সাবির আলি চেয়ারের হাতলে ভর দিয়ে বাঁদিকে ঝুঁকে বসে আছে। মাথার উপর স্বচ্ছ টাকে পিছনের জানলার পর্দাটার ছায়া দুলছে। নীল সাদা চেক চেক শার্টে এখনও ঘামের দাগ শুকায়নি। রিডিং গ্লাসটা নাকের কাছে নেমে এসেছে। ডান হাতটা চেয়ারের বাইরে ঝুলে আছে। সাবির আলি পনেরো মিনিট হল মারা গেছে। অফিসের কেউ জানে না এখনও। আজ বনধের জন্য অফিসটা ফাঁকা ফাঁকাও। বাইরে বৃষ্টিও হচ্ছে তুমুল।
সাবির আলি এসির পাশে দাঁড়িয়ে নিজেকে দেখছে। নিজের শরীরটা দেখছে। অনেক নারী শরীর মনে পড়ছে, এই শরীরটার সাথে যোগাযোগ ছিল যাদের। তারা অনেকেই এখনও বেঁচে। সাবির আলি কাউকে ভালোবাসেনি। ভালোবাসা শব্দটা তার কাছে পানের ডিবের মত। পান মানে কাম। যতক্ষণ কামের ইচ্ছা ততক্ষণ ভালোবাসার উপর টান, সাবির বিশ্বাস করে পানের পিকের মত ভালোবাসার পিক এখানে ওখানে ছড়িয়ে থাকে। সাবিরের অনেক সন্তান পানের পিকের মত। সাবির শরীরটার কাছে গিয়ে দাঁড়ালো। জামার বোতামটা খুলে বুকে হাত দিল, ভেজা এখনও ঘামে। প্যাণ্টের চেনটা খুলে পুরুষাঙ্গটা হাতে নিল, ঠাণ্ডা, অণ্ডকোষটায় হাত রাখল, ঠাণ্ডা। সারা শরীরটাই ঠাণ্ডা। সাবির সামনের একটা চেয়ার টেনে নিয়ে বসল। তার শরীরটার পিছনে পর্দাটা উড়লেই বাইরে বৃষ্টির ধারা দেখা যাচ্ছে। সাবির একটা গান মনে করতে চেষ্টা করল। সে এখন গান গাইবে। তার দু'জন মেয়েমানুষ গান গাইতে পারত। তাদের একজনকে সাবির নিজের হাতে গলা টিপে মেরে ফেলেছে, সে অন্য খদ্দের রেখেছিল। তার দোষ অন্য খদ্দের রাখাতে না, তাকে না জানিয়ে রেখেছিল, সেটা। এটা ভালোবাসা না, এটা পুরুষত্ব, সাবিরের পুরুষত্বে অনেক কিছু লাগত। সেই মেয়েমানুষটা কোথায় এখন? সাবির ভয় পেলো না, একটা সঙ্কোচ হল, পুরুষত্বের সঙ্কোচ, কারণ এখন তার লিঙ্গ, অণ্ডকোষ ঠাণ্ডা।
হঠাৎ সামনের ক্যালেণ্ডারটা ধুপ করে নীচে পড়ে গেল। রুবেয়া!
রুবেয়া সেই বেশ্যা, যাকে আলি নিজের হাতে গলা টিপে মেরেছিল। সে আলির সামনে এসে দাঁড়িয়ে বলল, দেখ, এখনও দাগটা মেলায়নি, দেখ!
আলি দু'হাত পিছিয়ে এলো। তার পায়ে লেগে চেয়ারটা গড়িয়ে একটু সরে গিয়ে আলমারিতে ধাক্কা লেগে আওয়াজ হল, ধুপ।
রুবেয়া সেদিকে তাকিয়ে বলল, বলুন জনাব, আজ কেয়া ফরমায়িস হ্যায় আপকা?
সাবির স্থির দৃষ্টিতে রুবেয়ার দিকে তাকালো, একটা মানুষ মরলেও এত সুন্দর দেখায়! রুবেয়া এ দৃষ্টি চেনে। সে সাবির আলির মৃতদেহের কাছে গিয়ে দেখল প্যাণ্টের চেনটা খোলা, পুরুষাঙ্গটা বাইরেই বার করা। রুবেয়া হাতে নিয়ে বলল, ছিঃ, এতো পুরো ঝিমানো... আজ খেলা হবে না তবে?! বলে রুবেয়া চীৎকার করে হাসল। যেন একটা যাত্রাপালা হচ্ছে। সাবিরের ছোটোবেলায় যাত্রা দেখতে যাওয়ার কথা মনে পড়ল। তখন সে ছোটো, ওপার বাংলায় থাকে। সাবিরের অপমান লাগছে। এই প্রথম অন্যরকম একটা অপমান লাগছে। এই অপমানটাকে সারা জীবন ভয় করে এসেছে, তার পুরুষত্বের অপমান, আজ তাই হচ্ছে। তার সামনে উলঙ্গ রুবেয়া, কিন্তু যেন একটা গাছের মত সুন্দর, একটা নদীর মত সুন্দর, শিউলি পড়ে থাকা উঠোনের মত সুন্দর। অথচ এই সৌন্দর্যকে সে ভিতরে নিতে পারে না। শেখেনি কোনোদিন। প্রথম প্রথম আসত, সদ্য যখন কৈশোরে। তখন সে কবিতাও লিখেছে, গান লিখেছে, কিন্তু তার সামনে যখন তার দিদিকে ধর্ষণ করে যায়... তারা মসজিদ থেকে ফিরছিল, গ্রামের রাস্তা, কয়েকজন এসে রাস্তা আটকে দাঁড়ালো, তার দিদিকে টেনে ঝোপে নিয়ে গেল... সে বাধা দিতে চেয়েছিল, কিন্তু মাথার পিছনে একটা কিছু ভারি আঘাতের পর তার কিছু মনে ছিল না। জ্ঞান ফেরার পর দিদিকে দেখেছিল বিছানায়, বাড়ি থমথমে। তার দু'দিন পর দিদি গলায় দড়ি দিল, ওড়না দিয়ে, যে ওড়নাটা দিয়ে তার দিদি তাকে দুটো গাছের মাঝখানে বেঁধে দোল খাওয়াতো। তখন থেকে সে জানে প্রেমের কবিতা লেখে হিজড়ারা। কেন এরকম মনে হয়েছিল সে জানে না।
রুবেয়া তার দিকে তাকিয়ে তার সামনে দাঁড়িয়ে। আরেকটু দূরে তার দিদি, আয়েষা। চুপ করে তার মুখের দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে দু'জনে। দু'জনেই নগ্ন। দু'জনের গলাতেই দাগ, একটা তার হাতের, আরেকটা দড়ির।
কেউ ধাক্কা দিচ্ছে, স্যার... স্যার...
সাবির আলি ধড়ফড় করে উঠল... মুখের থেকে লাল মুছে মাথা উঁচু করে তাকাতে গিয়ে চশমাটা কোলে পড়ে গেল, আবছা মনে হল দাসবাবু দাঁড়িয়ে তার চোখের সামনে। চশমাটা কোল থেকে তুলে চোখে দিয়ে দেখল দাসবাবুর হাতে জলের গ্লাস, বাঁদিকে তাকিয়ে দেখল ক্যালেণ্ডারটা মাটিতে পড়ে আছে। চেয়ারটা আলমারির গায়ের সাথে লাগানো, চমকে নীচে প্যান্টের দিকে তাকালো...