Skip to main content

কফিশপের বাইরে অন্ধকার। ঝড়ে গাছ পড়ে তার ছিঁড়ে গেছে। কফির অর্ডার দিয়ে পারমিতা রাস্তায় এসে দাঁড়ালো, সুছন্দা রীতিমতো ফুঁসছে। এ সময়টা হয় এরকম। পারমিতা জানে।

পারমিতার থেকে সুছন্দা বারো বছরের ছোটো। সুছন্দার ক্লাস টুয়েলভ। পারমিতার কাছে টিউশান পড়ে। নিউট্রিশান।

কিরে আগের দিনের মত কড়া কফিই বললাম, চিনি কম.. চলবে তো?

সুছন্দা তাকালো। চশমার উপর সামনের দোকানের সাদা আলোটা পড়ল। জেনারেটারের আলো। বেশি জোরালো নয়। সুছন্দা নিজের মধ্যে নেই। ফোনটা নিয়ে ঘাঁটছে, আবার জিন্সের পকেটে ঢোকাচ্ছে। ইতস্তত পায়চারি করছে। ওর ব্যবহার লোকের চোখে পড়ছে, ও বুঝতে পারছে কি? পারলেও ওর এখন এ সব ভাবার সময় নেই…..

========

পারমিতা চুপ করে পাশে দাঁড়ালো এসে। সুছন্দার অস্বস্তিটা দেখে নিজের ওই বয়েসটা মনে পড়ছে। তখন কথায় কথায় মনে হত পায়ের তলার মাটি সরে যাচ্ছে.. সব অন্ধকার হয়ে যাচ্ছে…. চারদিক সব অর্থহীন… শূন্য মনে হত…. এক এক সময় মনে হয় বাবা ওরকম আচমকা চলে না গেলে হয় তো আজকের এই পারমিতা হত না। বাবা চলে গেলেন ফার্স্ট ইয়ারে। ম্যাসিভ হার্ট অ্যাটাক। এখনও মনে পড়ে ভোরটা। মহালয়ার দিন ছিল। সে বরাবরই ঘুম কাতুরে, মা দুবার ডেকে গেছে… রেডিও অন্‌… ভাই টিভি চালিয়ে দিয়েছে জোরে… ভাই তখন এইটে… মা আবার এলেন… দেখ বাবা কেমন করছে…. তাড়াতাড়ি আয়….

দু’ঘন্টার মধ্যে সব শেষ। হাসপাতালে ডাক্তার যখন বলছে… বিশ্বাস হচ্ছে না… তার সঙ্গে এরকম ঘটার তো কথা না…. কালীপুজোর পরেরদিন তো শিলং যাওয়ার কথা…. ট্রেনের টিকিট বুকড্‌…. তবে?    

কফি…..

পারমিতা এগিয়ে গিয়ে কফির কাপ দুটো নিয়ে এলো। সুছন্দার হাতে একটা কাপ দিয়ে বলল, সাবধানে ধরিস….

প্রশান্ত…. পারমিতার সঙ্গেই পড়ত….. পারমিতা নৈহাটি স্টেশানে দাঁড়িয়ে… কিসে হবে… ক্লাস টুয়েলভই হবে…. প্রশান্ত দেখা করল দু নাম্বার প্ল্যাটফর্মে…. এটা সেটার পর ইনিয়েবিনিয়ে বলল, ওর বাবার ট্রান্সফার হয়ে গেছে…. আদ্রা… ও রিলেশানটা রাখতে চায় না…. ডিস্ট্যান্স রিলেশানশিপে বিশ্বাস নেই ওর….

