১
---
অশান্তির হাত থেকে বাঁচার জন্যেই হোক কি নিজের জন্য একটু আলাদা শ্বাস নেওয়ার জায়গা খোঁজার জন্যেই হোক, বলাই সামন্ত যখন শ্যামবাজার ছেড়ে রাণাঘাটের ওদিকে একটা গ্রামে বাড়ি করল, সবাই আশ্চর্যই হয়েছিল। বলাই সামন্ত ব্যবসায়ী। খুব বিশাল কিছু একটা না হলেও, মোটামুটি অনেকেই চেনে জানে। বলাইয়ের পরিবার বলতে একটা জড়বুদ্ধি সন্তান, স্ত্রী আর বিধবা মা। বুলবুলদেবী, মানে বলাইয়ের মা সারাদিন তার পূজোআচ্চা নিয়েই থাকেন, সংসারের খুঁটিনাটিতে ঢোকেন না বহুদিন হল। বলাইয়ের স্ত্রী রক্তিমা ঝাড়খণ্ডের মেয়ে, প্রথম প্রথম কলকাতার আবহাওয়া মানিয়ে নিতে না পারলেও এখন কলকাতা ছেড়ে যেতেই চায় না, বিশেষ করে রাহুলের জন্য। রাহুলের এখন আঠারো বছর বয়েস, কিচ্ছু বোঝে না। রক্তিমা যত দিন যাচ্ছে তত যেন সে রাহুলের জগতে ঢুকে পড়তে চাইছে, তার সামনে এখন কিচ্ছু নেই। রাহুলকে বোঝা, রাহুলের সাথে যে করেই হোক স্বাভাবিক সম্পর্ক তৈরি করাই রক্তিমার একমাত্র ধ্যানজ্ঞান হয়ে দাঁড়িয়েছে। রাহুলের যে কোনো অস্বাভাবিক আচরণের মধ্যে স্বাভাবিক, কিন্তু ব্যতিক্রমী কিছু একটা দেখতে পায় রক্তিমা। বলাই যতই বোঝাক না কেন যে রাহুলের আচরণটা অস্বাভাবিক, রক্তিমা বলে, "অস্বাভাবিক না, ব্যতিক্রমী।"
বলাই রাণাঘাটের বাড়িতে এসে উঠল গতবছর পূজোর পর। একাই এসেছে, সাথে কার্তিক বলে একটা কাজের লোক। বলাইয়ের বহুদিনের পুরোনো কাজের লোক। গ্রামের মোড়ল সুধাকান্ত নন্দীর সাথে দেখা করেছে, গ্রামের উন্নয়নে সাহায্য করবে বলে কথাও দিয়েছে। তবে গ্রামের লোক যতটা কাছে পাবে ভেবেছিল বলাই সামন্তকে ততটা পেল না। যে কোনো উৎসবে, আপদে-বিপদে বলাইয়ের টাকা এসে ঠিক পৌঁছে যেত বটে, কিন্তু বলাইয়ের সাথে সামাজিক আচরণে কেউ বেশিদূর সুবিধা করতে পারল না।
বলাই বাইরে যখন বেরোত তখন ফর্ম্যাল জামা-প্যান্ট পরে বেরোলেও, ঘরে সাদা পায়জামা-পাঞ্জাবী পরেই থাকত। ইদানীং কলকাতায় থাকা কমিয়ে দিয়ে রাণাঘাট থেকেই ব্যবসার কাজ দেখতে শুরু করল। কম টাকায় আরেকটা সেকেণ্ড হ্যাণ্ড গাড়িও পেয়ে গেল, ফলে সুবিধাই হল।
ঘটনাটা ঘটল এ বছর রাখীপূর্ণিমার পরের দিন। এই গ্রামে রাখীপূর্ণিমা একটা খুব বড় উৎসব। গ্রামে রাধাগোবিন্দ'র একটা মন্দির আছে, সেই মন্দিরের এটাই বাৎসরিক উৎসব। সেই দিনই বলাই সামন্ত খুন হলেন। বাড়ির খাটেই রক্তাক্ত দেহ পাওয়া গেল, গলার নলি কাটা। কোনো হাতাহাতির চিহ্ন নেই ঘরে, পোস্টমর্টেমের রিপোর্ট অনুযায়ী খুনটা হয়েছে রাত তিনটে থেকে পাঁচটার মধ্যে। সেদিন ঘরে বলাইবাবুর সাথে কার্তিক ছাড়া আর কেউ ছিল