Skip to main content
||১||
 
ওরা চলে যাওয়ার পরেও অনেকক্ষণ ধরে ভদ্রমহিলা বাইরের গেটের কাছে দাঁড়িয়ে রইলেন। বাচ্চাগুলো খেলতে যাচ্ছে। একজন বাচ্চা বলল, "ও ঠাকুমা, নানুকাকান চলে গেল হায়দ্রাবাদ? আবার পরের পুজোয় আসবে?"
ভদ্রমহিলা হেসে মাথা নাড়লেন। খেলতে চলে গেল বাচ্চাগুলো। আরতির মা (লোকের বাড়ি কাজ করে) পাশ দিয়ে যাচ্ছিল, বলল, "মাসিমা ছেলে নাতি সব চলে গেল? তুমি যে কেন ওদের সাথে চলে যাও না.... মেশোমশাই থাকলেও যে না কথা ছিল...."
ভদ্রমহিলা বাইরের গেট লাগিয়ে বারান্দার গ্রীলের দরজাটা টানতে যাবেন, পাশের বাড়ির ব্রজদা, তাঁর স্বামীর সমবয়সী প্রায়। দাঁড়ালেন রাস্তায়, "কি রমা? ওরা চলে গেল... কেউ আর থাকে না আমাদের জন্য... আমরা বাতিল... লোকেশটাও (ওনার স্বামী) যে কেন এত তাড়াতাড়ি চলে গেল... তুমিও আর শ্বশুরের ভিটে ছেড়ে গেলে না.... অবশ্য যা বউমা তোমার..."
ভদ্রমহিলা গ্রীলটা আটকে ভিতরে আসলেন। সোফার উপরে একটা মোজা পড়ে নাতিটার। আরেকটা ছিঁড়ে গেছে বলে এটা আর নিল না। সন্ধ্যে হয়ে আসছে। ঘরের আলোগুলো জ্বালতে হবে। সন্ধ্যে দিতে হবে। ইলা আসবে না আজ। কিছু বাসন মেজে নিতে হবে। সিঙ্কে রাখা আছে। উনি সোফার এক কোণে বসে আছেন। কোলের উপর হাতদুটো রাখা। হাতদুটোতে শাঁখা থাকে না। কিন্তু ছোঁয়াটা যেন আছেই মনে হয়। লোকেশ তাঁর হাতের উপর হাত না রেখে শুতো না। তাই তিনি এখনো লোকেশের কোলবালিশটার নীচে হাত রেখে শুয়ে থাকেন।
বাঁ হাতের কনুইয়ের নীচে একটা লাল আঁচিল আছে। সেইটা লোকেশ চুমু খেত মাঝে মাঝে, বলত, বিউটি স্পট। ভদ্রমহিলা ডান হাতের তর্জনী দিয়ে আঁচিলটা ছুলেন। 
লোকেশ আর তিনি কোনোদিন কণ্ডোম ব্যবহার করেননি। দরকার হত না। দু'চক্ষে দেখতে পারতেন না রমা কণ্ডোম। কেন মানুষের সংযম বলে কিছু থাকতে নেই?
আচ্ছা লোকেশও তো তাই বলত। তবে?
লোকেশকে চাকরিসূত্রে তিন বছর বাইরে থাকতে হয়েছিল। জার্মানি আর আমেরিকায়। ফেরার পর থেকেই শরীরটা খারাপ হচ্ছিল বারবার। তখন রমারা বম্বেতে থাকে। এই মধ্যমগ্রামের পৈতৃক ভিটেতে কদাচিৎ আসত তারা। লোকেশের বারবার পেট খারাপ, জ্বর সর্দিকাশি লেগেই থাকত। ওজন কমছিল। 
তারপর হাসপাতালে ভরতি করতে হল। কিছুতেই ধরা পড়ছিল না কি রোগ। তারপর ডাক্তার আগরওয়ালের কেমন সন্দেহ হল। রোগ ধরা পড়ল। এইডস।
 