প্রশান্ত চলে গেল। কি অনায়াসে চলে গেল। কথা বলতে বলতে কখন ওরা ওভারব্রীজে দাঁড়িয়েছে মনে নেই পারমিতার। তার সারা গা ঠাণ্ডা হয়ে গেছে। হাতের তলা, পায়ের তলা হিম ঠাণ্ডা। প্রশান্ত সিঁড়ি দিয়ে নেমে যাচ্ছে, আপ কৃষ্ণনগরটা ধরবে…. কল্যাণী বাড়ি…. পারমিতার কাঁচরাপাড়ায়… কি সুন্দর লাগছে দেখতে প্রশান্তকে…. নীল টি-শার্ট আর একটা কালো জিন্স পরে এসেছিল…. লাফিয়ে লাফিয়ে নামছে… অথচ পারমিতা নড়তেই পারছে না…. মাথাটা ঘুরছে…. পাশে কত কথা… সব অনর্থক লাগছে…. সূর্য ডুবছে… গরম লাগছে… গুমোট গরম…. ঈশানীদির কাছে কেমিস্ট্রি পড়া… নৈহাটিতেই…. আর আধঘন্টা বাদে ক্লাস শুরু হবে… আজ টেস্ট নেবে…. সব হবে…. পারমিতা শুধু নড়তে পারছে না।

ধীরে ধীরে সিঁড়ি ধরে ধরে নামল আবার দু নাম্বার প্ল্যাটফর্মে। চুপ করে দাঁড়িয়ে। সন্ধ্যা হয়ে যাচ্ছে। প্ল্যাটফর্মে আলোগুলো জ্বলছে এক এক করে…. প্রশান্ত যখন থাকত পাশে প্ল্যাটফর্মে… তার হাতটা ধরে…এই আলো… এই রেললাইন… এই স্টেশান… লোকজন… সব কেমন গায়ে গায়ে লেগে থাকত… সব কিছুর মধ্যে একটা যোগাযোগ থাকত…. এখন সব আছে…. কিন্তু তার থেকে ছেড়ে গেছে…. প্রশান্তর ঘামের গন্ধ…. পাতলা গোঁফের নীচে হাসি…. ওর ছটফটে ভাব… গোটা জীবনটাই তো ওর ছিল.. সবটা.. এখন নিজেকে নিয়ে কি করবে পারমিতা? কি করবে? শুয়ে পড়বে লাইনে? বিষ খাবে?.... বুকের ভেতরটা কি ফাঁকা…. নিজের জন্য কি এতটুকু ভালোবাসা বাঁচিয়ে রাখেনি সে…. যাতে অন্তত বাড়ি অবধি যেতে পারে….

========

প্রশান্ত এখন স্কুল টিচার। দু-একবার দেখা হয়েছে। কি মোটা হয়েছে। বিয়ে করেছে। একটা মেয়ে আছে। এখন প্রশান্তকে দেখলে কষ্ট হয়… নিজের জন্য…. কি সাধারণ মানুষ প্রশান্ত… কি সাধারণ… অথচ ওর প্রতিটা চালচলনে অসামান্য কিছু খুঁজে পেত সে… মানুষ কি অন্ধ হতে পারে! প্রশান্তর বউকে দেখে আরো মনে হয়েছিল… কি ভীষণ সাধারণ…. রান্নার গল্প…. সিনেমার গল্প…. উফ্‌…. কিচ্ছু পড়ে না…. কোনো বিষয়ে উৎসাহ নেই…. ভীষণ ডমিনেটিং….মেয়েকে আর বরকে এক মুহূর্ত কাছ ছাড়া করছিল না…. প্রশান্ত’র আচরণ দেখেও অবাক হচ্ছিল… এর জন্য এত কিছু!.....

=======

সুছন্দা বলল, এতটা কি করে পারে মানুষ? এতটা… বন্ধুদের সঙ্গে যাচ্ছে যাক… একবারও বলবে না যে প্ল্যানটা গত দু’মাসের…. আমাকে বলল, এত অবসেসড হলে নাকি এই রিলেশানটা রাখাই যাবে না…. মুখের উপর বলে দিল… জাস্ট মুখের উপর…. দেখো ফোনও সুইচ অফ্‌…. আশ্চর্য….

