Skip to main content

কিছু থাকে আলগা মানুষ। সারাক্ষণ তাদের আলগা কথা, আলগা ভাব, আলগা ভালোবাসা, আলগা হাসি-মজা। 

    আবার কিছু মানুষ থাকে নোঙর ফেলা। তাদের কথা গভীর, ভাব গভীর। কথা শুনলে বুকে ঠং করে লাগে। ভালোবাসা হাঁটুজলেই শেষ হয়ে যায় না। 

    নস্কর ডাক্তার সেই গোত্রের। রাতের অন্ধকারে কান পেতে থাকতেন। বাতাসে রুগীর খবর আসত। গন্ধে-শব্দে। রুগী মানে গাছেরা। নস্কর ডাক্তারের রুগী ছিল গাছ। প্রেশারের যন্ত্র, থার্মোমিটার, স্যালাইনের বোতল, ওষুধপত্র, কাঁচি-ছুরি সব নিয়ে ভোরবেলা বেরিয়ে যেতেন। কখন ফিরবেন কেউ জানত না। সেরকম সিরিয়াস কেস হলে তো রাতে ফিরতেনই না। 

    এই হল নস্কর ডাক্তার। গ্রামে তাই বলে কি তাকে কেউ গাছের ডাক্তার বলে ডাকত? বলত 'পাগলা ডাক্তার'। গ্রামে একমাত্র বন্ধু ছিল শুচি। শুচি'র বয়েস বারো। ডাক্তারের বয়েস বাহান্ন। তবু কি মিল! শুচি এর-ওর বাড়ির গাছের খবর নিয়ে আসত। এমনকি টবে করেও নিয়ে আসত, বলত, দেখো তো এ খাচ্ছে না কিছু, কিম্বা বলত, এ খালি খালি গায়ে পোকা নিয়ে হয়রান হয়ে যাচ্ছে, কিম্বা এর শিকড়গুলো দুর্বল হয়ে যাচ্ছে। এরকম নানা কথা হত ডাক্তার আর শুচির। 

    আমি বলছি যেদিনের ঘটনা, সেদিনের পর থেকে আর ডাক্তারকে দেখেইনি কেউ। 

    সেদিন রাতে খুব ঝড় হয়েছে। ডাক্তার সারারাত ঘুমাতে পারেনি। বাতাসে খালি গাছের গায়ের রক্তের গন্ধ। এই গাছ পড়ে যায়, সেই গাছ পড়ে যায়। ডাক্তার আর থাকতে না পেরে মাঝরাতেই ঝড়ের মধ্যেই বেরিয়ে গেল। শুচির বাড়ির পাশ দিয়ে যেতে হয়। যেই না শুচির বাড়ি পার হচ্ছেন, অমনি শুচি একটা রেনকোট গায় দিয়ে বেরিয়ে এসে বলল, এখন কোনো কথা না, সোজা পা বাড়াও। আমি অনেক ব্যান্ডেজ এনেছি। আগে বটগাছটার কাছে চলো। 

    ডাক্তার বুঝল এখন শুচির সঙ্গে তর্ক করা বৃথা। তিনি তাড়াতাড়ি পা চালালেন। তুমুল ঝড় হচ্ছে। বটগাছটার কাছে এসে দেখেন সত্যিই বটগাছটা কাহিল হয়ে পড়েছে ঝড়ের দাপটে। সঙ্গে সঙ্গে প্রেশার মাপার যন্ত্রটা বার করে একটা ডালের সঙ্গে কাফটা জড়িয়ে দিতে দিতে শুচিকে বললেন, তুই টনিকটা গুলে ফেল তো মা। 

    শুচি টনিক গুলতে শুরু করল। ডাক্তার প্রেশার মেপে দেখে অনেক বেশি। এই ঝড়ের জন্যেই হয়েছে। হঠাৎ বটগাছটা বলে উঠল, আমায় ছাড়ো ডাক্তার, আমার বয়েস একশো উনচল্লিশ বছর হল, তুমি ওই টগরের কাছে যাও, আমার একটা ডাল ওর উপর পড়ে যাচ্ছেতাই অবস্থা ওর। 

    শুচি ডাক্তারের হাতে টনিকটা দিয়েই বলল, আমি যাচ্ছি, তুমি এসো। 

    ডাক্তার টনিকটা নিয়ে বসে একটা শিকড় ওর মধ্যে চুবিয়ে দিতেই গাছ সোঁ করে টেনে নিয়ে বলল, যাও যাও তুমি, ওদিকে দেখো গিয়ে। 

    সত্যিই খুব খারাপ অবস্থা। টগর গাছটা পুরো নেতিয়ে পড়েছে। বটের ডাল পড়ে তার নিজেরও কয়েকটা ডাল ভেঙেছে। 

    শুচি বলল, আমি প্রেশারটা মাপছি, তুমি একবার ওই কুটুসফুল ঝোপের দিকে যাও। টগর আমায় বলল, ওই ঝোপের মধ্যে নাকি একটা বড় টব পড়েছে ওই মিত্তিরকাকুর বাড়ির ছাদ থেকে। 

    ডাক্তার ছুটতে ছুটতে বললেন, কেন যে এরা টবগুলো ছাদের কিনারায় রাখে, আমি কতবার বারণ করেছি। যা ভেবেছিলেন তাই, বেশ কয়েকটা গাছ থেঁতলে গেছে পুরো। কাঁচি দিয়ে থেঁতলানো ডালগুলো কেটে ঠিক করতে যাবেন, কুটুসফুলের ঝাড় বলল, আমি ঠিক হয়ে যাব, তুমি ওই ঘাসগুলোকে দেখো কিছু করতে পারো কিনা। 

    ডাক্তার চমকে উঠে বলল, ঘাস? ঘাসেদের তো কিছু হয় না। 

    কুটুস গাছের ঝাড় বলল, তুমি যাও না, গিয়ে দেখো। 

    ডাক্তারের গিয়ে তো তাজ্জব হয়ে যাওয়ার মতো অবস্থা! একটা বড় মাটি কাটার যন্ত্র পুরো মাঠটার মাটি প্রায় তুলে ফেলেছে। 

    ডাক্তার গাড়ির সামনে গিয়ে চীৎকার করে বললেন, এগুলো কি হচ্ছে? মাঠটা নষ্ট করছ কেন?