এখানে সবাই জানে লিভার ক্যান্সারে মারা গিয়েছিল তার স্বামী। তিনি বেশি কথা বলেন না। তবে একদিন হঠাৎ ইলাকে জিজ্ঞাসা করে ফেলেছিলেন, "হ্যাঁ রে ইলা, তোরা কণ্ডোম ব্যবহার করিস?" 
ইলা লজ্জা পেয়ে বলেছিল, "কি যে বলো না মাসী?"
তিনিও লজ্জা পেয়েছিলেন। তবে ততটা না। ডাক্তার বলেছিল লোকেশকে নাকি, কণ্ডোম ব্যবহার করলে জীবাণুটা ঢুকত না। 
"হ্যাঁ রে কণ্ডোম কি খুব দামী?" আবার জিজ্ঞাসা করেন ইলাকে। 
ইলা একটু সন্দেহের চোখে তাঁর দিকে তাকায়। উনি তাড়াতাড়ি বলেন, "না তা হলে তোকে মাইনের সাথে দিতাম টাকাটা। যা সব রোগ শুনি টিভিতে, কাগজে... শুনিসনি? এইডস না কি সব? মানুষ বাঁচে না রে ওতে!"
গলার কাছটা ধরে এলো রমাদেবীর। কেন এমন হল? ওর ব্যভিচারিতার পাপে না অজ্ঞানতায়? পুরুষ মানুষ, অদ্দিন একা, হতেই পারে। তিনি সাথে যেতে পারতেন, কিন্তু নানুকে একা কার কাছে রেখে যেতেন? ওর তখন ইঞ্জিনিয়ারিং ফাইনাল ইয়ার। না কি সেদিন একটা কণ্ডোম থাকলে আজ....
হঠাৎ কলিংবেল বাজল। "দিদা দিদা..." কে ডাকছে?... গাবলুর গলা না!... তাদের পাশের বাড়ি থাকে। 
রমাদেবী তাড়াতাড়ি উঠে দরজা খুললেন। গাবলু ঝাঁপিয়ে পড়ে বলল, "শীগগির বরফ দাও... লালটুর মাথা ফুলে ইয়াব্বড় আলু হয়ে গেছে.... বাড়িতে জানলে কিমা করে দেবে ওর মা ওকে... জানো তো ওর মাকে গত বছর ওদের বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিয়েছে, ওর বাবা এইডসে মারা গেছে বলে... কেউ নেই ওদের..."
রমাদেবী বললেন, "তুই ওকে ঘরে নিয়ে আয়।"
গাবলু বড়বড় চোখ করে বলল, "কিন্তু ওর গাল ফেটে রক্ত বেরোচ্ছে যে!"
রমাদেবী বিস্মিত হয়ে বললেন, "তো?"
গাবলু বলল, "আমার মা বলেছে ওর রক্তে বিষপোকা আছে... তাই ওর সাথে না খেলতে... কিন্তু কি ভালো বল করে জানো... ওকে না..."
রমাদেবী তাড়াতাড়ি ওকে থামিয়ে বললেন, "তুই নিয়ে আয় ওকে... বিষপোকা মারার ওষুধ আছে আমার কাছে।"
গাবলু তাও ইতস্তত করছে দেখে বললেন, "নিয়ে আয়, তোকে আর ওকে ডাবল ডিমের অমলেট দেব..."
গাবলুর মুখটা জ্বলজ্বল করে উঠল। বলল, "ঠিক আছে আনছি ওকে, তুমি মাকে বলবে না তো?"
রমাদেবী হাসলেন। বললেন, "না বলব না।"
ভিতরে গিয়ে সব ঘরে আলো জ্বাললেন। মনে মনে বললেন, বড্ড অন্ধকার চারদিকে।
 
