Skip to main content

প্রতিদিন ভোরে লোকটার মাথার কাছে একটা চিরকুট রেখে যায়। সেই চিরকুটে কোনোদিন লেখা থাকে ভৈরব, কোনোদিন সাহানা, কোনোদিন হিন্দোল, কোনোদিন পটদীপ এরকম নানা রাগের নাম।
      সে সারাদিন তার সেতারে সেই সুরটা সাধার চেষ্টা করে। যেই তার মনের মত হয়, অমনি একটা অদ্ভুত সুগন্ধে তার মন ছেয়ে যায়। যেন কারোর বাগানে ফোটা ফুল। লোকটা খোঁজ নেয় না কার বাগানের ফুলের গন্ধ, কিম্বা কে চিরকুট রেখে যায়। সে যেন জানে, আবার জানেও না। সুরটা তুলতে পারলে খুশী হয়। না পারলে কষ্ট পায়।
      একবার খুব বৃষ্টি হচ্ছে, চিরকুটে লেখা এল, রামদাসী মল্লার। সে শুনল না। সে সারাদিন বাজাল দেশ। রাতে একটা বাজ পড়ে তার বাগানের সব ফুলগুলো নষ্ট হল। লোকটা ক্ষমা চেয়ে বলল, আর হবে না। পরেরদিন চিরকুটে লেখা এল, জয়জয়ন্তী। সে বাজাল। কাঁদল। তার সারাঘর ভরে গেল সেই অজানা সৌরভে। যেন পারিজাতের গন্ধ।
      আজ কয়েকদিন হল মানুষটা কোনো চিরকুট পাচ্ছে না। সারারাত ঘুম আসছে না। সারাদিন সুর লাগছে না। সে যেন প্রায় উন্মাদ হয়ে যাচ্ছে এমনই তার অবস্থা। একে তাকে জিজ্ঞাসা করে, আপনি কি বাজাচ্ছেন? যে যা বলে সে বাড়ি এসে তাই বাজাবার চেষ্টা করে। সুর লাগে, কিন্তু সে মূর্ছনা কই? সে কাঁদে। পাগলের মত ডাকে কোনো অজানা কাউকে। পায় না। তবে কি তার সুর হারালো?
      একদিন শেষরাতে এক করুণ ডাকে তার ঘুম ভাঙল। দেখল একটা পাখির শাবক তার বাসা থেকে পড়ে গিয়ে মাটির মধ্যে ডানা ঝাপটাচ্ছে। লোকটা শয্যা ছেড়ে বাইরে এসে, তাকে ডান হাতের চেটোয় নিল, শাবকের আকাশে ওড়া ডানায় লেগে ধুলো, তার কান্না পেল। সে শাবকটাকে নিয়ে ধীরে ধীরে গাছে উঠতে শুরু করল। তাকে তার বাসায় রেখে যেই নামতে শুরু করেছে গাছ থেকে অমনি তার মধ্যে কি একটা সুর যেন বেজে উঠল। সে তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরে এসে বসল সেতার নিয়ে। কিন্তু আলাপটা শেষ হওয়ার আগেই একজন এসে তার দরজার সামনে দাঁড়াল। একজন অন্ধ, সে বলল, বাবা নদীতে কি জোয়ার এখন?
      লোকটা বেরিয়ে তার বাড়ির পিছনে গিয়ে নদীর চেহারা দেখল, শুধু জোয়ারই নয়, এ যেন বাণ ডেকেছে। সে ফিরে এসে অন্ধকে বলল, নদীতে বাণ এসেছে।
      অন্ধ বলল, তাই খেয়া পারাপার বন্ধ। কিন্তু আমার যে ওপারে যেতেই হবে। আমার নাতনিটার খুব জ্বর।
      লোকটা বলল, কিন্তু আপনি যাবেন কি করে? আপনি বসুন, খানিক পরেই নদী শান্ত হবে, তখন আমি নিজে আপনাকে গিয়ে খেয়ায় তুলে দিয়ে আসব।
      এই বলে সে অন্ধ মানুষটার জন্য স্নানাহারের ব্যবস্থা করতে লাগল। তার বুকের মধ্যে আবার সেই সুরটা বেজে উঠল যার আলাপটা অসম্পূর্ণ বাজানো।
      অন্ধ মানুষটা যখন গেল তখন সারা আকাশ জুড়ে তারা। মানুষটা তার সেতার নিয়ে উঠানে এসে বসল। খানিক দূরে নদীর কুলকুল আওয়াজ। দূরে নারকেল বনের বাতাসে কেঁপে কেঁপে ওঠার আওয়াজ। সুরটা তখন তীব্র মধ্যম, মধ্যম আর কোমল গান্ধারকে ছুঁয়ে ছুঁয়ে আসছে। মানুষটা দেখল সারা আকাশ জুড়ে তারারা যেন চিরকুট। কিন্তু তার মন টানল কই? সে এখন না চিরকুটের অপেক্ষায় না লোকের অপেক্ষায়। সে সুরের উৎস যেন খুঁজে পেয়েছে। সে তো না তাকে নিয়ে শুধু, না তো তাকে ছাড়া। সুরের মূর্ছনায় ডুবতে ডুবতে সে অনুভব করল নীড়ের ভিতর থেকে তাকানো দুজোড়া চোখ তার বন্ধ চোখের উপর, অন্ধের আশীর্বাদী স্পর্শ তার মাথার উপর।