Skip to main content


---
পায়জামার দড়িটা বাঁধতে বাঁধতে নিমাই চেয়ারটায় এসে বসল। জানলা দিয়ে রাস্তার আলো ঘরে এসে পড়েছে, সোকেসের উপর রাখা ঘড়িটায় দেখল পৌনে চারটে। বাইরে তুমুল জোরে বৃষ্টি হচ্ছে। ভাদ্রমাস। গুমোট ভাবটা ক'দিন ধরেই বেশ জ্বালাচ্ছিল। শান্তি। নিমাই মাথাটা ঘুরিয়ে দেখল জবা নিঃসাড়ে ঘুমাচ্ছে। মাথা থেকে পা পর্যন্ত চোখ বোলালো নিমাই। জবার গায়ে কিচ্ছু নেই। মাথা থেকে পা পর্যন্ত খোলা, তারই জন্য। নিমাইয়ের এভাবে ভাবতে ভালো লাগে। সে জানে পাশের কুঠুরিতে এই সময় চম্পা, তারপাশের কুঠুরিতে কাকলি... পিয়াসা... পারমিতা... সবাই উলঙ্গ এখন। পাশে শোয়া তাদের খদ্দের। সবার ঘরেই যায় নিমাই। সবার শীৎকারের আওয়াজই সে জানে।
নিমাইয়ের বয়েস চুয়াল্লিশ। নৈহাটিতে বিশাল মাছের আড়ত, পৈতৃক ব্যবসা। স্ত্রী সন্ধ্যা পক্ষাঘাতে বিছানায় আজ ছ'বছর হল। তাদের প্রেম করে বিয়ে। সন্ধ্যার বাবা বিপ্লবদেরও মাছের ব্যবসা, কাঁকিনাড়াতে। সেই কোন বাচ্চা বয়েস থেকে প্রেম তাদের। বিয়েও হয়েছিল যখন তখন সন্ধ্যার বয়েস কত হবে? আঠারোই হয়নি। তার একুশ। তারা নিঃসন্তান। সমস্যাটা ডাক্তার বলেছে তার, সন্ধ্যার নয়।
        নিমাই একটা বিড়ি ধরালো। জানলার কাছে গিয়ে দাঁড়ালো। আজ তার মেজাজটা ভীষণ ভালো। আজ সেটাই হয়েছে। নিমাই খেয়াল করেছে যে নারীর শরীরের সাথেই সে থাকুক, ভোগের চূড়ান্ত অন্তিম মুহূর্তে তার সন্ধ্যার মুখটাই মনে আসে। যেদিন আসে না সেদিন যেন সব বিষিয়ে যায়। যেদিন হয়, সেদিন হয়ে যাওয়ার পর সে যেন তার সমস্ত সত্তা দিয়ে সন্ধ্যাকে অনুভব করে। এই সময়টায় কেউ তার সাথে কথা বলে না। চম্পা মানত না। মার খেয়েছিল নিমাইয়ের হাতে কি সাংঘাতিক একদিন এই নিয়ে। দোষের মধ্যে সে বারবার তাকে জড়িয়ে ধরতে চেয়েছিল। নিমাই তাকে লাথি মেরে খাট থেকে ফেলে দু'গালে দুটো থাপ্পড় মেরে বেরিয়ে গিয়েছিল মাঝরাতেই। সারারাত নৈহাটি স্টেশানে বসেছিল। পরে রাগ কমলে সেদিনই চম্পার জন্য একটা নাকছাবি কিনে নিয়ে যায়। ওরই বা কি দোষ, সে কি বোঝে নিমাই কিসের জন্য এই পাড়ায় ছুটে ছুটে আসে, সে শুধু তার সন্ধ্যার জন্য। যে রাতে সে সন্ধ্যাকে পায় না, সেদিন সে কোনোমতেই বাড়ি ফেরে না। সন্ধ্যার মুখোমুখি হতে চায় না, অপরাধী লাগে, পাপী লাগে নিজেকে।
        নিমাই আবার চেয়ারে গিয়ে বসল। তার শরীর মন জুড়ে শুধুই সন্ধ্যা এখন। সন্ধ্যার চুলের গন্ধ, কোমরের ভাঁজ, মুখের টোল, ভুরুর গড়ন, ঠোঁটের রঙ, থাইয়ের ভাঁজ, নাভির গভীরতা... সে সব দেখতে পাচ্ছে। সন্ধ্যা অপলক দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে আছে। তাকে দেখছে। এই অন্ধকারের মধ্যে সে সন্ধ্যার নূপুরের আওয়াজ শুনতে পাচ্ছে, যেন সন্ধ্যার ঘন কালো চুলের অন্ধকারে সারাটা