বৃষ্টি যখন লাগাতার তখন মন কিছুটা বেসামাল। একা মনে বৃষ্টি সংক্রমিত হয় তাড়াতাড়ি। ঘরবাড়ি-প্রতিবেশী-কাজ-দায়িত্ব সব অর্থহীন। অনেক দূরের।
ডায়েরী লিখছিল প্রশান্ত। আজ শনিবার। অফিস থেকে ফিরতে রাত হয়েছে। কাল রাত থেকে তুমুল বৃষ্টি। খড়দাতে ওর এক পুরোনো কলেজ বন্ধুর বাড়ি বেড়াতে এসেছে। প্রবাল আর প্রশান্ত। কলেজে হরিহর আত্মা ছিল। তারপর একজন বারৌণি চলে গেল তাদের মামাদের ব্যবসা দেখতে আর প্রশান্ত রাজ্য সরকারের একটা চাকরী পেয়ে বারাসাতে ওদের পৈতৃক বাড়িতেই থেকে গেল।
প্রবাল মেসেজ করেছে আজ আসার জন্য। দু'দিন দুই বন্ধু চুটিয়ে আড্ডা দেবে। শিয়ালদহ থেকে ট্রেনে ওঠার পরেই প্রবালের মেসেজ পেল প্রশান্ত, ও একটা কাজে একটু বাইরে বেরিয়েছে, প্রশান্ত যেন অপেক্ষা করে, রাতেই ফিরে আসবে। খাবার বাইরে থেকে কিনে নিয়ে আসবে।
প্রশান্ত প্রবালের এই খড়দার বাড়িতে আগে বহুবার এসেছে। এখন এখানে কেউ থাকে না। তাও কে একজন আছে ওদের সে দেখভাল করে। প্রোমোটারকে দেওয়ার কথা হচ্ছে সেটা ফাইনাল করতেই প্রবালের আসা।
সাড়ে আটটা নাগাদ প্রবাল ফোন করল। যা বলল তাতে প্রশান্ত রাগবে, না কাঁদবে, না হাসবে নিজেই ঠিক করতে পারল না। ও ওর এক আত্মীয়ের বাড়ি গিয়েছিল, স্বপনমামা, যিনি খুব অসুস্থ ছিলেন, একটু আগে ওর সামনেই এক্সপায়ার করে গেছেন। বয়েস নাকি মাত্র পঞ্চান্ন হয়েছিল। সে শ্মশানের কাজ সেরে কাল সকালের আগে ফিরতে পারবে না। চূচূঁড়ায় গেছে। রাতের খাবার খোকন এসে দিয়ে যাবে, ও ফোন করে দিয়েছে। খোকন মানে এ বাড়ি যে দেখাশোনা করে তার ছেলে।
প্রশান্ত প্রথমে ভাবল, ধুর... বাড়ি চলে যাবে। তারপর বাইরে তাকিয়ে যা বৃষ্টির দাপট দেখল, ভাবল, যাক গে... থেকেই যাই।
খোকন এসে খাবার দিয়ে গেল। হাতে গড়া রুটী আর আলুপোস্ত। দোকান সব বন্ধ তাই তার বাড়িতে যা ছিল তাই নিয়ে এসেছে। যা হোক, ওকে বিদেয় করে, খাবারগুলো খাবার টেবিলে রেখে প্রশান্ত টিভিটা চালালো। আজ আর কিছু লিখতে ইচ্ছা করছে না। প্রবাল বার দুই ফোন করে খোঁজ নিয়েছে ওর কোনো অসুবিধা হচ্ছে কিনা জানার জন্য। ওরই বা কি দোষ? কি করবে বেচারা।
বাইরে তুমুল বৃষ্টি হচ্ছে। হঠাৎ কলিংবেলটা বাজল। প্রশান্তর একটু চোখটা লেগে এসেছিল। চমকে উঠে পরিবেশটা বুঝতে একটু বেগ পেতে হল। কিন্তু এত রাতে কে আসবে? যা হোক দরজা খুলল। একজন মাঝবয়েসী লোক, সাদা পাঞ্জাবী পায়জামা পরা। গালে খোঁচাখোঁচা দাড়ি। তার দিকে তাকিয়ে হাত বাড়িয়ে বলল, হ্যালো ইয়ংম্যান, প্রশান্ত তো? প্রবালের কলেজ বন্ধু?