অনির্বাণ। থার্ড ইয়ার। জিওগ্রাফি অনার্স। বন্ধুদের সঙ্গে নর্থবেঙ্গল যাচ্ছে। বলেছে আচমকা ঠিক হয়েছে। আসলে টিকিট কাটা হয়েছে দু’মাস আগে। সুছন্দা ক্রস করতে বলেছে গতমাসের প্ল্যান… জানানো হয়নি…. তাও সত্যিটা বলেনি দু’মাস আগের প্ল্যান ছিল…. সুছন্দার মনে হচ্ছে ও দু’নৌকায় পা দিয়ে চলছে। মিমি…. সেকেন্ড ইয়ার… জুলজি। সে-ই নাকি সন্দেহের তালিকায়। সুছন্দা দেখেছে অনির্বাণের ইনস্টার সব ছবিতে রিয়্যাক্ট করে… কমেন্টস করে… সব সময় লাভ ইমোজিতে…. ইদানীং চুমুর ইমোজি…. অনির্বাণ বলে মেয়েটার নাকি ওরকম ফ্লার্ট করা স্বভাব… কিন্তু বাই হার্ট খুব ভালো মেয়ে… এত জেলাস হওয়া ভালো না…..

পারমিতা জানে সুছন্দার বিঁধছে কোথায়। ইগোতে। ইম্ম্যাচুওর ইগো। বড় স্পর্শকাতর। একটু টোকাতেই টাল সামলাতে পারে না।… উণ্ডেড ইগো।

তুই একটা মেসেজ করে রাখ

কি লিখব? সাহস থাকে সামনাসামনি বলুক যে আমি মিমির সঙ্গে আছি… আমাদের মধ্যে কিছু নেই আর…. আমি কি হাতেপায়ে ধরব? আমি সেরকম মেয়ে?.....

পারমিতা কফিতে চুমুক দিল। সুছন্দার মত এতটা ইমপালসিভ ছিল কি সে? আরো দশ বছর পর কোথায় দাঁড়াবে সে নিজে? অনেক কিছু বদলে গেছে লাইফে। দৃষ্টিকোণটাই বদলে গেছে। বিয়ের কথা ভাবতেই পারে না। মা আছেন। ভাই বাইরে। আইটিতে। সামনের বছরে বিয়ে। পারমিতার এগুলো খুব বোকাবোকা লাগে এখন। সুছন্দা দশ বছর পর কি করবে? এত প্যাম্পার্ড…. সেকি বড্ড জাজমেন্টাল হয়ে যাচ্ছে? আসলে জীবনের কোনো মানেই আজকাল স্পষ্ট নয়…. যত দিন যাচ্ছে সব বাঁধাধরা হিসাব, নিয়ম সব কিছুই অস্বচ্ছ মিনিংলেস হয়ে যাচ্ছে…. এখন প্রতি মুহূর্তকে আগের মুহূর্ত থেকে বাঁচিয়ে আলাদা করে বাঁচাটাই চ্যালেঞ্জ… নাকি সব মুহূর্তই আসলে এক রকম… মুডের সঙ্গে সঙ্গে সব চেঞ্জ হয়ে যায়….

======

ফোন করছে…. দাঁড়াও… আমি কথা বলে আসি…..

পারমিতা ‘হ্যাঁ’ বা ‘না’ বলার আগেই চলে গেল…. কাপটা শপে দিয়ে সামনের গলিতে ঢুকে গেল…. শরীরটা শক্ত করে রেখেছে…. আরো লড়াইয়ের প্রস্তুতি…. অনেক অভিমান জমে…. পারমিতা একটা সিগারেট ধরিয়ে রাস্তার কোণে এসে দাঁড়ালো…. এখনও মেয়েরা সিগারেট খেলে ছেলেরা কেউ কেউ অবাক হয়ে তাকায়…. সোশ্যাল ফ্রেম…. কি যে ঢপের জিনিস…

======

আধঘন্টা হল। আবার ঝিরিঝিরি বৃষ্টি শুরু হল। সুছন্দা কাঁদছে। বারবার চোখ মুছছে। শরীরটা শিথিল হয়েছে। সমর্পণ?