ঘর ঢাকা। এ রাতের অন্ধকার নয়, এ মেঘের অন্ধকার নয়। বাইরে বৃষ্টির আওয়াজটা হঠাৎ কেমন বদলে গেল। যেন সন্ধ্যার কান্না। এ জল যেন আকাশের না, এ সন্ধ্যার বুকের জমা কান্না। নিমাই অস্থির হয়ে উঠল। সন্ধ্যা কথা বলতে পারে না। তবে ওর শরীরেও তার মত জ্বালা, তার মত খিদে ধরে? তবে ডাক্তার যে বলে ওসব কিছু অনুভব করতে পারে না সন্ধ্যা এখন! মিথ্যা কথা। ডাক্তার শরীরের খবর জানতে পারে, মনের ভিতরের খবর সে জানবে কি করে? সেকি তার বইতে লেখা আছে? করেছে ঘর ডাক্তার সন্ধ্যার সাথে? সে খবর এ সংসারে কেউ যদি জানে সে শুধু নিমাই।
        নিমাইয়ের মাথা গরম হতে লাগল। তার সারা শরীর থেকে গরম হাওয়া বেরিয়ে যেন এই বর্ষার মেঘের সব জল বাষ্প করে তুলতে ঘর থেকে আকাশের দিকে উড়ে যেতে লাগল। নিমাই অশান্ত হয়ে উঠেছে। সে জবাকে কিছু না বলেই ঘর থেকে বেরিয়ে যাচ্ছিল। হঠাৎ কি মনে হল, ঘরে এসে আবার চাদরটা জবার গায়ে দিয়ে হনহন করে বেরিয়ে গেল।



---
খারাপ পাড়ায় আসাটা তার কাছে নতুন কিছু নয়, পাপের কিছু নয়। তাকে সবাই চেনে। নিমাইও নিজের পরিচয় গোপন করে না। তবু এই রাস্তাটার মোড়ে দাঁড়িয়ে তার আজ নিজেকে সব কিছু থেকে কিরকম বিচ্ছিন্ন লাগতে লাগল। মোবাইলটা অন্ করে দেখল সাড়ে পাঁচটা প্রায়। ভালোই বৃষ্টি হচ্ছে বলে রাস্তায় লোকজন তেমন নেই। আজ কারোর দিকে তাকাতে ইচ্ছা করছে না। তার মাথার মধ্যে সব কেমন জট পাকিয়ে যাচ্ছে। তবে কি সন্ধ্যার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে সে? তার ইচ্ছা সে আজ বলতে পারে না, তার শরীর অসাড়, তাই তার ভালো করতে গিয়ে কি তাকে দূরেই ঠেলেছে সে? তার কল্পনার সন্ধ্যাকে বাঁচাতে গিয়ে কি সে আসল সন্ধ্যাকে তিল তিল করে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিয়েছে?
        নিমাই রাস্তা বদলালো। গঙ্গার দিকে এগোতে লাগল। গঙ্গায় জোয়ার। নিমাই একটা টিকিট কেটে চূঁচুড়ার লঞ্চে চেপে বসল। কেন যাচ্ছে সে জানে না। তবু সে এখনই বাড়ি যেতে চায় না। তুমুল বৃষ্টি হচ্ছে। তার সাথে ঝোড়ো হাওয়া। লঞ্চটা ভীষণ দুলছে। নিমাই চুপ করে বসে। গঙ্গার দিকে তাকিয়ে। মাঝে মাঝে জবা, কাকলি, চম্পার নগ্ন শরীরগুলো চোখে ভেসে উঠছে। তার বিকার হয় অন্য সময়। এখন বমি পাচ্ছে। কাল রাতের মদ আর মাংসের ঢেকুর যেন এখন উঠছে। লঞ্চ চূঁচুড়ায় এসে ঠেকল। নিমাই বসে রইল। সব চেনা লোক, নিমাইকে কেউ কিছু বলল না। শুধু একবার বলাই এসে বলল, নিমাইদা চা খাবা? বলাই এই লঞ্চের মালিক। চম্পার কাস্টমার। নিমাই একটু হাসার চেষ্টা করে মাথা নাড়ল। বলাই ঘাঁটালো না আর। লঞ্চ আবার নৈহাটির দিকে এগোচ্ছে। নতুন যাত্রী। বলাই চালাচ্ছে। নিমাইয়ের কি মনে হল হঠাৎ উঠে গিয়ে বলাইয়ের পাশে দাঁড়ালো।
- তুই চম্পার কাছে কদ্দিন ধরে যাচ্ছিস?
