Skip to main content

ঝুলবারান্দায় দাঁড়িয়ে নিজের কথাগুলো সব পর পর বলে যাওয়া স্বভাব। মাথাটা উঁচু করে আকাশের দিকে তাকিয়ে অনর্গল এক দেড় ঘন্টা কথা বলে, নাক চোখ মুছে উনি ঘরে এসে বসেন। রোজকার স্বভাব। যত না আত্মীয়স্বজন মাটির উপর দাঁড়িয়ে, তার চাইতে অনেক বেশি আকাশে। একজন দূর সম্পর্কের ভাগ্নী ছাড়া কেউ নেই আজ সত্যি বলতে।

আজ সকালে ঝুলবারান্দায় দাঁড়িয়ে আকাশে থাকা ভাইয়ের সঙ্গে কথা বলছেন, আকাশের দিকে তাকিয়ে, হঠাৎ চোখ গেল সামনের ফ্ল্যাটের ঝুলবারান্দায়, এক কিশোর টুনি লাগাচ্ছে। কি নাম? জানেন না। কারোরই নাম জানেন না। ইলেকট্রিসিটি বোর্ড থেকে রিট্যায়ার করার পর থেকে কাউকে চিনতে ইচ্ছা করে না। কারোর নাম জানতে ইচ্ছা করে না।

এই ছেলে... এই ছোঁড়া.. এই যে এদিকে…. টুনি লাগাচ্ছ কেন?

কালীপুজো না সামনে... আপনার কথা বলা হয়ে গেছে…. ওই ওদের সঙ্গে?.... ছেলেটা আকাশের দিকে ইঙ্গিত করল।

প্রসন্নবাবু মাথাটা কাত করে নীচে লনে হেঁটে যাওয়া এক ছাতার দিকে তাকিয়ে দেখলেন, সেকি কথা শুনছে? শুনছে না। ছাতাটা নাচতে নাচতে হেঁটে যাচ্ছে।

ছেলেটার দিকে তাকিয়ে বললেন, বললাম।

ছেলেটা বলল, আমার মা বলেন, আজ রাতে আমাদের সব পূর্বপুরুষরা আসবেন। চোদ্দগুষ্টি। চোদ্দোশাক খেতে আর চোদ্দো প্রদীপ দেখতে। আপনি দেবেন না প্রদীপ? শাক রেঁধেছেন?

প্রসন্নবাবু বাঁ পায়ের বুড়ো আঙুলটা রেলিঙের মধ্যে ঢুকিয়ে দাঁড়ালেন। আঙুলে চাপ লাগছে। লজ্জা লাগলে নিজেকে কষ্ট দেওয়া অনেককালের স্বভাব প্রসন্নবাবুর। বললেন, না না, আমাদের কাজের লোক, রান্নার লোক ওসব পারে না। ওরা মুসলমান। ওদের ওসব নেই।

তুমি বললেও দিয়ে দেবে না? আমি আসব? তুমি দেবে চোদ্দো প্রদীপ? আর শাক না হয় মা রেঁধে দেবেন নিয়ে আসব। তোমার আপত্তি নেই তো? বাই দ্য ওয়ে, তুমি কিন্তু হেব্বি ভায়োলিন বাজাও। তুমি টাইটানিকের গানটা বাজাবে আমি ভাবতেও পারি না... আমি আমার বন্ধুদের লাইভ শুনিয়েছি…. যতটা শব্দ আসে ওতেই ওরা ফিদা... ওরাও তোমায় মিট করতে চায়... বেশিজন না…. সুইটি, কুহেলী, প্রশান্ত আর ফরজানা... তুমি কি বলো?