না। পুলিশ কার্তিককে নিয়ে গেছে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য। কিন্তু কিছুতেই কোনো তথ্য পাওয়া যায় নি। কার্তিক কেঁদেই অস্থির, জেরার সময় একবার সুগার ফল করে অসুস্থ হয়ে হাস্পাতালেও কাটালো কয়েকদিন। পুলিশ বলাইবাবুর স্ত্রী, মা'কে জেরা করেও কোনো সুফল পেলো না। বলাইবাবুর মা, পুত্রশোকে কিছুটা পাগল মত হয়ে গেলেন, নিজেকে সারাদিন ঘরে খিল দিয়ে রাখেন, পূজোপাঠও ছেড়ে দিয়েছেন। পুলিশ বলাইয়ের ব্যবসাপত্রের অবস্থা খোঁজ নিয়ে দেখেছে, সেখানেও এমন কিছু শত্রুতা বেড়েছে, বা কারোর সাথে কোনো ঝামেলা হয়েছে বলে কিছু শোনেনি কেউ, তবে? পুলিশ রণবীর মিত্রকে কেসটা হ্যাণ্ডওভার করল। দুঁদে পুলিশ অফিসার ছিলেন। রিট্যায়ার করেছেন। পাঁচ ফুট আট ইঞ্চি উচ্চতা, রোগাটে গড়ন, মুখটা গোল, চশমা শুধু পড়তেই লাগে, সাদাপাকা চুল, মুখের হাবভাব খুব নিরীহ প্রকৃতির, শুধু চোখদুটো ছাড়া। চোখদুটো বেশ তীক্ষ্ণ আর কৌতুহলী, কিছুটা দুষ্টুবুদ্ধির আভাসও আছে।
রণবীর রাণাঘাটে এসে পৌঁছালো শনিবার সন্ধ্যেবেলা। সেখানে তার এক বন্ধুর বাড়ি আছে, তার বাড়িতেই উঠল। হীরু মল্লিক এই রাণাঘাটের বহু পুরোনো বাসিন্দা। তার মাছের ব্যবসা। গ্র্যাজুয়েশান করতে কলকাতায় গিয়েছিল, নকশালে জড়িয়ে পড়ে, সেখানেই রণবীরের সাথে আলাপ, তারপর নকশাল ছেড়ে পৈতৃক মাছের ব্যবসায় এসে পড়ে, কিন্তু কিছু একটা কারণে রণবীরের সাথে যোগাযোগটা থেকেই যায়।
দুই বন্ধু বলাই সামন্তর বাড়িটা দেখতে গেল। চাবিটা এখানকার থানা থেকেই নিল। খুনটা প্রায় একমাস আগে হয়েছে, বাড়ির ভিতরে এর মধ্যেই বেশ ধুলো ধুলো। রণবীর একটা রুমাল নাকে বেঁধে নিল, তার অ্যাজমার সমস্যা আছে। হীরুও তার দেখাদেখি পকেট থেকে একটা রুমাল বার করে নাকে দিতে দিতে বলল, "তোমাদের কলকাতার লোকেদের যত আদিখ্যেতা।" যে ঘরে খুনটা হয়েছিল সেই ঘরটায় তারা ঢুকল। চাদরে এখনও রক্তের দাগ কয়েক ফোঁটা এদিকে ওদিকে, কালচে হয়ে গেছে। খাটের তলায় একটা টুল ঢোকানো। রণবীর টানল। এক প্রস্থ পুরু ধুলো জমে। টুলের নীচের একটা কোনার দিকে চুন মোছার দাগ, কালো হয়ে গেছে। রণবীর একটু খুঁটে একটা কাগজে মুড়ে নিয়ে পকেটে ঢোকালো। তারপর এদিক ওদিক দেখে বাড়ি ফিরল যখন রাত দশটা। হীরুর বৌ ময়নার রান্নার হাত খুব ভালো। পাবদা, রুই, পাঁঠার মাংস - নানা পদের বাহার, রণবীর বরাবর একটু খাদ্যরসিক, যারপরনাই খুশী হয়ে এমন খাওয়ায় মন দিল, হীরুর মনে হল রণবীর যেন খুনের কিনারা করতে না, বেড়াতেই এসেছে শুধু।
২
---
