বৈশাখীর সব পাল্টে গেল জামাটা দেখার পর। সকাল থেকে বেশ ব্যস্ত ছিল। ছেলেকে স্কুলে পাঠানো, কাজের লোক, রান্নার লোকের পিছনে দৌড়াদৌড়ি করতে করতে... হঠাৎ কলিংবেলটা বাজল। একজন ভিখারী দাঁড়িয়ে। গায়ে লাল চেক চেক একটা জামা সাদার উপরে। পলাশকে দিয়েছিল ওর MSc কমপ্লিট হওয়ার পর।
পলাশ নেই। মানে মারা গেছে। যদিও এই শব্দটা বৈশাখী বলে না। সে বলে নেই। মানে তার দেখা-শোনা-ছোঁয়ার জগতে সে নেই। কথা বলা যায় না, কথা শোনা যায় না। ওর একটা ছবি তার সাথে থাকে, বিপ্লব জানে। আপত্তি করে না। সোনারপুরে একটা ফ্ল্যাটে তাদের সংসার। পলাশ? কোথায় সে?
পলাশ থাকত গড়িয়ায়। বৈশাখীও। তবু কলেজে আলাপ। তারপর বিশ্ব-বিদ্যালয়েও একসাথে। একই সাবজেক্ট - কেমেস্ট্রি। কোথায় সে ফর্মুলা, কোথায় সে ক্লাস? কোথায় সে নোটস? কোথায় সে ক্যান্টিন? কোথায় সে মুহূর্তগুলো যে মুহূর্তগুলোতে শরীর অভিজ্ঞ হয়, মনের সাথে আড়ামোড়া ভাঙে। এখন শরীর বাইরে জেগেও ভিতরে ঘুমায়। কে যেন জাগিয়ে রেখেছিল তাকে... না ছুঁয়েও জাগিয়ে রেখেছিল তাকে... চোখ দিয়ে, ঠোঁটের কোনে বাঁকা হাসি দিয়ে। সে ডিও-র গন্ধ আরো অনেকবার পেয়েছে, ইচ্ছা করে কখনও বিপ্লবের জন্য কিনেছে, আবার কখনও কেনেনি ওই ব্র্যাণ্ডের ডিও-টা। যখন পলাশের উপর সে অভিমানী তখন সে ইচ্ছা করে কিনেছে ওই ডিওটা, সারা গায়ে বিপ্লবের লাগিয়ে পাগলামী করেছে, ভিতরে কেঁদে বাইরে আত্মসমর্পণ করেছে ইচ্ছা করে বিপ্লবের কাছে। বিপ্লব বোঝেনি। ছেলেরা বোঝে না। শরীরে সীমা সব ছেলেরা পেরিয়ে যায় না। যেতে জানে না। তাই ঘনিষ্ঠ মুহূর্তেও বৈশাখীর কখনও কখনও বিপ্লবকে সন্তানের মত লেগেছে। তার শরীরের মধ্যে খাবার খুঁজছে, যেভাবে বাচ্চারা মায়ের স্তনে মুখ রাখে খিদেতে, সেকি ভালোবেসে? আবার কখনও কেনেনি ডিও-টা। সমর্পণ করেছে পলাশের কাছে।
পলাশ। যেখানে সে বাঁচে। যেখানে সে একলা পলাশের সাথে ঘর করে। এখন আর ওই ডিও-টা আসে না এই সোনারপুরের ফ্ল্যাটে। বিপ্লব জানে ওর গন্ধে এখন বৈশাখীর গা গুলায়। একদিন ট্রেনে, শিয়ালদহ ঢোকার মুখে, একটা অল্পবয়েসী ছেলে দাঁড়ালো তাদের সামনে গেট আটকিয়ে। তার গায়ে ওই ডিও-টার গন্ধ। বিপ্লব তাকে বলেছিল, সরে দাঁড়াও, তোমার গা গুলোবে। বৈশাখী সরেনি। যেচে জিজ্ঞাসা করেছিল ছেলেটাকে, তুমি কি কলেজে পড়ো?
