Skip to main content

maa

 

স্বামী অব্জজানন্দজী লিখছেন, এক পুত্র সন্তান, কলেজ থেকে টেলিগ্রাম পেয়ে ছুটে গেলেন হাস্পাতালে। মায়ের প্রাণহীন দগ্ধ দেহ পড়ে আছে। রান্না করতে গিয়ে আগুন লেগে যায় কাপড়ে। সেই থেকেই।

অকালে মা চলে গেলে গোটা পরিবারে অন্ধকার নেমে আসে। কয়েকটা শেকল আপনিই খুলে যায়। যার অভিজ্ঞতা আছে, সে-ই জানে, এ হয়।

তারও একই ঘটনা ঘটল জীবনে। এরপর কলেজ জীবন শেষ করে কর্মজীবনে প্রবেশের সময়। তার জীবনে সব বাইরে থেকে আপাতভাবে ঠিক থাকলেও ভিতরে গভীর শূন্যতা। মায়ের একটা ছবিও নেই। আগেকার দিনে তাই তো হত। ছবি থাকাটাই এক ভাগ্য। আর বিশেষ করে বাড়ির বউদের তো আরো।

একদিন কয়েকজন বন্ধু মিলে বেলুড়মঠে এসেছে। বেড়াচ্ছে সবাই। হাসাহাসি, ঠাট্টা ইয়ার্কি হচ্ছে। ফেরার সময়, কয়েকজন বন্ধু মায়ের মন্দিরের সামনে এসে দাঁড়ালো। জুতো খুলে মন্দিরের বারান্দায় উঠে হাতজোড় করে দাঁড়ালো। আর সে?

সে না তো বারান্দায় উঠল, না তো হাতজোড় করে দাঁড়ালো। সে ওই গঙ্গার সামনে চাতাল থেকেই মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে, তার গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে জল। এ তো তার মায়েরই ছবি! অবিকল! সেই হাত, পা, মুখ সব!

তিনি পরে সন্ন্যাসী হয়েছিলেন।

আরেকটা ঘটনা লিখছেন। তখন উত্তর বঙ্গে যাওয়ার জন্য টানা ট্রেন ছিল না। স্টীমার পেরোতে হত।

এক মুসলিম যুবকের দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে লেখক। তার দোকানে মসজিদের ছবি। আর তার উপরেই একটা সারদা মায়ের ছবি পিজবোর্ডে সাঁটা। দেখেই বোঝা যাচ্ছে কোনো পত্রিকা বা খবরের কাগজ থেকে কাটা।

তাকে জিজ্ঞাসা করা হল। সে বলল, ছোটোবেলায় সে তার আম্মিকে হারিয়েছে। কিন্তু আম্মির জন্য তার মন কেমন করত। দেখতে ইচ্ছা করত। কাঁদতও লুকিয়ে। একা। কিন্তু গোটা পরিবারের ভার তার উপর। কাঁদার সময় কই? একদিন পুরোনো খবরের কাগজ ঘাঁটতে ঘাঁটতে এই ছবিটা পায়। দেখেই মনে হয়, এই তো তার আম্মি! তারপর তার যখন এই দোকান হয় সে তখন এই ছবিটা লাগায় এখানে। তার আম্মির ছবি। আসলে মা বা আম্মি যাই বলি না কেন, মা মানে তো একটা আবেগ।

নোম চোমস্কিকে আমার কাছে আমার সময়ের সক্রেটিসের মত লাগে। সৌভাগ্য যে সে মানুষটার কথা শুনছি, ভাবছি, জানছি। এক এক বিষয়কে নতুন আলোতে দেখছি।

একটা সাক্ষাৎকার দিতে গিয়ে তিনি একবার বলেছিলেন, একজন মৃত সন্তানের মা যদি তার মৃত সন্তানকে স্বর্গে আবার দেখার বাসনায় দিনযাপন করেন, আমার মনে হয় না তাকে দর্শনের কূটতত্ত্ব বোঝানোর কোনো দরকার আছে।

সুস্থ বাঁচার জন্য সান্ত্বনা দরকার। সে সান্ত্বনা যে যেভাবেই পাক, তাতে অন্যের আপত্তি কি থাকতে পারে? কারোর কোনো ক্ষতি তো করছে না সে! এমনকি নিজেরও তো না। ধর্মের নানা গল্পের অসংগতি দেখানোর জন্য একটা পাঁচ বছরের বাচ্চার বুদ্ধিই যথেষ্ট। ধর্মের অসংখ্য ব্যাখ্যা হয়। সেই নিয়ে অকারণে গোল বাধিয়ে লাভ কি? তুমি হয় তো রবীন্দ্রনাথের গান-কবিতায় সান্ত্বনা খোঁজো, আরাম খোঁজো। আমি হয় তো বৃহস্পতিবার আলপনা দিয়ে, ধুপদীপ জ্বালিয়ে লক্ষ্মীর পাঁচালি পড়ে সান্ত্বনা খুঁজি। তুমি হয় তো উচ্চাঙ্গসংগীত, আধুনিক কবিতা, আধুনিক সিনেমা ওয়েবসিরিজে ছুটি পাও, আমি হয় তো সোমবার শিবমন্দিরে শিবের মাথায় জল ঢেলে আরাম খুঁজি, বিকেলে চায়ের কাপ নিয়ে ছাদে বসে কাকেদের মুড়ি ছড়িয়ে বিশ্বের সঙ্গে যোগসূত্র খুঁজি, কীর্তনের রাধাকৃষ্ণে আমার সব না-পাওয়া অভাবদের চন্দনের গন্ধে ভরিয়ে নিই…. তাই বলে তুমি আমায় ব্যঙ্গ করবে? তুমি হলে উন্নত, আর আমি হলাম পিছিয়ে পড়া? তার চাইতে বলো না কেন আমরা আলাদা, ভিন্ন প্রকৃতির। সবাই কি এক হয়? না সেটা হওয়া ভালো?

 

(তথ্যসূত্র, বই, "প্রকৃতিং পরমাম", লেখক, স্বামী অব্জজানন্দ। উদ্বোধন থেকে সদ্য পুনপ্রকাশিত)