বলতে বলতে ভদ্রলোক বাড়ির ভিতরে ঢুকে পড়লেন।
- খুব আশ্চর্য হচ্ছ তো? ভাবছ কে এই অজানা অচেনা লোক ধুম করে ঘরের মধ্যে ঢুকে পড়ল? আবার তোমার নামধাম সব জানি?
প্রশান্তর ঘোর এখনও কাটেনি। টিভিটা অন্ আছে। নিউজ চ্যানেল খোলা। কিছু একটা ডিবেট হচ্ছে। কিন্তু কে ইনি?
- আমি স্বপন দাস। প্রবালের দুঃসম্পর্কের মামা। মানে তোমারও মামা।
স্বপন দাস? নামটা কিরকম চেনা চেনা লাগছে?... আরে ইনিই তো...
- ভাবছ আরে এরই তো মারা যাওয়ার খবর প্রবাল একটু আগে দিল, সে কি করে?...
প্রশান্ত চোখ বড়বড় করে শুনছে। তার মনে হচ্ছে একটা স্বপ্ন দেখছে। নিজের হাতে লুকিয়ে চিমটি কাটল। না তো! স্বপ্ন না...
- আরে বাড়ীতে ঢুকে মনে পড়ল, এখন তো আমি জানলা, ঘুলঘুলি সব দিয়েই ঢুকতে পারি... এমনকি রান্নার চিমনি দিয়েও... অভ্যাস হয়নি, তাছাড়া আবার ভয়টয় পেয়ে যাবে, তাই ভাবলুম ছাড়ো, দরজা দিয়েই মানুষের মত কলিংবেল বাজিয়ে ঢুকি। আসলে সদ্য ভুত হলুম কিনা, অভ্যাসটা করতে সময় লাগবে, কি বলো? বলেই হাপিশ হয়ে গেলেন। প্রশান্ত পাথরের মত দাঁড়িয়ে। কিছু অনুভব করার মত অবস্থা তার না এখন। হঠাৎ শুনল, আরে এই যে আমি, উপরের দিকে তাকাও।
যা দেখল তাতে প্রশান্তর নিজেরই আত্মারাম খাঁচাছাড়ার জোগাড়। পাদুটো সিলিং-এ ঝুলিয়ে তার মুখের কাছে মুখ এনে বললেন, কিরকম টেকনিক দেখছ? এসব ভুত হলে আপনিই রপ্ত হয়ে যায়।
বলেই সামনের টেবিলে রাখা খাবারের দিকে তাকিয়ে বললেন, অ মা, একি খাবার গো? চিকেন দেয়নি? আচ্ছা ছাড়ো, আমি খানিক বাদে গিয়ে নিয়ে আসব। বসো তুমি।
প্রশান্ত যন্ত্রবৎ বসল। সামনে মামা। মানে ভুত মামা। বসে গুনগুন করে গাইছেন, রঘুপতি রাঘব রাজারাম...
- বড় প্রিয় ভজন আমার বুঝলে কিনা। দাঁড়াও আরেকজন বাইরে অপেক্ষা করছে ডেকে আনি। আমাদের পরেশদা। ভীষণ ভালো মানুষ। উনি গতমাসে মারা গিয়েছিলেন। বড্ড বোর হচ্ছেন বাইরে নিশ্চই। আসলে তুমি কেমন মানুষ না জেনে আনি কি করে বলো?
প্রশান্ত বলতে যাবে, হ্যাঁ ডাকুন। মুখ খুলতেই উনি বললেন, পিছনে তাকাও, উনি এসে গেছেন। প্রশান্ত পিছনে তাকিয়ে দেখে একজন মাঝবয়েসী লোক তার দিকে জুলজুল চোখে তাকিয়ে আছে। বললেন, বসব?
প্রশান্ত মাথা নেড়ে সম্মতি জানানো ছাড়া আর গত্যন্তর দেখল না।
পরেশবাবু বসেই বললেন, অনেকদিন এইদিকটায় আসা হয় না...
- তুমি বোসো দাদা, মেলা কথা বোলো না, ছেলেটা একসাথে দুটো ভূত দেখে এমনিই ঘাবড়ে আছে, এরপর আবার নিমতলার ভূতের গল্প পাড়লে তো হয়েছে, বাবাজী আমার... যাকগে তুমি খেয়ে নাও...
