Skip to main content

        চৌকির উপর দুটো পাতলা কাঁথা দিয়ে বানানো বিছানায় শুয়ে শুয়েই সুবাস বুঝতে পারল বৃষ্টিটা ধরেনি। গতকালও সারাদিন হয়েছে। এখন আন্দাজ ভোর সাড়ে পাঁচটা হবে। সুবাস উঠে বসল। দুটো শীর্ণ হাত জড়ো করে সামনের দেওয়ালে টাঙানো রাধাকৃষ্ণের ছবিতে প্রণাম করল। ফর্সা হাতদুটোতে নীলচে শিরার রেখা। মন্দিরের পিছনেই নদী। চূর্ণী নদী। সুবাস স্নান সেরে বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতেই ফুল তুলতে লাগল। সকালটায় চশমা পরে না। বেলায় ঠাকুরমশায় এলে ভোগ রাঁধতে বসে যখন চশমা পরে। এই মন্দিরে সুবাসের প্রায় তিরিশ বছর হয়ে গেল। এখন তার বয়েস বাষট্টি।

        মন্দিরের চারদিকে উঁচু পাঁচিল তোলা। এই বাগানের বহু গাছ সুবাসের নিজের হাতে লাগানো। সে গাছে হাত দিলেই বুঝতে পারে কোন গাছ কেমন আছে। কার কবে কুঁড়ি হবে। কবে ফুল ফুটবে। কবে ঝরে যাবে। লোকে বলে ভালোবাসা না পেলে মানুষ আধমরা হয়ে বেঁচে থাকে। সুবাস জানে শুধু মানুষ না, গাছেরাও আধমরা হয়ে বেঁচে থাকে।
        বাবুরা কলকাতায় থাকে। উৎসবে আসে, কি হঠাৎ খেয়াল হলে আসে। ছোটোবাবু তার হাতের রান্না খেতে খুব ভালোবাসে। ছোটোবাবু তার থেকে দু'বছরের ছোটো। বড়বাবু গত হয়েছেন। রাশভারি লোক ছিলেন। অকৃতদার। তিনিই ফুলিয়া থেকে সুবাসকে নিয়ে আসেন। ব্রাহ্মণের নিঃসন্তান বিধবা। শকুন উড়তে শুরু করেছিল। একটা আধটা আঁচড়ও যে কাটেনি তা না। সুবাস সুন্দরী ছিল, এখনও বোঝা যায়। বড়বাবু মহৎ হৃদয় মানুষ ছিলেন। শুধুই সুবাস! কত মানুষের যে মাথায় ছাদ, মেয়ের বিয়ে, পড়াশোনার খরচ জুগিয়েছেন তার ইয়ত্তা নেই।
        সুবাস প্রথম মন্দিরে আসে যেদিন সেদিনও খুব বৃষ্টি হচ্ছিল। সেদিন সন্ধ্যেবেলাটা মনে পড়ে সুবাসের, জন্মাষ্টমীর দুইদিন আগে। সুবাস দুটো কীর্তন গেয়েছিল। গোবিন্দদাস আর বিদ্যাপতির পদ। বাবার কাছে শেখা। বাবা খুব বড় কীর্তনীয়া ছিল। স্বামীও, যাত্রা করে ফেরার পথেই তাকে সাপে কাটল। সুবাস কাঁদেনি, গেয়েছিল, কীর্তন, একা। এখানে যেদিন সে আসে সেদিনেই প্রথম ছোটোবাবুকে দেখেছিল। ওরকম রূপ সে আগে দেখেনি – "রূপে যে তার আগুন আছে / হৃদয়খানি ঢেলে দিলাম" এই লাইন ক'টা গাইতে ইচ্ছা করেছিল, 'রাইকমল' সিনেমায় শুনেছিল, মুখস্থ ছিল। গাইতে সাধ যায়নি কোনোদিন, ছোটোবাবুকে দেখে সে গানের কথা মনে পড়েছিল। সুবাস পুড়েছিল। বাইরে সেদিন তুমুল বর্ষা।
