়ে কথা হচ্ছিল। ঈশ্বর কত ডেসিবেল অবধি ভক্তি পছন্দ করেন? এ নিয়ে কোনো তত্ত্ব কোথাও লিখেছে কি গা? মানে বেদে সব যখন আছে তখন এটুকু কি ছাপা হয় নাই? কোনো সংস্করণেই কি হয় নাই?
গুহার ঈশ্বর নীরবতা পছন্দ করেন। সমাজের ঈশ্বর ঢক্কনিনাদ পছন্দ করেন। এই কি তবে সিদ্ধান্ত টানা যায়? আচ্ছা এই যে যারা দীক্ষাটিক্ষা নিয়ে সাধন করেন, তাদের কি গুরু বলে দেন, যখন ইষ্টকে ধ্যান করবে, পাশে একজন ঢাকিকে বলবে ওই মৃত পশুর চামড়া চাবগে চাবগে শব্দ বার করতে। আর যত ধাতব জিনিসপত্র আছে সে সবও তুমুল জোরে বাজাবে। বাড়ির মহিলাদের বলবে জিভের প্রবল সঞ্চালনের ইষ্টকে পরমানন্দে ভরিয়ে তুলতে।
এরকম শুনেছেন? আমি এত এত সম্প্রদায়ে, এত এত গুরু যে গুলিয়ে ফেলেছি, তাই জিজ্ঞাসা করছি আর কি। তা আমি তো শুনিনি। বরং রামকৃষ্ণদেবের কথায় পড়েছি ঈশ্বরকে ধ্যান করবে মনে বনে আর কোণে। তা উনি বলেননি তো যে ঈশ্বর ধ্যানে তুষ্ট নন, তিনি ঢাক না বাজালে, মাইকে কুমারশানু,লতা, কিশোর, অভিজিৎ না বাজালে আসেন না।
শুধু কি তাই? এই যে অষ্টপ্রহর হল, সুরে অসুরে লোকগুলো চেঁচিয়ে চিত্তির করে দিল, তার বেলা? আচ্ছা, আমি তো চৈতন্যচরিতামৃত, চৈতন্যভাগবত পড়েছি নাকি। সেখানে কোথায় লেখা আছে যে,
শুন শুন নিত্যানন্দ শুন দিয়া মন
মাইকেই করিবে সবে নামসঙ্কীর্তন
সুরে অসুরে হোক, তায় ক্ষতি নাই
শব্দাঘাতে জনগণের শান্তি হরা চাই
আমি এমন লাইন কক্ষণো পড়ি নাই। যদি কেউ পড়ে থাকেন তো আমায় একটু জানাবেন অনুগ্রহ করে।
আসলে ঈশ্বর মানুষকে কণ্ঠ দিয়েছে, মাইক তো দেন নাই, তাই সুর সৌরভের মত ছড়িয়ে না পড়ে, বন্দুকের মত ছুটে এলে কেমন লাগে তা তিনি জানবেনই না কেমন করে?
কিন্তু আসল সমস্যাটার সমাধান হল কই? তিনি নীরবে চিত্তে স্থান নিতে চান? না প্রবল ঢাক-ঢোল, হুলুধ্বনি শাঁখের আওয়াজে আমাদের তুমুলভাবে উন্মত্ত অবস্থায় দেখতে চান সেটাই তো স্পষ্ট হল না। কত ডেসিবেলে শব্দ হলে ভক্তিকে গ্রহণ করেন ঈশ্বর? অ্যাদ্দিন শুনেছি হেতুকী ভক্তি, অহেতুকী ভক্তি কিম্বা বৈধী ভক্তি আর রাগভক্তি। কেউ কি কোথাও লিখেছেন, ডেসিবেলি ভক্তি আর অডেসিবেলি ভক্তি?