এত কথা শোনা অনেকদিন অভ্যাস নেই। মাথাটা ঝিমঝিম করছে। প্রসন্নবাবু কোনো কথার উত্তর না দিয়ে ঝুলবারান্দা থেকে ঘরে ঢুকে দরজাটা ধড়াম করে বন্ধ করে দিয়ে নিজের ঘরে এসে শুলেন।

প্রসন্নবাবু কোনোদিন 'লোকে কি বলবে' এই ভাবনার তোয়াক্কা করেননি। বিয়ে করেছিলেন, ছেলেমেয়ে হয়নি, মেনে নিয়েছেন। স্ত্রী সেপারেশন চেয়েছেন, দিয়েছেন। ভাইরা সম্পত্তি নিয়ে অশান্তি করতে চেয়েছে, অশান্তি করতে দিয়েছেন, নিজে পৈতৃক সম্পত্তি কিছু না নিয়েই। এই ফ্ল্যাটটা কিনেছেন। বন্ধুর ছেলে অনেক টাকা দিয়ে ডেকরেশান করে দিতে চেয়েছে, করতে দিয়েছেন। ঠকছেন জেনেও করতে দিয়েছেন। মানুষের ঠকানোতে অবাক হন না। মানুষের সঙ্কীর্ণতায় আঘাত পান না। খারাপ লাগে কেউ অকারণে ভালোর অভিনয় করলে। তার সামনে আবার ওসব কেন? এইসবের জন্যেই প্রসন্নবাবু মানুষের কথায় কিছু মনে করেন না। কিন্তু ছেলেটা এত কথা কেন বলছে?

প্রদীপ দেওয়াই যায়, কিন্তু কে ঝক্কি করবে! বাজারেই বা কে যাবে! ধুর! যারা আকাশে আছে তারা তো রোজই তার কথা শুনছে, আজ আবার প্রদীপ জ্বেলে ঘটা করে ডাকার কি আছে?

প্রসন্নবাবুর চোখটা লেগে এসেছিল, কলিংবেলের আওয়াজ শুনে ঝটকা লাগল। সাড়ে এগারোটা। দরজা খুলে দেখেন সেই কিশোর। লাল টিশার্ট আর সবুজ হাফপ্যান্ট পরে তার সামনে দাঁড়িয়ে। হাতে বাটি, ঢাকনা দেওয়া। মানে চোদ্দোশাক। পিঠে ওটা কি? গিটার? কিন্তু কেন?

ছেলেটা হাসল। বলল, মে আই?

ছেলেটা ঘরে ঢুকতে চায়। কিন্তু কেন? ওরা কি গুষ্টিশুদ্ধ চোর, ঠগবাজ? তার নলি কেটে সব সম্পত্তি হাতিয়ে নেবে? শাকের সঙ্গে কি বিষ না ঘুমের ওষুধ মেশানো?

ছেলেটা সোফায় বসে। টেবিলে বাটিটা ঢাকা। ছেলেটা বলল, আমি তোমায় এম্বারাস করছি…. কনফিজড করছি…. ভাবছ কি মতলব... তাই তো?.... আছে…. আমায় ভায়োলিন শেখাবে?... জাস্ট লিসন টু মি... আমি তোমায় ডিসাপয়েন্ট করব না…. একবার শোনো আমায়... বাই দ্য ওয়ে…. আমি ঋক... ফার্স্ট ইয়ার... অ্যাকাউন্টেন্সি অনার্স

মানে তুমি কিশোর নও। মানে যুবক। কিন্তু না, তুমি কিশোর। ছেলেটার চোখদুটো ভীষণ ব্রাইট। গিটারটা খুলে টিউন করছে। প্রসন্নবাবুর সুর শুনলে বুকের ভিতর জঙ্গলে মর্মরধ্বনি ওঠে। ঝর্ণার শব্দে মাথা-বুক ভেসে যায়। পেটের পেশিতে চাপ লাগে।

ছেলেটা বাজাচ্ছে, আগর তুম সাথ হো…. গাইছে…. মিষ্টি গলা…. আবেগ আছে.. মায়া আছে…. প্রসন্নবাবু বাঁ পায়ের বুড়ো আঙুলে তাল দিচ্ছেন। অল্প অল্প। মুখের পেশীগুলো শিথিল হচ্ছে। সারা শরীরের পেশী শিথিল হচ্ছে। স্নানের সময় হয়ে যাচ্ছে। আজ চিকেন আর ভাত রেঁধে গেছে আসমান... একার মত ভাত আছে। আজ প্রথম মনে হচ্ছে বাড়িতে দু'জনের মত ভাত থাকা উচিৎ।

বলো, কেমন লাগল ডুড….