পরেরদিন রণবীর কখন বেরিয়েছে হীরু জানে না। সে সাড়ে আটটায় উঠে দেখে রণবীর নেই। ময়না উঠেছে তার খানিক আগেই, চা খাবে কিনা জিজ্ঞাসা করতে গিয়ে দেখে রণবীর ঘরে নেই। মোবাইলটাও খাটেই রাখা।
হীরু বাইকটা নিয়ে খানিক এগোতেই দেখে রণবীর হন্তদন্ত হয়ে আসছে, তার বাইকে উঠেই বলল, আমায় এখনই ফিরতে হবে। হীরু রণবীরের মুখের ভাবসাব দেখে ওকে আর না ঘাঁটিয়ে মাথা নাড়ল শুধু। রণবীর চা আর বিস্কুট খেয়ে বেরিয়ে স্টেশানে এসে একটা ফাঁকা সিট দেখে জানলার ধারে বসল, রাণাঘাট লোকাল, ছাড়তে দেরি আছে পাঁচ মিনিট।
সকালের কথাগুলো একবার ঝালিয়ে নিল মনে মনে রণবীর। আজকাল এই স্মার্টফোনগুলোর ভীষণ ভক্ত হয়ে গেছে রণবীর, তার কত কাজে যে সুবিধা হয়ে করে দিয়েছে এই ফোনগুলো। সকালের কথাগুলো নোটপ্যাডে লিখে রাখল।
রণবীর প্রথমেই যায় বলাই সামন্তের বাড়ির একটু দূরেই একটা খাটালের মালিকের সাথে কথা বলতে। সে বলাই সামন্ত ছাড়া আর কাউকে সেদিন রাতে তার বাড়িতে আসতে দেখেছে কিনা জানতে। সে বলে দু'জন অল্পবয়েসী ছেলে তার বাড়িতে সন্ধ্যের দিকে এসেছিল, কিন্তু খানিকবাদেই চলে যায়, এরকম লোক ব্যবসার কাজের জন্য এ বাড়িতে ইদানীং প্রায়ই আসত বলে সে মাথা ঘামায়নি। পুলিশ তার কাছে জানতে এসেছিল কিনা জিজ্ঞাসা করাতে সে নাকি বলেছিল, সে জানে না, কারণ তার তখন খুব 'বুখার' ছিল, কথা বলতে ইচ্ছা করছিল না।
তারপর এখানে আশেপাশে কয়েকটা পানের দোকানে খোঁজ নিয়ে রণবীর জানতে পেরেছে রাখীপূর্ণিমার দিন রাতে সাড়ে আটটা নাগাদ দুটো ছেলে একটা পানের দোকান থেকে পান কিনতে আসে, তাদের সে এ গ্রামে আগে কখনও দেখেনি, দেখে অবাঙালীই মনে হয়েছিল, পরে জানতে পারে তারা বিহার থেকে এসেছে এই মন্দিরের উৎসবে, তাদের কোন এক আত্মীয় থাকে নাকি, কিন্তু কোন আত্মীয় জিজ্ঞাসা করাতে তারা এড়িয়ে যায়। পুলিশ এই বিষয়ে কিছু জানে না। কারণ সেদিন টলিউডের কোন এক নায়িকা মন্দিরের পূজোর প্রধান অতিথি হয়ে আসায় পুলিশের নজর অনেকটা ওদিকেই ছিল।
রণবীর একাই চলে আসে বলাই সামন্তের বসতবাড়িতে তিনদিন পরে। এই ক'দিন সে নানা জায়গায় খোঁজ নিয়ে দেখেছে সেদিন ব্যবসার কাজে কেউ রাণাঘাটে যায়নি বলাইয়ের সাথে দেখা করতে। রণবীর প্রথমেই কথা বলতে চাইল রক্তিমার সাথে, আলাদা। বসার ঘরের পাশে একটা ছোটো ঘর, গেস্টরুম হিসাবেই ব্যবহার করা হত, সেইখানেই বসতে বলা হল রণবীরকে।
একটা ছোটোখাটো, পাশে একটা তেপায়া টেবিল। দেওয়াল ঘড়ি, বন্ধ হয়ে পড়ে আছে, ঘরটায় একটা গুমোট গন্ধও। অ্যাটাচ টয়লেট। রত্না এসে খাটের একদিকে বসল।
কিছুক্ষণ দু'জনেই চুপচাপ, রক্তিমা বলল, "আপনাকে চা দিতে বলি?"