আজকাল কান্না আসে না পারমিতার। আর আসে যখন তোড়ে আসে… কেন আসে বোঝে না…. নিজেকে ডিপ্রাইভড ভাবার প্রিভিলেজ তার আছে…. অল্প বয়সে বাপ মরা… ভাইকে মানুষ করতে তাড়াতাড়ি চাকরিতে ঢোকা…. পছন্দের মানুষের সঙ্গে বিয়ে না হওয়া… মায়ের নিজের স্বার্থের দিকে তাকিয়ে তার অবিবাহিত থাকার সিদ্ধান্তকে সম্মতি জানানো… যদিও বাইরে কপট রাগ দেখায়… কোনো ছেলে ফোন করলেই বারবার জিজ্ঞাসা করে… কে রে? কে?.... চোখেমুখে একটা ইনসিকিউরিটি দেখেছে… স্বাভাবিক… বাবা কতটা স্বাধীনতা দিত মা-কে? পারমিতা দেয়…. মায়ের জন্য ভালোবাসায় সবটা না… নিজের জন্য স্পেস চাই বলে….. পেয়েছে….

নিজেকে বঞ্চিত ভাবার প্রিভিলেজ একবার ইউজ করতে শুরু করলে নেশা লেগে যায়…. সারাটা জীবন কুয়াশা ঘেরা তখন। পারমিতা নিজেকে সে প্রশ্রয় দেয়নি। সে নিজেকে ডিপ্রাইভড ভাবায় না, বলে আমি ডিফারেন্ট…  দ্যটস্‌ অল… ডিফারেন্সের সংজ্ঞা খোঁজে না। জীবনে সব কিছু খুঁজতে নেই।

=====

সুছন্দা আসছে…. মুখ দেখে বোঝা যাচ্ছে ঝড় কেটে গেছে…. হাঁটায় আবার সেই মোহিনী চাল… আরোপ করা… এ স্বাভাবিক নয়…. ও নিজেও জানে।

দিদি আরেক কাপ কফি খাওয়াবে গো… তখন ঠিক এঞ্জয় করতে পারিনি….

পারমিতার ভীষণ মায়া লাগল মেয়েটার মুখটা দেখে। ওর মুখের আড়ালে নিজের ছোটোবেলার ইনোসেন্ট মুখটার ছায়াও দেখল। তার কাছে আশ্রয় চাইছে। তার পোড় খাওয়া মনের কাছে আশ্রয় চাইছে তার নিজেরই ছোটোবেলা…. ক্ষতবিক্ষত… সরল… নির্দোষ ছোটোবেলা… নির্দোষ থাকার মত দোষ সংসারে আর কি আছে? ওতে মরাল ইমিউনিটি কমে….

যা… নিজে গিয়ে অর্ডার দে…. আর বলবি এবারে চিনিটা একটু বেশি দিতে…. কেক খাবি?

সুছন্দা অর্ডার দিয়ে এসে বলল, আমিই ওভার রিয়্যাক্ট করছিলাম জানো….. সরি বললাম… সব ঠিক আছে… মিমি মেয়েটাই ওরকম… আরো অনেকেই প্রোফাইলে একই জিনিস করে বেড়ায়…..

মায়া লাগছে পারমিতার। ভীষণ মায়া। মেয়েটা বিষগাছ বুনছে। নিজের জমিতে, নিজের বোকামিতে। জমি ছেড়ে দিচ্ছে অল্প অল্প করে। সুখ বুনে দেবে কেউ, সেই আশায়। কি বোকা মানুষ! কি বোকা এই বিশ্বাস…. এই সরলতা….

পারমিতা বলল, যা করিস… বুঝেশুনে….

সুছন্দা মাথা নাড়ল। বিশ্বাস করল না। করবেও না। এই বয়সে সবাই বিশ্বাস করে সে শুধু সুখী হতেই জন্মেছে। করুক। ক’দিনই বা…. জীবন সব শিখিয়ে দেয়…. শুধু জীবনের হাতটা ছাড়তে নেই….

দিদি কফি… বেশি চিনি দিয়ে….