মা পা'টা ডলে ডলে ধুচ্ছে পুকুরঘাটের শেষের আগের সিঁড়িতে বসে। আলতাগুলো জলে গুলে যাচ্ছে। শিবু হাঁ করে বসে দেখছে। মায়ের শরীরটার ঝাঁকুনিতে হাতের চুড়িগুলো ঝনঝন করে বেজে উঠছে। মা শিবুর দিকে তাকিয়ে বলল, দুপুরে খেয়েছিস? খিচুড়িটায় নুন বেশি ছিল না?
শিবু সিঁড়িতে পা ছড়িয়ে বসেছিল। মায়ের কথাটা শুনেই দুই হাঁটুতে চাপড় মেরে বলল, আই শশ্লা তুমি ধরে ফেলেছ? আমি জানতাম…. আমি বললাম বলাই পুরোহিতকে, আমার মাথায় চাঁটি মেরে বলল, শশ্লা ভিখারি… ভালো নোলা তো রে…
মা আড়চোখে তাকিয়ে বলল, বড় বেড়েছে জানিস….
শিবু বলল, তুমি আবার কিছু বলতে যেও না…..
ওদিক থেকে একটা চীৎকার ভেসে এলো, কিরে শিবু…. বাসনগুলো মেজেছিস…. প্রদীপ মেজেছিস… সব নিয়ে আয় বাবা… আরতির সময় হয়ে যাবে…. তারপর বীরেনদা এসে আমার পিণ্ডি চটকাবে…..
শিবুর মায়ের গলা। শিবু বলল, শুনেছ, পিণ্ডি চটকাবে। আমার হাতে বাবার পিণ্ডি দিয়ে বীরেন ঠাকুর বলেছিল এগুলোতে কনুই দিয়ে জল ঢাল। সেকি হয়? আমি সোজা জল ঢেলে দিয়েছি…. তারপর বীরেন ঠাকুর দিয়েছে আমার গালে এক চড়…. বলে… শশ্লা জন্ম পাগল…..
======
সন্ধ্যা হব হব। বীরেন ঠাকুর এসে গোছগাছ করছে। আজ পয়লা বৈশাখ। মন্দিরে প্রচণ্ড ভিড়। শিবুর কাজ মন্দিরের বড় ঘন্টাটা ধমাস ধমাস করে বাজানো। মায়ের ভালো লাগে না শুনতে, মা কতবার বলেছে শিবুকে, কানে লাগে, কিন্তু আওয়াজটা কম করে বাজালেই বীরেন ঠাকুর আরতি করতে করতে চোখ পাকায়। তারপর আরতি হয়ে গেলে গালে, কি মাথায় একটা চড় মেরে বাড়ি যায়।
শিবু মন্দিরে এসে দেখল প্রচণ্ড ভিড়। কিন্তু মা কই? পুকুর পাড়ে পা ধুয়ে কোথায় গেল। সে তো প্রদীপ থালা এইসব নিয়ে মাজতে বসেছিল। হঠাৎ মনে হল মা কি তার জন্য নতুন জামা কিনতে গেছে? আজ অনেকে শাড়ি দিয়েছে মাকে। তার বাড়ির মাকেও দিয়েছে একটা মন্দির থেকে। বাড়ির মা মন্দিরে মায়ের জন্য ভোগ রাঁধে। কিন্তু তাকে কেউ দেয়নি। শিবুর কষ্ট হয়েছে, কিন্তু কোনো মাকেই বলেনি। বাড়ির মাকে বললে কি হবে, মায়ের টাকা কোথায়? আর মন্দিরের মাকে বলতে লজ্জা লাগে। সব বলা যায়?
======
আরতি শুরু হল। মায়ের বেদী ফাঁকা। আজ কেউ বাজারে যায়? আজ তো প্রচণ্ড ভিড় হবে। উফ, কি যে করে না, সারাদিন মন্দিরে থেকে থেকে মন্দিরের মা এসব জানবেই বা কি করে। বেরোনো বলতে তো ওই ধানক্ষেতে বিকেলে মাঝে মাঝে গিয়ে বসে। আর নইলে পুকুরপাড়ে। গিয়েই শিবুকে ডেকে নেয়।
কিন্তু মা সত্যিই কি ফিরবে না? আরতি শুরু হয়ে গেল। উফ, আজ না হয় পুরোনো জামা পরেই কাটিয়ে দিত।
শিবু চারদিকে তাকালো। সবাই নতুন জামা, শাড়ি পরে এসেছে। তবে? মায়ের খারাপ লাগত না? মা কি বীরেন ঠাকুরের মত নাকি!
=====
আরতি শেষ হল। কি আশ্চর্য কেউ দেখতে পেল না মা মন্দিরে নেই, তার জন্য জামা কিনতে বাজারে গেছে। কেউ দেখতে পেল না। এতবড় বাজার, মা যদি হারিয়ে যায়? কি হবে?