রণবীর হেসে 'না', বলে শুরু করল,
- এই সময়ে আপনাকে এভাবে বিব্রত করা উচিৎ নয় জানি, আসলে আমার মত একটা নিষ্কর্মা বুড়োকেই এই গুরুভার দেওয়া হয়েছে বুঝলেন তো...
- না না, আপনি বলুন। রক্তিমা বেশ শক্ত ধাতের মানুষ রণবীর দেখল, তার চোয়ালগুলো সে ইতিমধ্যে শক্ত করে নিয়েছে, সিঁথিতে সিঁদুরের হাল্কা দাগ এখনও, মুখের মধ্যে একটা কৃত্রিম স্বাভাবিকত্ব।
- আপনার কাকে সন্দেহ হয়?
- জানি না, হয়ত সবাইকে।
- আপনার সাথে শেষ কবে কথা হয়েছে।
- আমাদের কথা হত না শেষ কয়েকমাস।
- কেন?
- জাস্ট হত না, আমাদের নিজেদের মধ্যে বনিবনা ছিল না।
- কেন?
- ছেলেকে নিয়েই বিশেষ করে, আমি কত করে বলতাম চলো, ওকে বিদেশে নিয়ে যাই, ওখানে কতরকম চিকিৎসা... শুনতই না... বলত, ও কোনোদিন ঠিক হবে না... জানেন ওর জন্য আমি আর কোনো ইস্যুই নিতে চাইনি... তবু...
চোখের একফোঁটা জল ডানহাতের বুড়ো আঙুলের পিছন দিকটা দিয়ে মুছে নিল রক্তিমা।
- ছেলেকে ভালোবাসতেন না?
- জানি না, বাসতেন হয়ত, কোন বাপ তার ছেলেকে না ভালোবাসে।
- আপনি রাণাঘাট যেতে চাইতেন না?
- না
- কার্তিককে আপনার কেমন লাগে?
- ঠিকঠাক, ও এর মধ্যে নেই, আমি জানি।
- আচ্ছা বিহারে আপনাদের কোনো আত্মীয় থাকে?
- কেন বলুন তো? কিছুটা চমকেই যায় রক্তিমা।
- না এমনি...
- আমার সব আত্মীয়ই তো বিহারের, মানে ঝাড়খণ্ডের, আমি তো ওখানকারই মেয়ে, বাবা প্রবাসী বাঙালী ছিলেন, যদিও আমাদের আদি বাড়ি ঢাকায়।
- ও আচ্ছা, ঠিক আছে আপনি আসতে পারেন। একটু কার্তিককে পাঠিয়ে দেবেন প্লিজ।
রক্তিমা অন্যমনস্ক কিছুটা, উঠে চলে যেতে গিয়েও আবার দরজাটার পাল্লাদুটো খুলে ফিরে তাকালো, বলল, "আপনার চায়ে চিনি দেব?"
রণবীর প্রথমে বলতে চাইল যে সে চা খাওয়ার কথা বলেনি, কিন্তু তা না বলে বলল, "আমি একবার আপনার ছেলেকে দেখতে গেলে আপত্তি নেই তো?"
রক্তিমা মাথা নেড়ে সম্মতি জানিয়ে বেরিয়ে গেল।
কার্তিক একটা হাফ প্যান্ট আর একটা টি শার্ট পরে ঘরে ঢুকল। রোগাটে গড়ন, অসুস্থ চোখমুখ, দীর্ঘদিন হাইসুগারে ভুগছে শুনেছে রণবীর। রণবীর কথা শুরু করল।
- আপনি সেদিন ঠিক ঠিক কি ঘটেছিল বলে যান। আমি আপনার বয়ান যা পড়েছি, তাতে কিছুটা জানি যদিও, তবু এখন যদি কিছু মনে পড়ে নতুন করে আবার।
কিছুটা জড়তা নিয়েই শুরু করল কার্তিক।
- সেদিন গ্রামে খুব বড় জলসা ছিল। আমি গান শুনতে খুব ভালোবাসি বলে আমায় দাদা বললেন, তুই যা, আমি শুয়ে পড়ব, ফোনটা সাথে নিয়ে যা, আমার অসুবিধা হলে আমি তোকে ডেকে নেব। দরজাটা ইন্টারলক ছিল, আপনি দেখে থাকবেন। আমি বাড়ি ফিরেছি তখন সাড়ে এগারোটা। এসে দেখি দাদার ঘর অন্ধকার। আমি খেয়ে শুয়ে পড়লাম। পরেরদিন দাদার জন্য চা নিয়ে গিয়ে দেখি...
