গতকাল লিখেছিলাম সংখ্যার কথা। মৃত মানুষের। আজ লিখছি চিকিৎসকের কথা। এই করোনাযুগ আমায় একটা বড় শিক্ষা দিল। চিকিৎসকের জন্য চিন্তা করতে। ভাবতে। দুশ্চিন্তা করতে। কষ্ট পেতে।
আগে এভাবে ভাবতাম না। কর্তব্য হিসাবে দেখতাম। ভালো চিকিৎসক অনেক মানুষের নির্ভরতার স্থল। অনেক মানুষের জীবন মরণের গতি তাদের সিদ্ধান্ত, দক্ষতার উপর নির্ভর করে - এ সব জানতাম। কিন্তু উল্টোদিক থেকে তেমন কোনো অনুভব ছিল না। এখন হল। এটা তখন আপনিও বুঝতে পারবেন, যখন আপনার ভালোবাসার বৃত্তের মধ্যে যদি কোনো চিকিৎসক থাকেন। আপনিও হয় তো আমার মত আজকে প্রথম অনুভব করবেন তিনি যত দক্ষ, যত অভিজ্ঞ, যত খ্যাতনামা চিকিৎসক হোন না কেন, অবশেষে তিনি একজন মানুষ, নিজের প্রাণের উপর টান, তা রক্ষা করার তাগিদ, যতটা আপনার আমার, ততটা তারও। পার্থক্য বলতে একটাই, তারা চিকিৎসা বিজ্ঞান নামে একটা শাস্ত্রে অভিজ্ঞ। কিন্তু কি জানেন, যিনি অগ্নিনির্বাপনে বিশেষজ্ঞ, তিনিও যদি অগ্নিদগ্ধ হন, যিনি অগ্নিনির্বাপণে বিশেষজ্ঞ নন, তিনিও তারই মত যন্ত্রণা পান। তাই প্রাণ হারানোর ঝুঁকিটা তাদের জীবনে গ্র্যাণ্টেড নয়, তাদের পেশায় অবাঞ্ছিত, অপরিহার্য সংযোজন মাত্র। তাকে স্বীকার করে নিতে তারা অতিরিক্ত কোনো মানসিক বল সাথে নিয়ে জন্মান না, আপনার আমার মতই মানসিক গঠন থেকে লড়াইয়ে নামার রসদ জোগাড় করেন। খুব সোজা কাজ সেটা নয়।
আসলে এই কথাগুলো যুক্তির কথা নয়। যখন আমি একজন চিকিৎসকের কাছে যাই, আসলে তখন আমি একটা পেশার কাছে যাই। তাই মানুষটাকে অসম্পূর্ণ জানি। কিন্তু আমার ভালোবাসার বৃত্তে যদি কোনো চিকিৎসক এসে পড়ে, তখন তাকে আমি শুধু চিকিৎসক হিসাবে জেনে, শুধু একটা বৌদ্ধিক, সহমর্মিতাহীন "আহারে, তাই তো" বলতে পারি না, কারণ তাতে তো কোনো চাপা দুশ্চিন্তার দীর্ঘশ্বাস থাকে না। তাই সে চিন্তা উদ্বেগ সর্বাংশে সত্যিও হয়ে ওঠে না।
আজ যখন আমার ভালোবাসার বৃত্তে সেই চিকিৎসক, তখন বারবার মনে হয়, পিপিই-টা পেয়েছে তো? তার গুণগত মান ভালো তো? মাস্কটা খুলছে না তো? হাতটা বারবার ধুয়ে নিচ্ছে তো? চোখে-মুখে হাত লেগে যাচ্ছে না তো? শুনেছি ঘাম হয় প্রচণ্ড, আবার সে ঘাম বসে কোনো শরীর খারাপ হবে না তো?... এরকম হাজার একটা দুশ্চিন্তা, উদ্বেগ, অস্থিরতা। কারণটা ওই যে বললাম, চিকিৎসা বিজ্ঞান জানা মানুষটাও আদতে মানুষই। ভয় একই। শুধু ভীতু হওয়ার বিকল্পহীন।
আজ এই প্রথম মনে হচ্ছে, আমরা সবাই এই লড়াইয়ে একই পক্ষে। আমরা যারা পিছনের সারিতে এক এক পা হেঁটে কাজের জগতে পেটের ভাত জোগাড়ের জন্য রাস্তায় নামছি, সেই সামনের সারির মানুষগুলোর ভরসায়, যারা কেউ দৈববলে আলাদা নয়। একটা বিশেষ বিজ্ঞানের বাহক তারা, সে বিজ্ঞান নিজেই এখনও ত্রুটিবিচ্যুতি মুক্ত, শতাংশে নির্ভুল শাস্ত্র নয়। অথচ সেই বিদ্যাতেই বলীয়ান হয়ে তাদের অভিমন্যুর মত চক্রব্যূহে প্রবেশ করতে হয়েছে। একই শঙ্কা, একই বেঁচে থাকার স্বপ্ন নিয়েই তারা আপনার আমার মত।
তাই আমরা যেন অতি শ্রদ্ধায় বা ঈর্ষায় বা অবুঝপনায় কোনোমতেই তাদের অন্য আসনে না বসাই। বুঝতে অসুবিধা হবে সত্যিকারের পরিস্থিতিটা। পরিস্থিতি মানে শুধু ইনফ্রাস্ট্রাকচারই নয়, মানসিক পরিস্থিতি বলেও একটা শব্দ আছে। আমরা সেখানে যেন তাদের একা, অন্যশ্রেণী না করে দিই। এইটাই বলা।