প্রশান্তর মনের মধ্যে একটা অসাড়তা এসে গিয়েছিল, এখন সেটা একটু একটু করে কেটে যাচ্ছে। তার হঠাৎ কেন জানি গান গাইতে ইচ্ছা করছে, ছাদে উঠে এই বৃষ্টিতেও ডিগবাজি খেতে ইচ্ছা করছে, ওই পরেশবুড়ো ভূতের টাকে একটা চুমু খেতে ইচ্ছা করছে। কিন্তু সে কিছুই করল না, লম্বা একটা হাই তুলে বলল, না না সেরকম ভয় আর কি, আপনারা তো সেরকম ঘাড় মটকানো টাইপ ভূতের মধ্যে পড়েন বলে মনে হচ্ছে না...
পরেশভূত বলল, সেরকমও আছে... এই ধরো না তোমাদের এই প্রবালের বাড়ির দক্ষিণ দিকে রেললাইনের ধারে যে বটগাছটা আছে, সেখানে যে পিশাচটা আছে। কতলোককে যে নিশি ডেকে রেললাইনে নিয়ে গিয়ে শুইয়েছে...
- আ...হা... পরেশদা... দেখছেন ছেলেটা নতুন..., মামাভূত বলে উঠল কিঞ্চিৎ বিরক্ত হয়েই...
প্রশান্ত'র মনে হচ্ছে একবার বড় বাইরে যেতে হবে... কিন্তু এদের বাড়ির পায়খানাটা তো ওই দক্ষিণদিকে রেললাইনের ধারেই। কি করে?
- কি ভাবছ? মামাভূত সস্নেহে বললেন।
- বলছিলাম কি, আপনারা এবার আসুন, আমার না আর একটুও ভালো লাগছে না এইসব, মানে এই সব গল্পটল্প। আমার হাগা পাচ্ছে (প্রশান্তর নিজের কানকেই বিশ্বাস হচ্ছে না, এমনিতে সে এসব গ্রাম্য কথা বলা পছন্দ করে না, তার উপর এই বাড়ি থেকে চলে যাওয়ার কথা তো বলতেই পারে না। অথচ দুটো কথাই কেমন নিঃসঙ্কোচে বলে ফেলল সে)।
ভুত দুটো কিঞ্চিৎ অপ্রস্তুত হয়ে পড়ল। এ ওর মুখ চাওয়াচায়ি করল। তারপর বিনা বাক্যে হাপিশ।
ফাঁকা ঘর। টেবিলের উপর খাবারটা ঢাকা দেওয়া। প্রশান্ত'র খিদে পাচ্ছে না। পায়খানাটাও অত জোর পাচ্ছে না এখন। সে তাড়াতাড়ি শুয়ে কোনো রকমে রাতটা কাটিয়েই কাল প্রথম ট্রেনে ফিরে যাবে ঠিক করল। সাড়ে বারোটা বেজে গেছে অনেকক্ষণ। প্রায় একটা বাজতে চলল। এসিটা অন্ করে একটা চাদর গায়ে টেনে ঘুমিয়ে পড়ল।
চারিদিক অন্ধকার। বাইরে একটা মালগাড়ি যাচ্ছে মনে হচ্ছে, অনেকক্ষণ ধরে যাচ্ছে। সেটাও চলে গেল। ঘড়ির টিকটিক আওয়াজ ছাড়া আর কোনো শব্দ নেই। প্রশান্ত চোখ বন্ধ করে ঘুমানোর চেষ্টা করল।
একটা তন্দ্রা মতন এসেছে কি আসেনি, একটা কিছুর আওয়াজে তার ঘুমের রেশটা কেটে গেল। বাথরুমের দরজাটা কেউ খুলল? বাথরুম ভাবতেই তার মনে পড়ে গেল দক্ষিণের গাছটার কথা, আর... থাক থাক। চোখটা বন্ধ করে নিল।
এবার সপাটে একটা দরজা খোলার আওয়াজ হল, দড়াম! সে চমকে উঠে বলল, কে?