- ওরা বাথরুমের সাথে বাইরে যাওয়ার দরজাটা ভেঙে ঢুকেছিল, আপনার বয়ান অনুযায়ী। কিন্তু ওদিকে একটা দরজা করতে গেলেন কেন?
- আসলে ওদিকে আরেকটা ঘর করার কথা হচ্ছিল, বৌদিমণির জন্য। একটাই কমোন বাথরুম থাকত।
- আচ্ছা তুমি যেতে পারো, কিন্তু মাসিমার সাথে কিভাবে দেখা করা যায়? উনি আসবেন, না আমি উপরে যাব?
- আপনাকেই উপরে যেতে বললেন, তিনতলায়।
কার্তিক বেরিয়ে যাচ্ছিল। রণবীর আবার ডাকল,
- কার্তিকবাবু, আপনি কি পান খান?
- না তো!
- দাদা খেতেন?
- না তো, ওনার চা ছাড়া অন্য কোনো নেশাই ছিল না।
- খইনি বা অন্য কিছু খান?
- না না, কেন বলুন তো?
- না ঠিক আছে, আপনি আসতে পারেন, মাসিমাকে বলুন আমি আসছি রাহুলের সাথে দেখা করে।
৩
---
রণবীর দোতলায় রাহুলের ঘরে ঢুকলো। রাহুল খাটে শোয়া। চেহারা দেখলে মনে হয় না আঠারো, বয়েস খানিক বেশিই লাগল রণবীরের। বেশ বড় ঘর। খাট ছাড়া পরপর দুটো আলমারি, একটা সোফা, একটা তানপুরা কাপড় দিয়ে ঢাকা, কোনায় একটা ড্রেসিংটেবিল। আয়নার সাইজটা স্বাভাবিকের তুলনায় বড়।
রাহুল উঠে বসেছে। তার পাশে রক্তিমা, ওকে ধরে বসে আছে। রণবীর খেয়াল করল রাহুলের ঘরে ঢুকেই রক্তিমার মুখের ভাব কেমন বদলে গেল। সেটা অবশ্য রণবীর একতলার সিঁড়ির মুখেই খেয়াল করেছে, যখন রক্তিমা তাকে নিতে দাঁড়িয়ে ছিল। যেন বিশ্ব সংসারের কোনো কিছুর পরিবর্তনেই তার কিছু আসে যায় না। রণবীরকে দেখেই রাহুল আঙুল তুলে বলল, "মাহাতো আঙ্কেল।" রক্তিমা বলল, "না উনি রণবীর আঙ্কেল।" রণবীর জিজ্ঞাসা করল, "মাহাতো কে?" রক্তিমা বলল, "ওর বিজনেস পার্টনার ছিল, বেণারসের, ওকে দেখতে অনেকটা আপনারই মত, তাই ও আরকি..."