শিবু কাউকে কিছু না বলে দৌড় লাগালো। তাদের গ্রাম থেকে বাজার অনেক দূর। তিনটে মাঠ, দুটো পুকুর, রেললাইন পেরিয়ে তারপর।
শিবু ঘেমেনেয়ে বাজারে এসে দাঁড়ালো। ভিড়ে থিকথিক করছে। উফ, কতদিন বাজারে আসে না সে। কিছুই যে কেন তার কেনার থাকে না। মন্দির থেকে মাসে পাঁচশো টাকা দেয়। মা নিয়ে নেয়। বাড়ির মা।
কিন্তু মন্দিরের মা কই? শিবু এ দোকান, সে দোকান খুঁজতে শুরু করল। বুকের ভিতরটা হাপর পেটাচ্ছে। দেরি হলে আবার ওদিকে বাড়ির মা বকবে। আরে ওই তো মা!
একটা সবুজ পাঞ্জাবি, ঝোলানো…. মা দেখছে…. তাকে ইশারায় ডাকছে। এই রংটা কেমন?
শিবু কাছে গিয়ে বলল, বাহ, তুমি তো বেশ…. মন্দিরে সবাই ওদিকে তোমার প্রতিমায় আরতি করে ফেলল… আর তুমি এখানে…. এই পাঞ্জাবি নিয়ে….
এই বলে হাসতে হাসতে প্রায় বিষম খেয়ে টেয়ে, পাঞ্জাবিটা হাতে নিয়ে বেরোতে যাবে, কে যেন চুলের মুটি ধরে টানল….
শিবুর মাথাটা পিছনে ঘুরে গেল চুলের টানে…. দোকানের একটা লোক তাকে রাস্তায় ফেলে পেটে লাথি মারল… হাত থেকে পাঞ্জাবিটা কেড়ে নিয়ে বলল, শালা চোর….
কিন্তু মা কই? তাকে মারছে মারুক… মা নিশ্চয়ই দাম জানে না…. মা কই?
শিবু দেখল বাজারে অনেক লোক মাকে চারদিক থেকে বেঁধে বলছে চল তোকে জলে ফেলে দিয়ে আসি আবার… দোকানে আসা…. দোকানে….
শিবু রাস্তায় শুয়ে পড়ে আছাড়িপাছাড়ি খেয়ে কাঁদতে কাঁদতে বলল, ছেড়ে দাও গো মাকে ছেড়ে দাও… ও জানে না কিসের কত দাম… ও তো মন্দিরে থাকে…..
=======
শিবু রাস্তা দিয়ে ফিরছে। অন্ধকারে। তার কপাল কেটে রক্ত বেরিয়ে জমাট বেঁধে আছে। দাঁতের থেকেও রক্ত বেরিয়েছে। জিভ কেটে গিয়েছে। পিঠে বুকে খুব ব্যথা। এত রক্ত দেখে দোকানের কে একজন উঠে এসে তাকে পাঞ্জাবিটা হাতে দিয়ে বলেছে যা…. ভাগ… আর চুরি করবি না…. বছরের প্রথম দিন… রক্ত ভাল্লাগে না…
শিবু পাঞ্জাবিটা নিতে চায়নি। জোর করে দিয়েছে। শিবু মাকে এদিক ওদিক অনেক খুঁজে শেষে শ্মশানের ধারে বসে থাকতে দেখেছে। এখানে কেউ আসে? তাও রাতে?
শিবু মায়ের হাত ধরে ফিরছে। মাকে বলল, তুমি অমন হঠাৎ করে কাউকে না বলে কেন বাজারে চলে এলে….
মা বলল, কেন তোকে ওরা নতুন কিছু কিনে দিল না… আমি মা… আমার বুকে বাজে না?….. মা কাঁদছে। তিনটে চোখ দিয়ে কাঁদছে।
শিবুর কান্না পেল। শিবুর কান্না পেলে আর খিদে পেলে হেঁচকি ওঠে। সে হেঁচকি তুলতে তুলতে বলল, তুমি চুপ করো… এখন এই পাঞ্জাবি দেখে সবাইকে কি বলব….
মা বলল, আমি বুঝিয়ে দেব।
=====
শিবু মন্দিরে এসে আশ্চর্য হয়ে দেখল সে আসার আগেই মা সবাইকে বুঝিয়ে দিয়েছে। কেউ তাকে কিছু জিজ্ঞাসা করা তো দূর, খেয়ালই করল না।
শুধু বাড়ির মা বলল, খাবি চল…. তোকে নিয়ে যে কি করি….
মন্দিরের মা ইশারা করে বলল, চুপ থাকবি।