        সুবাস হাতের দশটা আঙুল সামনে মেলে ধরে। মুখের সামনে হাতটা এনে, একবার আঙুলগুলো ফাঁক করে দূরে সরায় আবার জড়ো করে কাছে আনে। সুবাসের দুপুরের খেলা এটা। এই কাছে যাওয়া আবার দূরে আসাটা ভালো লাগে সুবাসের। যেন কলকাতা থেকে শান্তিপুর, আবার শান্তিপুর থেকে কলকাতা।
 বৃষ্টির বিরাম নেই। তারই মধ্যে সুবাসের ফুল তোলা হল। সুবাস মন্দির পরিষ্কার করে একবার ক্যালেণ্ডারের দিকে গেল। দেখতে পাচ্ছে না। ঝাপসা। চশমা পরল, অনেকদিন পর আজ এত সকালে চশমা পরল। ছোটোবাবু থাকলে পরে। তার ছানি কাটা চোখ ঝলসে ওঠে, আগে জ্বর জ্বর লাগত, এখন শুধু মনটাই পোড়ে। এই পোড়াটাই তার সাধনা। আরো বারো দিন বাকি রথের। ছোটোবাবু আসবে। ওই ক'দিন ছোটোবাবু থাকে। ওনার স্ত্রী গত হয়েছেন চার বছর হল। আরো আত্মীয়েরাও আসে, মন্দির গমগম করে। মন্দির লাগোয়া ঘরগুলো রথের আগে থেকেই ঝাড়াপোঁছা শুরু হয়। মন্দিরের দক্ষিণদিকে দোতলা যে ঘরটা, ওতেই ছোটোবাবু ওঠেন। সুবাস নিজের হাতে পরিষ্কার করে ঘর। মুখশুদ্ধি ভরে রাখে কৌটায়, নিজে মৌরি ভেজে বানায়।
        সুবাস আজ আগেই কুটনো কাটতে বসল। ভিজে কাপড়ে থাকে না সাধারণত, আজ ছাড়ল না। মন্দিরের চাতালে একটা কুকুর ঘুমাচ্ছে। থাক, বৃষ্টিতে কোথায় যাবে? একনাগাড়ে বৃষ্টির শব্দ শুনতে শুনতে সুবাস কিছুটা অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিল, মন্দিরের ফোনটা বাজতে উঠে গেল। ছোটোবাবুর হার্ট অ্যাটাক হয়েছে গতকাল রাতে। নার্সিং হোমে ভর্তি। সুবাস ফোনটা রেখে আবার কুটনো কুটতে বসল। কুটনো কাটা শেষ হল। মন্দিরের চাতালে এসে বসল। বৃষ্টি হয়েই যাচ্ছে। সামনে বড় রাস্তা। কিছু দূরে স্টেশান। রাস্তায় ভিড় বাড়ছে, ছুটোছুটি বাড়ছে। সব অফিস যাচ্ছে, কলকাতায়, হাতিবাগানে ছোটোবাবু থাকেন। সুবাসের কান্না পাচ্ছে না। তার মাথার মধ্যে বিদ্যাপতি – 'ভরা বাদর, মাহ ভাদর, শূন্য মন্দির মোর।' কে একজন যেন পেটের মধ্যে একটা মোচড় দিয়ে, গলার কাছে একটা কান্নার ধাক্কা দিল। সুবাস সামলে নিল, পুরোহিত মশায় আসছেন, খবর পেয়েছ?... ছোটোবাবু...
- জানি, নার্সিং হোমে।
- হুম, ফোন করেছিল? আইসিইউ তে...
        রান্নাঘরের ছাদ থেকে জল পড়ছে। উনুন একটা দিকে সরিয়ে নিয়ে গেছে সুবাস। ভোগ রাঁধতে বসল।
        সুবাস!
        সুবাস চমকে পিছন ফিরে তাকালো, ছোটোবাবু!