        বলাই প্রথমটা ঘাবড়ে গিয়েও নিজেকে সামলে বলল, এই বছর চার, কেন গো? তুমি নেবে?
- কেন যাস?
        বলাই একটা নোংরা কথা বলল। অন্যদিন হলে নিমাই হাসত, এখন কিছু বলল না। গম্ভীর হয়ে বলল, রূপা জানে? রূপা বলাইয়ের বউ।
        বলাই উত্তর করল না।
        নিমাই বলল, ছাড় এসব।
        কিন্তু এসব কেন বলছে সে? তার কি মন দুর্বল হচ্ছে? সে কি বুড়ো হয়ে যাচ্ছে? নিজেকে ঠকালো তবে এতদিন? সাথে সন্ধ্যাকেও?



---
নিমাই যখন ঘরে এসে পৌঁছালো তখন দশটা বেজেছে সবে। এসেই স্নান করল। তাদের প্রতিষ্ঠিত কালী মন্দিরে গিয়ে প্রণাম করল। আজ শুধু মায়ের দিকে তাকালো না। সন্ধ্যার ঘরে এসে ঢুকলো। সন্ধ্যার পাশে তার মাথার কাছে বসল। তার ঠোঁটে একটা দীর্ঘ চুমু খেলো। নিমাইয়ের চোখের জল সন্ধ্যার গাল গড়িয়ে বিছানার চাদরে এসে পড়ল। সন্ধ্যা অপলক দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে। তার চোখের কোনায় জল।
        নিমাই আলমারী খুলল। সন্ধ্যার সব শাড়ি, সায়া, ব্লাউজ নীচে মেঝেতে ফেলতে লাগল। কি যেন খুঁজছে। হঠাৎ থামল। তার মুখ উদ্ভাসিত হয়ে উঠল। সে আলমারীর দরজাটা বন্ধ করে সন্ধ্যার দিকে ফিরল। তার হাতে ধরা তাদের বিয়ের বেনারসি। নিমাই ঘরের সব ক'টা দরজা জানলা বন্ধ করল। সন্ধ্যাকে নগ্ন করে, একটা ভিজে তোয়ালে দিয়ে সারা গা মুছিয়ে দিল। চুল আঁচড়ালো। তাকে বেণারসি পরিয়ে দিল। আবার আলমারী খুলল। সব গয়না বার করে তাকে সাজালো। একটা আয়না এনে সন্ধ্যার মুখের কাছে ধরল, বলল, দেখো তো ঠিক সেই দিনের মত লাগছে না?
        সন্ধ্যার ঠোঁটদুটো কেঁপে কেঁপে উঠল যেন, চোখের জল কোল ছাপিয়ে বিছানায়। নিমাই দুটো হাতে মুছিয়ে দিয়ে বলল, আর কেঁদো না। আমি এতদিন স্বার্থপরের মত শুধু নিজের মত করেই তোমায় চেয়েছি, তুমি কি চাও জানতে চেয়েছি কোনোদিন? নিমাই উঠল। নিজে ধুতি পাঞ্জাবী পরে এসে তার পাশে বসল। সন্ধ্যাকে জড়িয়ে ধরে শুলো। তাকে প্রচুর চুমু খেলো, আদর করল। তারপর তার মুখের কাছে মুখ এনে বলল, তোমার মন আর শরীরের মাঝে বিস্তর ফারাক গো আজ, আমি বুঝি। তুমি যা চাও তা পাও না। আমাকেও না। একটু সবুর করো।
        নিমাই ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। খানিক বাদেই ফিরে এলো, হাতে একটা বড় কেরোসিনের জার। নিজের পাঞ্জাবীটা খুলে সে সন্ধ্যার চোখের উপর রাখল। তারপর সন্ধ্যার সারাগায়ে তেল ঢালতে লাগল। বাকি তেল নিজের মাথার উপর থেকে ঢেলে স্নান করে গেল। তারপর সন্ধ্যাকে জড়িয়ে শুয়ে একেবারে ওর মুখের কাছে নিজের মুখ নিয়ে এলো। বলল, বেশি জ্বালা করবে না গো, এর থেকেও বেশি জ্বালা তুমি সহ্য করেছো আমার জন্য।


(ছবিঃ সুমন)