হঠাৎ রক্তিমার ব্যবহারে একটা পরিবর্তন হল। সে কিছুটা উত্তেজিত হয়েই বলতে শুরু করল, "আপনি বলুন ওর কি পুরো মাথাটা খারাপ? তাই হয়? তাই যদি হত তবে আপনার সাথে মাহাতোর মিল পেত? সম্ভব ছিল? তার মানে ওর মেমরি কিছুটা হলেও বাস্তবটাকে রিড করতে পারে, আপনার কি মনে হয়? একটু যদি বাইরে গিয়ে ওর চিকিৎসাটা করানো যেত.....", রক্তিমা কান্নায় ভেঙ্গে পড়ল। রণবীর উঠে এলো। একজন বয়স্কা মহিলা, খুব সম্ভবত কাজের লোক, রক্তিমার ঘরে ঢুকে কিছু একটা বলে সান্ত্বনা দিতে লাগল। খানিক বাদেই শুনল এটা ওটা ছোঁড়ার আওয়াজ, কার্তিক এসেছে রণবীরকে তিনতলায় নিয়ে যেতে, সে এখন একটা পায়জামা আর পাঞ্জাবী পরে, একটু হেসে বলল, "বৌদিমণি রেগে গেলেই..." সাথে সাথে একটা গোঙানির আওয়াজও আসছিল, কার্তিক বলল, "রাহুল", সে চীৎকার করে 'পল্টু' বলে ডাকল, একটা চোদ্দ পনেরো বছরের ছেলে সামনে এসে দাঁড়ালো, রোগাটে গড়ন, মুখটা লম্বাটে, চোখমুখ দেখে বেশ চটপটে লাগল। কার্তিক বলল, "তুই ফ্রীজে দেখ রাহুলের ইঞ্জেকশানটা আছে কিনা, না থাকলে সামনের দোকান থেকে নিয়ে আয়, আমি ওবেলা টাকা দিয়ে দেব।"
পল্টু চলে গেল। তিনতলায় একটাই থাকার ঘর, পাশে বড় ঠাকুরঘর একটা। রণবীর উঁকি মেরে দেখল, বিরাট একটা শিবলিঙ্গ। "বুলবুলদেবী শিবভক্ত", কার্তিক বলল।
রণবীর যতটা বয়স্ক আশা করেছিল বুলবুলদেবী ততটা বয়স্কা নন, তবে হয়ত বয়সের ছাপ পড়েনি সেভাবে। বুলবুলদেবী উঠে দাঁড়িয়ে রণবীরকে হাতজোড় করে নমস্কার জানালো। রণবীর প্রতি নমস্কার জানিয়ে কিছু বলতে যাবে, এমন সময় কার্তিক বলে উঠল, "আপনি বসুন, আমি আপনার চা-টা নিয়ে আসি।" কার্তিক দরজাটা ভেজিয়ে চলে গেল। এই ঘরটা নীচের ঘরটার মত অত বড় নয়। এসি চলছে, উইন্ডো এসি, বেশ পুরোনো মডেল। একটা খাট, আলমারি, আলনা, আর বেতের দুটো চেয়ার আর বেতের টেবিল একটা। দেওয়ালে বিরাট একটা কাশী বিশ্বনাথের মন্দিরের ছবি। ঘরের কোনে একটা খুব পুরোনো ড্রেসিং টেবিল, কাঁচটা অপরিষ্কার, বাথরুম অ্যাটাচ মনে হল।
বুলবুলদেবী খাটে বসলেন, রণবীর একটা বেতের চেয়ারে বসল।
- কি আর বলি বলুন, বুলবুলদেবীই কথা শুরু করলেন।
- আপনার বাপের বাড়ি কোথায়?
- চাকদা।
- বিয়ে হয় কোন সালে?
- এসব কেন জিজ্ঞাসা করছেন? আমার ছেলের খুনের সাথে এর কি সম্পর্ক? কিছুটা যেন উষ্মাই প্রকাশ পেল বুলবুলদেবীর গলায়।
- না, ওই আরকি, বুঝছেনই তো, এত জটিল কেস, খুনী অত্যন্ত ধুরন্ধর, কোনো ট্রেসই রেখে যায়নি, আপনার বুঝি পানের শখ?
বুলবুলদেবী কিছুটা যেন অন্যমনস্ক হয়েই শুনছিলেন, অন্যমনস্ক হয়েই বললেন, "সে বহুদিনের, হুম... যা বলছিলেন, আমার বিয়ে হয়েছিল ছাপান্ন সালে।"
- চাকদায় থাকতেই?
- হুম...
- এখন কে থাকেন সেখানে?
- কেউ না।
- বাড়িটা?
- বিক্রী হয়ে গেছে।
- ঠিকানাটা মনে আছে?
- কি আশ্চর্য, আপনি আমার বাপের বাড়ি নিয়ে এত প্রশ্ন কেন করছেন বলুন তো?
- আপনি মাহাতো নামে কাউকে চেনেন?
