ঘড়িটা খুলে পকেটে ঢোকালো। ফোনটা ব্যাগে নিয়ে নিল। ফোন আর ঘড়ি, দুটোই চুরি হয়েছে দমদম থেকে বেলঘরিয়ার মধ্যে আগে বেশ কয়েকবার। অফিস টাইমে বিধাননগর থেকে ট্রেনে ওঠা এক যুদ্ধ!
নিলয় ব্যাগটা সামনে বুকের কাছে নিয়ে প্রস্তুত। ট্রেনের আলো দেখা যাচ্ছে। বাঁক ঘুরল। আপ কৃষ্ণনগর। নিলয় যাবে কল্যাণী, বাড়ি ফিরছে। সেক্টর ফাইভে আইটিতে কাজ করে।
উঠেই আটকে গেল। কয়েক পা গিয়ে। ভিতরে ঢুকতে ঢুকতে সোদপুর। ফেরার সময় ট্রেনের ঠিক থাকে না। সব সময়ই নতুন মুখ। কিছু পুরোনো মুখ হয় অবশ্য।
সোদপুর পেরিয়ে যেতেই নিলয় ভুরু কুঁচকে তাকালো। উল্টোদিকের সারিতে জানলার কাছে বসে হরেনকাকা। বাবার কম্পাউণ্ডার ছিল। বাবা মারা যান হঠাৎ, চেম্বারেই হার্ট অ্যাটাক। হরেনকাকাও হারিয়ে যায়। কিন্তু একি চেহারা হয়েছে?
অস্বস্তিতে পড়ল নিলয়, কি করবে? যাবে? কিন্তু অবস্থা তো ভালো নয়ই মনে হচ্ছে… যদি সাহায্য চায়… এতো দু'দিনের পরিচয় নয় যে যা হোক একটা দিলেই হবে…
পিছন ফিরে দাঁড়ালো নিলয়। ব্যাগটা বাঙ্কে তুলে দিল।
মায়ের যখন ইউটেরাস অপারেশান হয় তার দেখাশোনা করত হরেনকাকাই। বাবা তো রাতদিন মায়ের কাছেই। নিলয় তখন এইটে পড়ত। বিকেলে বেড়াতে নিয়ে যাওয়া। রোজ ক্যাডবেরি কিনে দেওয়া। কোনোদিন পার্কে রাইডে চড়ানো। সিনেমা দেখানো। টাকা কি বাবা দিতেন? নাকি হরেনকাকাই?
একবার ফিরে আড়চোখে তাকালো নিলয়। এখনও ঘুমাচ্ছে। কিন্তু চেহারা এত খারাপ কি করে হয়? ক্যান্সার-ট্যান্সার, নাকি সুগার? ভিড় কিছুটা হলেও পাতলা। বারাকপুর ছাড়ল। খিদে পাচ্ছে। কিন্তু বাদামওয়ালা কি পাঁপড়ওয়ালাকে ডাকলে যদি গলা শুনে ফিরে তাকায় হরেনকাকা। তার মুখের দিকে তাকায় যদি। যদি হাসে। যদি ডাকে। যদি বলে নানারকম অসুবিধার কথা? যদি মাঝে-মাঝেই আবার বাড়ি আসা শুরু করে। মল্লিকা এগুলো একদম পছন্দ করবে না। সে-ও না। এই বাজারে বার্ডেন বাড়ানো মানে সুইসাইড!
নিলয় আবার জানলার দিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে। বসার সিটও পাচ্ছে না একটাও। বসলেও কিছুটা স্বস্তি। আড়াল।
হরেনকাকা বাবাকে নিয়েও লড়েছে অনেক। একবার বাবার চেম্বারে ভাঙচুর হয়। একটা ডেলিভারি কেস নিয়ে। হরেনকাকা বাবাকে বাঁচাতে গিয়ে নিজের কপাল ফাটায়। মা-কে আর তাকে নিয়ে রাতের বেলা মামাবাড়ি খড়গপুর রেখে আসে। একগ্লাস জল খেয়েই মামাবাড়ি থেকে বেরিয়ে আসে, নইলে বাবাকে কে দেখবে?
কাঁকিনাড়া পেরোলো। হরেনকাকার বাড়ি নৈহাটি ছিল না? নিলয়রা তখন কাঁচরাপাড়ায় থাকত।
নিলয় ফিরে তাকালো। কই? একজন মহিলা বসে তো…
নিলয় চমকে গেল। কি যেন হল, ব্যাগটা নিয়ে বাঙ্ক থেকে দরজার কাছে এসে দাঁড়ালো। নৈহাটিতে নামার ভিড়। হরেনকাকার মাথা দেখা যাচ্ছে। খুব বড় অন্যায় করে ফেলছিল সে। বাবা খুব কষ্ট পেতেন বেঁচে থাকলে। হ্যাঁ একটু সেন্টি হচ্ছে সে। হোক। এটুকু না হলে বাঁচা যায় না।
ভিড় নামল হুড়মুড় করে নৈহাটি। সঙ্গে সঙ্গে ওঠার ভিড়ও। নিলয় নেমে গেল নৈহাটি। হরেনকাকা সামনে সামনে হাঁটছে। নিলয় দৌড়ে গিয়ে কাঁধে হাত রাখল…
কাকা চিনতে পারছেন?… আমি পুটু… কাঁচরাপাড়ার শঙ্কর ডাক্তারের ছেলে….
নিলয়ের গলা ধরে এলো। এতটা গভীর অনুভব ছিল!.. অপরাধবোধ ছিল হরেনকাকাকে নিয়ে!… কত অপরাধবোধ নিয়ে যে বাঁচে মানুষ…. এত ভার…
হরেনকাকা তাকালো মুখের দিকে। হাসল অপরাধীর মত। বলল, আপনি ভুল করছেন… অনেকেই করে… আমি হরেনের ভাই… সত্যেন…. আমাদের অনেকটাই এক দেখতে….
নিলয় কিছু শুনতে পারছে না যেন… কি একটা অ্যানাউন্স হচ্ছে…. সে জড়ানো শুকনো জিভটা দিয়ে জোর করে যেন উচ্চারণ করল… হরেন কাকা….
গত বছর করোনায় মারা গেল…. আমরা অনেক চেষ্টা করেছিলাম….. আমারও হয়েছিল…
নিলয়ের গলা বুজে আসছে। নাকের কাছটায় যেন দশটা ডেঁয়ো পিঁপড়ে কামড়ালো। আপ কল্যাণী লোকাল ঢুকছে। আচ্ছা আসছি কাকা…, বলে লাফ দিয়ে ট্রেনে উঠল… হারিয়ে যেতে চাইল…গেলও….
বহুযুগ পর কাঁচরাপাড়ায় বাবার ডিসপেনসারির কাছে এলো। এখন বড় শপিংমল একটা। শপিংমলের সামনে চায়ের দোকানে বসল। কেউ বাবাকে চেনে না? নিশ্চয়ই কেউ কেউ চেনে। চা নিল। একটা সিগারেট ধরালো। চা দিচ্ছে যে তাকে জিজ্ঞাসা করল, এখানে একজন ডাক্তারের চেম্বার ছিল না… শঙ্কর ডাক্তার….
চা দিতে দিতে সে বলল, হ্যাঁ বাবার কাছে শুনেছি…. গরীবের ডাক্তার ছিলেন দাদা… এখন আর সে যুগ নেই…. চিনি ঠিক আছে?....