ডাক্তার বললেন, চোখ বন্ধ করেন। কি দেখছেন?
- একটা সবুজ লুঙ্গি পরা লোক, গায়ে সাদা জামা, গলি দিয়ে হেঁটে হেঁটে আসছে। দেখে মনে হচ্ছে চারদিন কিছু খায় নি। বেশি বললাম, দুই দিন হবে। চারদিন না খেলে মানুষ ওভাবে হাঁটে কি? আপনার কি মনে হয় ডাক্তারবাবু?
- কি মুশকিল, আমি কি দেখতে পাচ্ছি? আপনি কি দেখছেন আমি কি করে দেখব।
- আচ্ছা, তাও বটে। আপনি জানলাটা একটু খুলবেন?
- কেন?
- একটা বিড়ি খাব। বিড়ি না খেলে আমি ভাবতে পারি না।
- বিড়ি খাওয়া স্বাস্থ্যের পক্ষে খারাপ।
- না খাওয়া মনের পক্ষে আরো খারাপ, মনেরও তো একটা স্বাস্থ্য আছে, আর আপনি তো মনেরই ডাক্তার, আপনি কেন বিড়ি খেতে বারণ করবেন।
- চুপ করেন, মেলা কথা বলবেন না।
মিঞা সাহেব উদাস দৃষ্টিতে জানলা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে রইলেন। একটা চেক চেক লুঙ্গি, একটা সবুজ ফতুয়া গায়ে, দাড়িতে মেহেন্দি করা। বয়েস পঞ্চাশের উপর। বাড়ির লোক বলে তার নাকি মাথা খারাপ হয়েছে, তাই নিজেই আজ সদরে এসে ডাক্তারের খোঁজ করতে করতে এই মুস্তাফি সাহেবের খোঁজ পেয়েছেন। মালদায় ইনিই সবচেয়ে নাম করা --- লোকে বলে। কত পাগল যে ঠিক করেছেন তা ভাবতেও নাকি পাগল হতে হয়।
- আপনি মোরব্বা খেয়েছেন?
- না খাইনি, কেন?
- আমার আব্বা খেতেন। চিকিৎসকের মোরব্বা খাওয়া ভালো। আব্বা বলতেন। মাথা ঠাণ্ডা রাখে। আপনার বাড়িতে কে কে আছেন?
- দুই মেয়ে, এক ছেলে, আর আমার ওয়াইফ।
- আচ্ছা, নিকা হয়েছে কারো।
- না, হবে, কথা হচ্ছে, বড় মেয়ের।
- কোথায়?
- মুন্সীগঞ্জে।
- মুন্সীগঞ্জের কোথায়? সেখানে আমার বড় ছেলের চাকরি, আমার খুব যাতায়াত।
- মুখার্জীদের বাড়ির বড় ছেলের সাথে।
- প্রেম
- হুঁ
- মানল ওরা
- প্রথমে অসুবিধা ছিল, পরে ঠিক হল।
- আপনি মেনেছেন?
- বুঝি না...
- হুম, আমার স্ত্রী হিন্দু, মঞ্জুলা, কি সুন্দর নামটা না?
- হুঁ
- ওপার বাংলার মেয়ে, কলেজে পড়ি, প্রেম হল। চার বছর প্রেম। চাকরি হল স্টেট গভারমেণ্টে। শাদীর কথা বলি কি করে? অবশেষে একদিন দিলাম বলে। আব্বাজান চোখ বড় বড় করে শুনলেন। আম্মির দিকে তাকিয়ে বললেন, তবে? আম্মি বলল, লোকে কি বলবে? কয়েক সপ্তাহ কি টানাপোড়েন। আমাদের ওদিকে এখনও গ্রাম, তখন তো জঙ্গল। আমি পালালাম মঞ্জুলারে নিয়ে কলকাতায়। সাত বছর টানা ছিলাম। তারপর গ্রামে ফিরলাম। প্রথম প্রথম কয়েক মাস কথা শুনলাম এটা সেটা, তারপর এখন সেসব ভুলেই গেছে।
- আপনার ব্যামোটা কিসের? আমি তো কিছুই বুঝি না।
- আমি ভুলভাল স্বপ্ন দেখি।
- কি দেখেন?
- দেখি মাটির মধ্যে থেকে পোকার মত কিছু মানুষ আসছে, উড়তে উড়তে রক্তের মধ্যে ঢুকে পড়ছে সবার। রক্তের রং পাল্টে দিচ্ছে। রক্ত ঘন হয়ে মাথার মধ্যে জমাট পাকাচ্ছে। মাথাগুলো কাজ করছে না কারোর। কানের ভিতরে পোকাদের গুঞ্জন। নাকে রক্তের সোঁদা গন্ধ। আকাশ থেকে কারা যেন নামছে, ফরিশতাহদের মত দেখতে, কিন্তু তারা ফরিশতাহ না। তাদের সারা গায়ে চোখ, কিন্তু সব কটা চোখ অন্ধ।
- তারপর?
- তারা মানুষের কানে কানে কি সব বলছে। তাদের চামড়ার সাথে লাগানো ঝাঁকায় ঝাঁকায় বই। সেগুলো থেকে শিকড় নেমে আছে। সেই বইগুলো নিয়া তারা তাদের মাথায় ধুলো ঝাড়ছে আর বলছে, জাগো জাগো... তাদের মাথায় গিয়ে সেই শব্দগুলো হয়ে যাচ্ছে, ঘুমাও ঘুমাও। তারা ঘুমাচ্ছে। পোকাগুলো জেগে যাচ্ছে। হাতের পেশী ফুলে যাচ্ছে। দাঁতের গঠন পাল্টে যাচ্ছে। বুকের মধ্যে বইগুলোর শিকড়ের মত কিসব জড়িয়ে যাচ্ছে, হৃৎপিণ্ডটা চলছে, কিন্তু অনুভব করতে পারছে না কিছু।
- কতদিন হল হচ্ছে?
- চার বছর প্রায়।
- হুম...
- সারবে না, না?
- না, কারণ একই স্বপ্ন আমিও দেখি।
- মেয়ের নিকা ঠিক হওয়ার পর থেকে?
- হুম।
- আসবেন নিকায়?
- আসব।
- কান্না পায়?
- পায়, কাঁদি।
- আমিও কাঁদি।
- এর কি শেষ নাই?
- আছে, ডারউইন বলেছেন, নাম শুনেছেন?
- হ
- মানুষ যেদিন বাঁচতে চাইবে সেদিন সে বুঝবে ঘুমালে ঘুম বাড়ে। চলার বাঁক বদলাতে হবে।
দু'জনেই চুপ করে বসে কিছুক্ষণ। মিঞা সাহেব উঠলেন, ডাক্তার বললেন,
- নিকায় আসবেন।
- আসব।
সৌরভ ভট্টাচার্য
9 July 2018