যা আছে, তা-ই আছে। নতুন যা, সে যে দেখছে তার কাছেই নতুন। যেমন ধরো তুমি চোদ্দোবার পুরী এসেছো। তোমার কাছে এই সমুদ্র পুরোনো। আমেজটা হয় তো প্রতিবার নতুন। কিন্তু দেখাটা, জানাটা, বিস্ময়টা পুরোনো। কিন্তু যে প্রথম পুরী স্টেশানে নামল। সে প্রথম অটো চড়ে আসছে সমুদ্রের দিকে। সে মোড়টা ঘুরেই দেখছে যা, সে সম্পূর্ণ নতুন তার কাছে। তাই না?
আমি বললাম, তুমি পুরী ক'বার এসেছ?
গোঁসাই বলল, বলব কেন? গোঁসাইয়ের চোখে দুষ্টুমির হাসি। এখন নিজের ব্যক্তিগত কথা বলবে না। এখন নিজের মধ্যে যে পাগল, সে কথা বলবে!
গোঁসাই বলে চলেছে…
দেখো আমরা যা জানি, তা আগে থেকেই আছে বলে জানি। তাই বিজ্ঞানে জানাকে বলে আবিষ্কার করা। আসলে সব জানাই তো আবিষ্কার। ইংরাজিতে যাকে বলে অনাচ্ছাদিত করা… ডিস কভার… তাই তো?
আমি হাসলাম…
গোঁসাই এখন খেয়াল করবে না। এখন বলবে।
দেখো মহাশয় (এটা গোঁসাইয়ের আদরের ডাক), আমরা এই যে আবিষ্কার করতে করতে চলেছি, নানা দেশে নানা বিজ্ঞানী নানা তত্ত্বকে জেনে চলেছে… এর তো কোনো অন্ত নেই… তাই না? কিন্তু কি এক চেতনা এই তত্ত্বগুলোর দিকে আমাদের নিয়ে চলেছে। আমরা তো অজ্ঞান। কিন্তু আমরা যে অজ্ঞান সে বোধ যে আমার আছে, সে তো অজ্ঞান নয়? সেই তো চেতনা। অজ্ঞানের বোধ। তাই নয়? সে আমাদের মধ্যে এলো কি করে বলো দেখি?
আমি বললাম, জানি না তো..
গোঁসাই বলল, তুমি কেন, কেউ-ই জানে না। আমাদের অজ্ঞানবোধকে যে চেতনা জাগিয়ে তোলে, সে-ই আমাদের জ্ঞানের আলোর দিকে নিয়ে চলে। বলে খোঁজো… খোঁজো.. সত্যকে খোঁজো… আকাশে, পাতালে, মাটিতে, জীবেতে, জড়তে… খোঁজো… থেমো না…. এই খুঁজতে খুঁজতে কেউ চেতনার দিকে আঙুল তুলে বলে তুমি তবে কে? আমার অজ্ঞানের ঘুমে আমায় ঠেলে তোলো.. তুমি কে?
ব্যস… খেলা যায় ঘুরে মহাশয়… সে চেতনাকে জানতে চায়। কেমন জানো… এক ব্যক্তিমহাশয় বছর বছর ধরে ঘুমাচ্ছিল। ঘর বন্ধ করে। একদিন চোখে আলো পড়ে ঘুম ভাঙল। তাকিয়ে দেখল ঘরের ঘুলঘুলি দিয়ে আলোর স্তম্ভ এসে পড়েছে তার মুখে। সে উঠে বসল। সেই ঘুলঘুলির আলোর স্তম্ভ ধরে ধরে বাইরে এলো। আলোয় আলো। তেমনই চেতনার আলোকে ধরে ধরে মানুষ আনন্দে এসে পৌঁছায়… আনন্দকে জলে-স্থলে খুঁজে পায়…নাচে-গায়… পাগল হয়… তাকে তখন কি বলো মহাশয়?
জানি না…
তাকে বলে কবি….
গোঁসাই উঠে দাঁড়ালো। বলল, লালন ডাকছে… আমি আসি….
বললাম, মিছে কথা কেন বলো গোঁসাই… লালন কোত্থেকে আসবে?
গোঁসাই বলল, সব আছে… সব আছে… কিচ্ছু হারায় না… খোঁজো… সেও চায় তুমি খোঁজো… সে আসছে… ডাকছে… আমি যাই….
গোঁসাই মিলিয়ে গেল ভিড়ে। আমি বসে থাকলাম কিছুক্ষণ। সন্ধ্যে হচ্ছে। একটানা সমুদ্রের গর্জনে প্রাণে এক সুর জাগছে। গোঁসাই সুর জাগিয়ে গেছে। মন্দিরের দিকে যাব, না এখানেই বসে থাকব ভাবছি….
হঠাৎ পিছনে এসে দাঁড়ালো গোঁসাই। বলল, এখনও বসে? চলো চলো মন্দিরে চলো।
বললাম, অত পাণ্ডার হুজ্জুতি ভালো লাগে না গোঁসাই। তুমি যাও।
গোঁসাই বলল, টান কম হলেই কচুরিপানা এসে স্রোত আটকায়। স্রোতের বেগ বাড়াও… মহাশয়… স্রোতকে খরস্রোতা করো…. বাধা আসবে না…. চলো….