        সেই সাদা ধুতি, সাদা পাঞ্জাবী, গলায় ওই তো সেই সোনার চেন, চোখে শুধু কাঁচের চশমা, চারদিকে কালো ঘেরাটা নেই, কাকভেজা ভিজে। সুবাস নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছে না। এরকম করে তো ডাকেন না কখনও। সুবাস নিজেকে সামলিয়ে উঠে গিয়ে বলল, আসুন। ছোটোবাবু রান্নাঘরে ঢুকতেই সে দৌড়ে নিজের ঘরে গিয়ে একটা গামছা নিয়ে এলো। ছোটোবাবুর হাতে দিয়ে বলল, মুছে নিন। তারপর নিজেই চাবির গোছা নিয়ে ছোটোবাবুর ঘর থেকে একজোড়া শুকনো ধুতি-পাঞ্জাবি নিয়ে এলো। আসার আগে একবার নিজের ঘরে গেল, দোর দিল। আয়নার সামনে এসে দাঁড়ালো। বুকের থেকে শাড়িটা সরালো। স্তনযুগলের মধ্যে সিঁদুরের দাগ। সেই দাগের উপর সে আর এক বিন্দু সিঁদুর দিল। আয়নায় নিজেকে দেখল। এ দাগের কথা শুধু কৃষ্ণ জানে, তার অন্তর্যামী।
        শুকনো কাপড় ছোটোবাবুর হাতে দিয়ে সে বাইরে এসে দাঁড়ালো, বৃষ্টিতে। মুষলধারে বৃষ্টি পড়ছে। পড়ুক। রাস্তাঘাট সব ভেসে যাক। উনি যেন আর ফিরতে না পারেন। এতবার তো ফিরলেন, আর কতবার ফিরবেন তিনি কৃষ্ণ? আর কতবার? সংসারে কিচ্ছু তো চাইনি কৃষ্ণ, সারাটা জীবন অনেক অন্যায় করেছ তুমি, আমি চুপ করে থেকেছি, মানুষের শরীর দিয়ে ভুলেই গেছ কি কি চাই একটা মানুষের বাঁচতে, আমি মনেও করাইনি, তুমি ব্যস্ত, কিন্তু এই প্রান্তবেলায় কৃষ্ণ... পারো না ওকে দিতে, সংসারে সব কর্তব্য তো ওর শেষ হয়েছে কৃষ্ণ, মৃত্যুর আসার আগে এই ক'টা মুহূর্ত পারো না দিতে?
        রান্নাঘরের দরজা খুলল। শুকনো পোশাকে দাঁড়িয়ে ছোটোবাবু তার দিকে তাকিয়ে। সুবাস ভিজে একসা। লজ্জায় কুঁকড়ে গিয়ে বলল, ভোগের রান্নাটা...
        ছোটোবাবু দরজাটা ছেড়ে বললেন, এসো। সুবাস মাথাটা নীচু করে রান্নাঘরে ঢুকল। ছোটোবাবু দরজাটা বন্ধ করে দিলেন। বাইরের তুমুল বৃষ্টি সেই দরজার উপর আছাড়িপাছাড়ি খেয়ে পড়তে লাগল।

        সুবাস উনুনের পাশেই উপুড় হয়ে পড়েছিল, মৃত, ভিতর থেকে দরজা বন্ধ ছিল, এরকম করে না কোনোদিন, পুরোহিত বলল, হাওয়ার দমকে উনুন নিভে আসছিল হয়ত। সুবাসকে দাহ করতে নিয়ে গিয়ে কিছু মহিলা তার বুকের মধ্যে সিঁদুরের দাগ দেখেন, কৃষ্ণঅন্তপ্রাণ ছিল তো, ওই তার স্বামী। চিরকালীন সধবা সে। তার পায়ে আলতা দেওয়া হল, কপালে সিঁদুর দেওয়া হল। দাহ কাজ সারতে সারতে বিকাল পাঁচটা বাজে। আষাঢ়ের মেঘলা বর্ষণমুখর বিকালে চিতার ধোঁয়ায় সুবাস মিলিয়ে গেল বাতাসে, ভেসে চলল কলকাতার আকাশে, ভিজে বাতাসে ভর করে, যেখানে আজ তার মিলনের অপেক্ষার অবসান, কুঞ্জ সাজিয়েছে আষাঢ়ের আকাশ। কি কহব রে সখী আনন্দ-ওর... চিরদিন মাধব মন্দিরে মোর।
        ছোটোবাবু মারা যান সেদিন সন্ধ্যেতে ছ'টা নাগাদ। তখনও তুমুল বৃষ্টি হচ্ছিল।