কোনো শব্দ নেই। একটা লাইট ইঞ্জিন ঘসঘস করে বেরিয়ে গেল। হঠাৎ মনে হল জানলার পর্দাটা কেঁপে উঠল। তারপর মনে হল তার পাশে রাখা জলের বোতলটা কেউ সরিয়ে দিল। প্রশান্তর আলো জ্বালতে গিয়ে মনে হচ্ছে, শরীরে নড়ার ক্ষমতা নেই আর। ঘাম হচ্ছে। সারাটা শরীরে ঠাণ্ডা শিহরণ খেলছে। মনে হচ্ছে বিছানায় হিসি হয়ে যাবে।
এবার বড়ঘরে যাওয়ার দরজাটার পাল্লাটা নড়ে উঠল। সে আবার বলতে গেল, কে? কিন্তু বলল না। দরজার সামনে দাঁড়িয়ে একটা বিশাল মানুষের মত কিছুর অবয়ব। প্রশান্তর মনে হচ্ছে সে কি ভয় পাচ্ছে প্রচণ্ড? না তো। সে কি হার্টফেল করবে... না তো... তবে কে ও... প্রশান্ত উঠে দাঁড়াল। একটু টাল খেয়ে সামলে নিল। বাইরে আরেকটা কিছু গেল। ইঞ্জিন না ট্রেন? জানে না। পর্দাগুলো উড়ছে। একটা সুর ভেসে আসছে কোথাও থেকে। কিসের সুর? প্রশান্ত এগোচ্ছে, ছায়ামূর্তিটার কাছে এগোচ্ছে... ওকে ছুঁলে কি হবে? ও কি ঠাণ্ডা? প্রশান্তর বুকের ভিতরটা কিরকম ছটফট করছে, ওকে ছুঁতে হবে... মূর্তিটা ক্রমশঃ দূরের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে... একটা সুর গাইছে... ও গাইছে কি?
ওই তো দূরে সিগন্যাল... ওই তো খড়দা স্টেশান। ফাঁকা স্টেশান। প্রশান্ত লাইন ধরে হাঁটছে, তার সামনে হাঁটছে সেই ছায়ামূর্তিটা... সে একটা সুর গাইছে... খুব চেনা সুর... কি যেন... কি যেন...
ছায়ামূর্তিটা লাইনে শুলো। প্রশান্ত তার পাশে গিয়ে শুয়ে পড়ল। তবু যেন মূর্তিটা অনেক দূরে। কি একটা সুর গাইছে? কিসের সুর? কোনো ছোটোবেলার গানের? দূরে একটা আলো তার দিকে এগিয়ে আসছে... ছায়ামূর্তিটার উপর পড়ল, ছায়ামূর্তিটা আলোর মধ্যে মিলিয়ে যাচ্ছে, ওটা কি ট্রেন? প্রশান্ত যেন বুঝতে পেরেও বুঝছে না... তার সুরটা যেন খুব মনে পড়ছে... আরে হ্যাঁ এটাই তো প্রবালের মোবাইলের কলার টিউন... একটা জুলু গানের সুর... আলোটা এগিয়ে আসছে... সে মারা যাবে... কিন্তু উঠতে পারছে না...
হঠাৎ প্রশান্ত 'ঝাঁপাও' বলে একটা আওয়াজ শুনল... কিছু একটা ঝটকা মেরে তাকে পাশের লাইনে নিয়ে ফেলল... তার আর মনে নেই।
হাস্পাতালে তার যখন জ্ঞান ফিরল তখন ন'টা বাজে। মাথায় অসহ্য যন্ত্রণা। তার অফিসের দু'জন কলিগ এসে গেছে। উদ্বিগ্ন মুখে তার দিকে তাকিয়ে। কথা বলতে কষ্ট হচ্ছে, তবু জিজ্ঞাসা করল, কি হয়েছে তার?
ওরা বলল, আরে এই মুখার্জীদার বাড়ি তো খড়দাতেই, তুমি ওই প্রবালের বাড়ির সামনের লাইনে পড়েছিলে অজ্ঞান হয়ে।
- প্রবাল কই? খুব কষ্টে জিজ্ঞাসা করল প্রশান্ত।
মুখার্জীদা বড়বড় চোখ করে বলল, প্রবাল? সে তো দু'বছর আগে ওই লাইনে কাটা পড়েই মারা গেছে!
(ছবি - সুমন)