স্কুলে বাচ্চাকে ছাড়তে গেল না বৈশাখী আজ। কাজের দিদি নিয়ে গেল। তার মাথা ধরেছে। শোবে কিছুক্ষণ। ফ্যান চালালো। শুয়ে পড়ল। বিপ্লব বাইরে। ফিরতে আরো চারদিন। অফিসের কাজ। মাথাটা ঘোরাচ্ছে মনে হচ্ছে। উঠে গিয়ে জলটাও নিতে ইচ্ছা করছে না। ফ্যানটার স্পিড কি কম?
ফাঁকা ক্লাসরুমে আড্ডা দিয়েছে পলাশের সাথে কত। প্রথম চুমু ফাঁকা ক্লাসরুমেই। সাক্ষী ছিল ফ্যান। কারণ চোখ খুলেই বৈশাখীর চোখ পড়েছিল ফ্যানে। মনে হয়েছিল, ইস্! এখন সব কেমন ছেলেমানুষী লাগে। পলাশ থাকলে লাগত? জানে না। শরীরের একটা অভিজ্ঞতার উপরে আরেকটা অভিজ্ঞতা দাঁড়ায় না বোধহয়। শরীরেরও দ্বেষ আছে।
সব কোথায় গেল? সামনের ফ্ল্যাটের মাঝবয়েসী মহিলা কাপড় জামা মেলছেন ঝুলবারান্দায়। ওনার সিঁথির দিকে তাকিয়ে বৈশাখীর মনে হল, বেশি লাল কি? পাশ ফিরে আয়নার দিকে তাকালো। বুঝতে পারছে না। আয়নাটা একটু দূরে, তার মাইনাস থ্রী পাওয়ার দুটো চোখেই। চশমাটা খাওয়ার টেবিলে রেখে চলে এসেছে। থাক।
কেমেস্ট্রি হারিয়ে গেল। চাকরীটা করা হল না। আসলে পলাশ চলে যাওয়ার পর সে দিশাহারা হয়ে গিয়েছিল। এত তাড়াতাড়ি মানুষ চলে যায়! মৃত্যু এতটা কাছে থাকে মানুষের বৈশাখী জানত কি? বিপ্লব এলো তার জীবনে তার অজান্তেই। বিপ্লব তার শরীর অধিকার করল তার অজান্তেই। টুকু হল একটা ঘোরের মধ্যেই। তারপর সে কিরকম একটা হিসাব করে ফেলল। নিজেকে বাজেটের মত করে কোথায় কোন খাতে কতটা খরচ করবে কষে ফেলল। ব্যস, সব ইজি হয়ে গেল। এখন শুধু নিজেকে বাঁচিয়ে নিজেকে আগলিয়ে রাখা। পলাশের জন্য।
বাজেটের কথায় মনে এলো, আরে ভিখারিটাকে সে দিয়েছে কিছু? না তো। রান্নার দিদিকে বলেছিল ফ্রীজের মাথায় খুচরো রাখা দিয়ে দিতে। দিয়েছিল?
বৈশাখী উঠল। ডায়েনিং রুমে এসে চশমাটা পরল। ফ্রীজের কাছে যাওয়ার আগে বেসিনের সামনে দাঁড়ালো। আয়নায় সিঁথির দাগটা খেয়াল করল। হাত বুলিয়ে চলে এসে ফ্রীজের মাথায় হাত রাখল। হাত পায় না। এই নিয়ে পলাশ তাকে খ্যাপাত। বলত হাঁটু গেড়ে বসে সে নাকি মালাবদল করবে। থমকে গেল বৈশাখীর হাত। পয়সাটা দেয়নি তো। এখানে যে খুচরোগুলো থাকে গত পরশুই তো সব পেপারওয়ালাকে দিয়ে দিয়েছিল। তবে? বৈশাখী হাঁটু গেড়ে বসল।
গলায় হাত দিল। সোনার চেন। তাতে একটা ছোট্ট লকেট। শাশুড়ি দিয়েছে। পলাশের মা নেই। অনেক ছোটোবেলায় মারা গিয়েছিলেন। কিন্তু ভিখারিকে পয়সাটা?
ঘড়ি দেখল। আড়াই ঘন্টা হয়ে গেছে। বেরোবে? যদি খুঁজে পায় ওকে? আলমারী খুলে ভালো একটা শার্ট বার করল বিপ্লবের। ব্যাগে ভরল। পেতেও তো পারে।