তো এদিকে ঠাকুরদালানে দুগ্গা প্রতিমা বানানো হচ্ছে। মেলা মেলা আগের গপ্পো এটা। যিনি বানাচ্ছেন তিনি বেশ পণ্ডিত মানুষ। মাতৃভক্ত। মায়ের গান করেন আর প্রতিমা গড়েন। কখনও মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে ভাবে গদগদ হয়ে বলেন, মা! ঠাকুরদালান কেঁপে ওঠে।
তো একদিন হল কী, শরতের আকাশ ঘিরে এলো শ্রাবণের মেঘ। যেন ফিরতে ফিরতে কী নিতে ভুলে গিয়েছিল সে। এক দৌড়ে এসে হুড়মুড়িয়ে খুঁজতে লেগেছে তার হারানো জিনিস। গাছপালা লণ্ডভণ্ড, মাটি কাদাকাদা। সেই প্রচণ্ড তাণ্ডবের মধ্যে আশ্রয়ের জন্য ঢুকলেন এক সন্ন্যাসী। বৈদান্তিক অদ্বৈতবাদী সন্ন্যাসী।
বাইরে তুমুল ঝড়বৃষ্টি, ঠাকুরদালানে শুরু হল তত্ত্ব আলোচনা। প্রতিমাশিল্পী বললেন, তবে আপনার সিদ্ধান্ত কী?
সন্ন্যাসী বললেন, এই যে প্রতিমা গড়ছেন, যে মাটিতে দেবী দুর্গাকে গড়ছেন, সেই মাটিতেই ওই ইঁদুরটিকেও গড়ছেন তো? এই আমার সিদ্ধান্ত। বস্তু এক। প্রকাশ ভিন্ন।
শিল্পী বললেন, বেশ। তার মানে আমাতে আর মাতে প্রকাশগত পার্থক্য কেবল, অস্তিত্বগত না?
সন্ন্যাসী বললেন, না।
শিল্পী বললেন, এ প্রকাশের তারতম্য কেন?
সন্ন্যাসী হাসলেন। বললেন, মাকে জিজ্ঞাসা কোরো।
=======
ঝড় থামল। সন্ধ্যেবেলা চাঁদ উঠল আকাশে। শরতকে চাবিগোছা ফিরিয়ে শ্রাবণ ফিরে গেছে অবশেষে। সন্ন্যাসীও অনেকক্ষণ গেছে ফিরে।
এমন সময় কচিকাঁচার দল ঠাকুরদালানে এলো খেলবে বলে। শিল্পী এক কোণে বসে তাদের খেলা দেখছে।
হঠাৎ একজন বাচ্চা বলে উঠল, আমি মা, তোরা আমার ছেলেমেয়ে, যা যা তোরা পড়তে বোস। আমি রান্না চাপাই।
একজন বলল, বাবা কে হবে?
তাই তো...বাবা কে হবে?
হঠাৎ তাদের চোখ পড়ল, শিল্পীর দিকে। তার দিকে তাকিয়ে একজন শিশু বলে উঠল, ওই তো.. এই তুমি খেলবে? বাবা হবে গো তুমি? তোমায় কিছু করতে হবে না... ওই সিঁড়ির উপর বসে খালি মিছিমিছি হুঁকো খাবে, আর বলবে, কী গো... রান্নাবান্না হল.... ব্যস.... এইটুকু পারবে না?
শিল্পীর চোখ পড়ল মায়ের মুখের দিকে। সেখানে চোখ আঁকা হয়নি। তাকালো বাচ্চাগুলোর দিকে, এতগুলো চোখ তার দিকে তাকিয়ে। এ কি মায়ের চোখ না!
শিল্পী সজল চোখে মনে মনে সেই সন্ন্যাসীকে প্রণাম জানিয়ে সিঁড়ির উপর এসে বসল। তার মাথার উপর তখন লক্ষ তারা নিয়ে চাঁদ ভাসছে মহাকালের আনন্দসাগরে।