||২||
 
ক'টা বাজে? অনিল মোবাইল অন্ করে ঘড়ি দেখল। সাড়ে তিনটে। নার্সিং হোমে রাত কাটানোটা অভ্যেস হয়ে গেছে তার প্রায়। অনিল সমকামী। গত বছর ধরা পড়ে তার রক্ত আছে বিষাক্ত জীবাণু - এইডস। 
জানলা দিয়ে স্ট্রীট লাইটের আলো আসছে। অনিলের বয়েস আটত্রিশ। মা নেই। বাবা সব জানার পর যোগাযোগ করা ছেড়ে দিয়েছেন। "অমন পাপ করলে ওই রকম পরিণামই হবে, আমার ছেলে গে!! ছিঃ ছিঃ "... অনিল প্রতিবাদ করেনি। শুধু বলেছিল, "তবে তোমার চোখে যারা নরমাল তাদের হয় কেন?" ওর বাবা উত্তর দেননি। এটাই স্বাভাবিক অবশ্য। অনিলের পাশে অবশ্য ওর দিদি জামাইবাবু আছে।
অনিল হরিদ্বারে একটা বড় ট্যুরিজম এ কাজ করত। ম্যানেজার ছিল। ভালো মাইনে। পবনের সাথে পরিচয় মুসৌরিতে। মিলিটারিতে ছিল। এত সারাজীবনে কাউকে ভালোবাসেনি অনিল, যা ওকে বেসেছিল। দুর্দান্ত পার্সোনালিটিও ছিল। বিভিন্ন জায়গায় মিট করত ওরা। বেশিরভাগই কোনো হিল স্টেশানে। কারণ পবনের পাহাড় খুব প্রিয়। 
দু'বছর আগে পবনের কাছ থেকে একটা টেলিগ্রাম পায় ও - "I GOT HIV POSITIVE, PLEASE GO FOR TEST, WE HAVE DONE MANY TIMES UNPROTECTED" 
টেলিগ্রামটা পেয়েই অনিলের শিরদাঁড়া বেয়ে একটা হিমেল স্রোত নেমে যায়। পায়ের তলা থেকে যেন মাটি সরে যায়। প্রথমে ভাবে এপ্রিল ফুল করছে। ক্যালেন্ডারের ডেট জেনেও ক্যালেন্ডারের সামনে এসে দাঁড়ায়। পঁচিশে মে। পবন মারা যায় পরের বছর তেইশে সেপ্টেম্বর। ততক্ষণে অনিল জেনে গেছে, ওকেও প্রস্তত হতে হবে। কারণ ওর শরীরেও পবনের জীবাণু। সন্তানের মত। 
অনিলের ঘাম হচ্ছে। ভাবল একবার সিস্টারকে ডাকে। টয়লেটে যাবে। উঠল। পায়খানা পাচ্ছে। কমোডে বসল। 
পবন বারবার বলত, "কণ্ডোম ইউজ করনে দে ইয়ার...." অনিল শোনেনি। সে রাবারী প্রেম চায়নি। আচ্ছা এইডস নিয়ে এত আলোচনা কেন? কারণটা কি যৌনতার গন্ধ আছে বলে? নাকি সে সব চাইতে নিবিড় সুখের মুহুর্তে আক্রমণ করে বলে? সচেতন থেকে ভালোবাসতে হবে? এ কি করে সম্ভব? ফ্ল্যাশ করতে গিয়ে থমকে দাঁড়ায় কিছুক্ষণ। আজকে ব্লাডের পরিমাণটা বেশি না? 
ভোর হচ্ছে। হাল্কা আলো টয়লেটের কাঁচে রিফ্লেক্ট করছে। অনিলের কান্না পেল। যেন সে পবনের শ্বাসের স্পর্শ পাচ্ছে তার সারা মুখের প্রতিটা রোমকূপে। মনে মনে বলল, "I am coming dear... Please wait a little bit for me...."
 
 
দিদি আজ সিমলা যাওয়ার টিকিট নিয়ে আসবে। সে পাহাড়ে মরতে চায়। দিদিকে বলেছে। দিদিকে অনেক কষ্টে রাজী করিয়েছে। অনিল আয়নায় একবার নিজেকে দেখল, কি চেহারা হয়েছে তার!!! পবনের কেমন লাগবে তাকে এই চেহারায় দেখলে... হঠাৎ হেসে ফেলল, কি ননসেন্স... they are going to burn this yaar!! lets celebrate this last scene yaar... living with your hiv dear... coming... coming....
অনিলের ডাক্তার বলেছিলেন হার্টফেল। বাথরুমেই নার্স দেখেছিল। রীতা অনিলের ছাই নিয়ে সিমলা না, মুসৌরিতে এসে উঠল। হোটেল টিম্বার, রুম নাম্বার ৩০৪, এই ঘরেই নাকি ওরা প্রথম ডেট করেছিল। পরের দিন কেম্পটি ফলসে গিয়ে ছাইটা ভাসিয়ে দেবে। সেখানেই নাকি প্রথম প্রোপোজ করেছিল পবন ওকে।
 
(আজ বিশ্ব এইডস দিবস)