বাচাল ছেলে। প্রসন্নবাবু বললেন, আমার স্নানের সময় এখন। তুমি এসো। আমি শাক খাই না। আমার পেট খারাপ হয়। থ্যাংক্স ফর ইউর কাইণ্ডনেস। আমি এতে অভ্যস্ত নই। প্লিজ ডোন্ট মাইন্ড ইয়ং ম্যান….

ছেলেটা অপ্রতিভ হল। গিটারটা গুটিয়ে পিঠে নিল। শাকের বাটিটা নিয়ে মাথাটা নীচু করে বেরিয়ে গেল। আত্মসম্মানে লেগেছে। লাগুক। এই বয়সেই টাফ হয়ে যাওয়া দরকার। খুব দরকার। সবাই খারাপ। এটা বুঝে গেলে এই ওয়ার্থলেস টেণ্ডার মনটা থাকবে না…. বি প্র্যাক্টিকাল ম্যান…. প্রসন্নবাবুর মনে কি একটা আনন্দ হচ্ছে। আনন্দ না উত্তেজনা? দুটোই প্রথমে একরকম লাগে। উত্তেজনাকে আনন্দ থেকে আলাদা করতে শিখতে হয়।

প্রসন্নবাবু খেতে বসেছেন, আবার কলিংবেল বাজল। এখন কে?

একজন মাঝবয়েসী ভদ্রমহিলা। নীল শাড়ি গায়ে, চোখে চশমা, হাত জোড় করে নমস্কার করলেন। আমি নীলাঞ্জনা। ঋক আমার ছেলে। একটু আগে যে আপনার কাছে এসেছিল। আমার বাবা গত মাসে মারা যান, নরম্যাল ডেথ, করোনা পজিটিভ ছিলেন। আমার শাশুড়ী, আমার শ্বশুরও মারা যান মোটামুটি মাসের এদিক ওদিক করেই। সবাই পজিটিভ ছিলেন। ঋক ভীষণ ডিপ্রেশনে চলে গেছে। আজ আপনাকে দেখে তাই….

ভদ্রমহিলা নিজেকে সামলে নিলেন। চোখটা ছলছল করতে করতে দাঁড়িয়ে গেল। যেন নাগরদোলায় কারেন্ট চলে গেল হঠাৎ। সব স্থির। কেউ আকাশে, কেউ মাটিতে।

আমি ঋককে আবার বাটিটা দিয়ে পাঠাচ্ছি। আপনি খাবেন। এটা আপনার দায়িত্ব। শুধু আপনার না, আপনার মত সবার দায়িত্ব, নইলে আমরা মানুষেরা নিজেদের একটা বৃহৎ পরিবার কেন বলি? আর শুনুন, রাতে আমি চোদ্দো প্রদীপ কিনে নিয়ে আসব। আজকের ডিনার আমিই রাঁধব। ওর বন্ধুদের আপনি ভায়োলিন শোনাবেন। আর হ্যাঁ, ওই টাইটানিকের গানটাই শোনাবেন। ওটা আজ শুধু প্রেমের গান হিসাবে বাজবে না... ওটা ওদের হারিয়ে যাওয়া মানুষদের গান, ভালোবাসার আশ্রয় হারানো গান হিসাবে বাজবে... আমি আসি। আপনার মনে হতে পারে সবটা জুলুম, কিন্তু জুলুমটুকু না করলে যে সমাজ বলে কিছু থাকবে না যে মেশোমশাই

হুস্ করে কারেন্ট চলে এলো নাগরদোলায়। চোখ থেকে জল বেরিয়ে এসে গাল গড়িয়ে পড়ল। নীলাঞ্জনা কাঁদছেন। প্রসন্নবাবুর গলায়, এঁটো মুখে-ঠোঁটে কান্না দমে। তিনি বললেন, আমি দাঁড়িয়ে আছি। ওকে পাঠান। না এলে আমি যাব। কিন্তু এখন আমার কান্না পাচ্ছে। আপনি চলে যান প্লিজ, আমি আজ অবধি কারোর সামনে কাঁদিনি, আমার লজ্জা লাগবে।

প্রসন্নবাবুর বাঁ পায়ের বুড়ো আঙুল স্থির। অধীর অপেক্ষায় সে, এগিয়ে যাওয়ার জন্য উন্মুখ, কদ্দিন পর!