    চালক গাড়ি থেকে নেমে এসে বলল, এই পাগলা, ভাগ এখান থেকে, নইলে মেরে ওই পুকুরের মধ্যে ফেলে রেখে যাব… এই মাঠটায় বড় শপিংমল হবে। জানে না যেন, ন্যাকা! এই বলে একটা মাটির দলা ছুঁড়ে ডাক্তারের গায়ে মারল। 

    শুচি দৌড়ে এসে বলল, কেন মারছ তুমি ডাক্তার আঙ্কেলকে?

    ড্রাইভার গাড়িতে উঠতে উঠতে বলল, তুই পাগলা বুড়োকে নিয়ে যা, আমি নইলে দু'জনকেই পিষে ফেলব। এই বলে সে গাড়ির হেডলাইটটা তাক করল তাদের দিকে। গাড়িটা একটা ষাঁড়ের মত ঘড়ঘড় করছে। 

    শুচি ডাক্তারকে নিয়ে পালাতে যাবে, দেখে ডাক্তারের রক্তে মাটি ভেসে যাচ্ছে। ডাক্তার অজ্ঞান হয়ে মাটিতে পড়ে। শুচি কি করবে? সে তো বাচ্চা। একা কি করে তুলবে? ওদিকে ড্রাইভারটা তো গাড়ি নিয়ে চলে আসছে….

    শুচি হঠাৎ শুনল মাটি দাপানো একটা বিকট আওয়াজ! ফিরে দেখে বটগাছ, সঙ্গে চারটে আমগাছ, আরো কত কত গাছ সার দিয়ে আসছে এদিকে। এমনকি শুচির নিজের হাতে লাগানো পেয়ারা গাছটাও অত ছোটো-ছোটো ডালপালা নিয়ে আসছে। সে আগে আগে আসছে। এসেই সে শুচির একটা হাত ধরল। বলল, একদম ভয় পাবি না! আমরা আছি। এসে গেছি। 

    ড্রাইভার তো এসব দেখে তার ফোনটা হাতে নিয়ে যেই বেরিয়েছে, অমনি একটা গা-ঝাড়া দিল বটগাছ। পুরো মনে হল এক বালতি জল কে যেন ড্রাইভারের ঘাড়ে ফেলে দিল। ব্যস, মোবাইল গেল খারাপ হয়ে। দেখতে দেখতে সব কাটা ঘাস একটা বড় দড়ির মত হয়ে ড্রাইভারকে বেঁধে ফেলল। আমগাছ তার পাশে গিয়ে তাকে উত্তম মধ্যম পেটাতে পেটাতে বলল, আর করবি... আর করবি?...

    পেয়ারা গাছ আর শুচি মিলে ডাক্তারকে তুলে নিয়ে দৌড় দিল। কিন্তু এই ঝড়ে কোথায় যাবে তারা? পেয়ারা গাছ বলল, ডাক্তারকে এই মন্দিরের চাতালে রেখে তুই চলে যা, আমি পাহারায় আছি। একটা গাড়ি ডেকে আন, হাস্পাতালে যেতে হবে। 

    শুচির এক বন্ধুর বাবা গাড়ি চালাতো। শুচি তার বাড়ি যখন পৌঁছালো তখন ভোর হচ্ছে। ঝড় থেমে গেছে। সেই আঙ্কেল রাজী হল গাড়ি আনতে। শুচি এসে দেখে, ডাক্তার আঙ্কেল কই? পেয়ারা গাছটাই বা কই? মাঠে গিয়ে দেখে সব মাঠ আবার আগের মত। গাড়িটা রাস্তার একদিকে উলটে পড়ে আছে। আর ড্রাইভারটা? সেও নেই। 

    যা হোক, ড্রাইভারকে তো তার বাড়িতেই পাওয়া গেল। সে ভুল বকছে বলে তার বউ মাথার ডাক্তার ডাকতে রাস্তায় স্কুটি নিয়ে ঘুরছে। সে নাকি গাছ দেখলেই বলছে, আমায় ছেড়ে দিন... আমায় মারবে….


    বেশ কয়েকদিন পর শুচি একটা চিঠি পেল---

শুচিদিদিভাই,

    আমি আমাজনের জঙ্গলে আছি। আমায় তো তুমি সেই রাতে ওভাবে দেখে গেলে। খানিক পরেই একটা বড় অচেনা গাছ আমার প্রাণ ফেরালো। তার নাম নাকি বিশল্যকরণী। আসলে আমি মারা গিয়েছিলাম। তোমরা বুঝতে পারোনি। ও আমায় এখানে নিয়ে এসেছে। আমায় বলেছে আমার মানুষের আর দরকার নেই। আমাকে এদেরই বেশি দরকার এখন। তুমি একদম মন খারাপ করবে না। বড় হলে আমার কাছে এসে দেখা করে যেও, কেমন? আমায় ভুলো না কিন্তু। পেয়ারা গাছটা আমার সঙ্গে এসেছে। ও তোমায় অনেক ভালোবাসা জানালো। তুমি ভালো থেকো। ওদের খেয়াল রেখো। 


ইতি, ডাক্তার আঙ্কেল।