হঠাৎ চুপ করে গেলেন বুলবুলদেবী। খানিক চুপ থেকে বললেন, "আপনি এখন আসুন, আমার পূজোর সময় হয়ে গেছে।"
*****
এই ঘটনার এক সপ্তাহ পর আসামী গ্রেপ্তার হয় বেণারস থেকে। খবরের কাগজে সত্য-মিথ্যা মিলে নানা গল্প বেরোলো। আমরা বাকি গল্পটা শুনব রণবীরের ডায়েরি থেকেঃ-
আমার প্রথম খটকা লাগল বলাইয়ের ব্যবসাপত্রের খোঁজ নিতে গিয়ে। ওর বেশিরভাগ ব্যবসাই বেণারসের দিকে ছিল আগে, যখন ও ব্যবসায় আসে। কিন্তু বছর ঘুরতে না ঘুরতেই বলাই ওর বেণারসের ব্যবসার পাট চুকিয়ে ফেলতে শুরু করে। কিন্তু কেন? কেঁচো খুঁড়তে কেউটে বেরোলো। বেশ পুরোনো গল্প। বলাইয়ের বাবার বড়বাজারে শাড়ির দোকান ছিল। সাথে দূর্গাপুর, শিলিগুড়ি, কৃষ্ণনগরেও শাড়ি সাপ্লাই করতেন। রমাকান্ত সামন্তকে তখন এক ডাকেই শাড়ি ব্যবসায়ীরা চিনত। মানুষটার একটাই দুর্বলতা ছিল – মেয়েদের প্রতি।
বেণারসে মাসের বেশিরভাগ সময় কাটাতেন রমাকান্তবাবু। অনেক মেয়েদের সাথে সম্পর্ক হলেও, ফেঁসে যান ফরজানার কাছে। তার রূপে এমন মজেন যে হুঁশ খুইয়ে ফেলেন নাকি রমাকান্ত প্রায়। ফরজানার বাবার ছিল সব চাইতে ভালো মানের শাড়ি। বেশ চড়া দামেই বিক্রি হত, পাইকারি ছাড়া বিক্রিও হত না। ফরজানার তখন বিয়ে হয়ে গেছে, এক ছেলেও হয়েছে সদ্য। তার সাথে যার বিয়ে হয়েছে সে তার শ্বশুরের ওখানেই ম্যানেজারি করে। রাশভারী মানুষ। ফরজানার থেকে প্রায় কুড়ি বছরের বড়। আফতাব মিঞা, মানে ফরজানার বাবার ইচ্ছা তার যা কিছু জামাইকে দিয়ে হজে বেরোয়। যেমন ভাবনা তেমন কাজ। ইতিমধ্যে সেখানে রমাকান্ত ফরজানার রূপে মজে ফরজানাকে জপাচ্ছে সে যেন তার স্বামীকে ছেড়ে কলকাতায় তার সাথে চলে আসে।
তাই হল। ফরজানার হার হল রমাকান্তের কাছে। রমাকান্ত তাকে কলকাতায় আনে বেণারসের পর্ব মোটা টাকায় মিটমাট করিয়ে, ফরজানাকে বুলবুল নামে হিন্দুমতে বিয়ে করে কলকাতায় ওঠে। ফরজানার বাবা আর হজ থেকে ফেরেননি, অন্যদিকে ফরজানার প্রাক্তন স্বামীও শোকে হোক কি রোগে হোক বেশিদিন বাঁচেননি। নানা হাত ঘুরে ব্যবসার মালিকানা রমাকান্ত নেয়। ফরজানার ছেলে মানুষ হচ্ছিল এক আত্মীয়ের বাড়ি, তাকে মাসোহারা হিসাবে কিছু টাকা পাঠাতে রাজি হয় রমাকান্ত। একটাই শর্ত ফরজানা ওরফে বুলবুল যেন কিছুতেই ওই ছেলেকে নিজের বলে স্বীকার না করে, ওর সাথে সমস্ত সম্পর্ক ছিন্ন করে। রমাকান্ত কথা রেখেছিল, কিন্তু রমাকান্ত মারা যাওয়ার পর তাদের ম্যানেজার পুরো ব্যাপারটা গোপন করে যায়, টাকা পাঠানো বন্ধ হয়ে যায়।
পল্টু ওই ম্যানেজারের নাতি। যার মাধ্যমেই আমি এই সব ঘটনার সূত্র খুঁজে পাই। ব্যবসার খোঁজ নিচ্ছি যখন তখন পল্টু একটা চেক নিতে দোকানে আসে আর আমি ওর সাথে বন্ধুত্ব পাতিয়ে ওর বাড়ি যাই। কিছুটা পুলিশের অতীত আর কিছুটা টাকার লোভে পল্টুর বাবা মানে রতন মল্লিক সব ইতিহাস বলে দেয়। রতন পক্ষাঘাতে বিছানায় শয্যাশায়ী বেশ কিছু বছর হল। সে-ই টাকা পয়সার হিসাব দেখত বলাইয়ের। সে অসুস্থ হতে তার ছেলেকে কাজে রাখে বলাই।
তো রমাকান্তর মৃত্যুর পর টাকা পাঠানো বন্ধের খবরটা বুলবুলদেবী জানতেন না। একদিন পূজোর সময় হঠাৎ মাহাতো এসে উপস্থিত, আসলে সে মাহাতো না, বুলবুলদেবীর সেই পরিত্যক্ত ছেলে রশিদ মিঞা। সে বেণারসে একটা ছোটোখাটো ইলেক্ট্রিকের সরঞ্জামের দোকান চালায় এখন, তার দাবী ছিল তাকে তার সম্পত্তি ফিরিয়ে দেওয়া হোক। বুলবুল প্রথমে তাকে এটা-সেটা, গয়নাগাটি দিয়ে ঠেকিয়ে রাখলেও, বলাই যখন পুরো ব্যবসাটা নিজের হাতে নেয়, বেণারসে যায় ব্যবসা দেখতে, রশিদ সেখানে তার সাথে দেখা করে হুমকি দেয় প্রাণে মেরে ফেলার, পুরো ইতিহাসটা তাকে জানায়। বলাই ব্যবসা গুটিয়ে নেয়, কিন্তু সবটা জানার পর সে তার মায়ের সাথে কথা বলা বন্ধ করে দেয়। ব্যবসাও ফিরিয়ে দেয় না।
রশিদ 'মাহাতো' নামে মাঝে মাঝে আসতে শুরু করে শ্যামবাজারের বাড়িতে। বলাইয়ের ব্যাপারটা পছন্দ না হলেও মায়ের দিকে তাকিয়ে কিছু বলে না। এইভাবে চলে বেশ কিছু বছর। ব্যবসার লেনদেনের ব্যাপারটাও মিটে যেতে শুরু করে, কারণ রশিদ একটা মোটা টাকায় চুপ করে যাবে বলেছিল, তাই গিয়েওছিল। বাধ সাধল রশিদের বড় ছেলে চুন্নু। সে তখন বেণারসের উঠতি মস্তান। বড় বাজারের দোকানে এসে একবার বলাইকে শাসিয়েও গেল। বলাই রশিদকে জানায়। রশিদ বলে সে তার হাতের বাইরে। বলাই বোঝে এতে কোথাও একটা মদত আছে রশিদের। সে বেইমানী করছে। পুলিশকে জানাতে পারত, কিন্তু পারিবারিক কেচ্ছা বাইরে যাবে, তাই আর কিছু বলেনি সে।
চুন্নু আর তার বন্ধু জাহির রাখীপূর্ণিমার কয়েকদিন আগে থেকেই রাণাঘাটের আশপাশ ঘুরে দেখে। মাঝে একবার এসে দেখাও করে বলাইয়ের সাথে। বলাই বার করে দেয়। কার্তিককে বলে, পার্টির ছেলে। সেদিন রাতে তারা বাথরুমের দরজা কেটে ঘরে ঢোকে, জানত পুরো গ্রাম জলসায় ব্যস্ত থাকবে। এও জানত বলাই কড়া ঘুমের ওষুধ খেয়ে ঘুমায়।
আমি যখন প্রথম সামন্ত বাড়ি যাই তখনই আমি জানতাম বুলবুলদেবী ওরফে ফরজানার ইতিহাস। কিন্তু ওনার মুখ থেকে শুনতে চাইছিলাম। পরে এও জেনেছি, উনি নিজেও খুনীর ব্যাপারে জানতেন, কারণ চু্ন্নু খুনের পর ফরজানা ওরফে বুলবুলদেবীকে ফোন করেছিল নিজের মোবাইল থেকেই। সে তথ্যও পাওয়া গেছে। এখন বুলবুলদেবী গ্রেপ্তার হবেন কিনা সেটা ওরাই দেখুক, আমার কাজ সেটা নয়।