রাতুল যেভাবে বাড়ি ফিরল সেই জানে। তুমুল কালবৈশাখী শুরু হল সন্ধ্যে থেকে। রাতুল তখন বাসে, শিয়ালদায় আসছে। রাতুল ডেলি প্যাসেঞ্জারী করছে তা প্রায় পাঁচ বছর হল। কি ঝড়, কি ঝড় রে বাবা! আগরপাড়ার কাছে ওভারহেডের তার ছিঁড়ল। তারপর হেঁটে, অটোতে, বাসে কোনরকমে যখন খড়দায় পৌঁছাল, তখন রাত সাড়ে আটটা। বাড়িতে ঢুকেই রাতুলের মা বললেন, শীগগিরি মাথায় জল ঢাল, না হলে ঠান্ডা লেগে যাবে।
বাড়িতে মানুষ বলতে বেলাদেবী আর রাতুল। রাতুলের বাবা মারা যান যখন সে ক্লাস সেভেনে পড়ে। বেলাদেবী ব্যারাকপুরের একটা স্কুলে ভুগোলের টিচার। রাতুল এখন আঠাশ প্লাস হবে। কোলকাতায় একটা প্রাইভেট ফার্মে চাকরী করে অ্যাকাউন্টস বিভাগে।
বাথরুম থেকে বেরিয়ে পোশাক বদলিয়ে বলল, মা কারেন্ট কতক্ষণ হল গেছে?
- তা ঘন্টা দেড়েক হবে, তুই বোস আমি চা নিয়ে আসি।
চা খেতে খেতে মায়ের সাথে কিছুক্ষণ গল্প করার পর রাতুল উঠে নিজের শোয়ার ঘরে গেল। ল্যাপটপটা অন করতে গিয়ে বলল, "শিট্"। অফিসে বেরোবার আগে ল্যাপটপটাকে প্লাগে লাগিয়ে সুইচ অন করতে ভুলে গেছে! মোবাইলটাতেও চার্জ নেই বেশি। এদিকে খুব বাজ পড়ছে বলে মা ইনভার্টারটাও চালাতে দেবেন না এখন। পাশের বাড়ির ইনভার্টারটা বাজ পড়ে পুড়ে যাওয়ার পর থেকেই মা অতি সাবধানী হয়ে গেছেন।
রাতুল একটা বড় মোমবাতি জ্বালিয়ে বিছানায় চিৎ হয়ে শুয়ে পড়ল। কি অস্বস্তি হচ্ছে একটা। রাতুল খুব একটা কারোর সাথে কথা বলে না পাড়ায়। পাড়ায় এমনিতেও বন্ধু সংখ্যা কম। এই সময়টা সে ফেসবুকে কাটায় প্রায় ঘন্টা তিনেক। মাঝে উঠে খেয়ে আসে। আর ওয়াটস অ্যাপে তো সারাদিন বন্ধুরা আছেই। কি প্রচন্ড বিচ্ছিন্ন লাগছে তার নিজেকে। মনে হচ্ছে অ্যামাজনের জঙ্গলে পথ হারিয়েছে যেন।
এই সব ভাবতে ভাবতে হঠাৎ তার দেওয়ালে চোখ পড়ল। একটা ঝুল মোমবাতির আলোয় এমন একটা ছায়া তৈরী করেছে দেওয়ালে, ঠিক মনে হচ্ছে যেন একটা গম্বুজ। একটু অন্যমনস্ক হল। তারপর টর্চ নিয়ে নিজের পড়ার ঘরে ঢুকল। বইয়ের আলমারীর নীচের তাক থেকে আঁকার একটা খাতা বার করল। কতদিন আঁকা হয় না! অথচ এই আঁকাকেই সে তার জীবনের প্রধান অঙ্গ করে তুলতে চেয়েছিল।
আঁকার খাতাটা নিয়ে শোয়ার ঘরে আসল। ইতিমধ্যে বাজ পড়া কমেছে। বেলাদেবী ইনভার্টার অন করে দিয়েছেন। রাতুল ল্যাপটপটা চার্জে বসিয়ে আঁকার খাতা খুলল। সাদা পাতার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে তাকে জলে ভরিয়ে তুলল, হল সমুদ্র। মাঝখানে ধীরে ধীরে ফুটে উঠতে লাগল একটা নৌকা। তাতে মাঝি। দূরে আকাশের সাথে জলের মিলনরেখা।
- বাবু খেতে আয়!
রাতুল চমকে উঠে ঘড়ির দিকে তাকাল। এগারোটা চল্লিশ! এতক্ষণ হয়ে গেছে! সে "আসছি বলে" উঠে পড়ল। কাল অফিস থেকে ফিরেই এটার রঙ সম্পূর্ণ করতে হবে। রঙ কিনেও আনতে হবে। সব নষ্ট হয়ে গেছে।
পরের দিন পরিস্কার আবহাওয়া। রাতুল অফিস থেকে রঙ নিয়ে ফিরেছে। সব কাজ তাড়াতাড়ি সেরে আঁকার খাতাটা খুলল। মুগ্ধ চোখে মাঝ সমুদ্রের মাঝে নাবিকের দিকে তাকিয়ে থাকল। নাঃ আঁকার হাতটা নষ্ট হয়ে যায় নি এখনো।
এমন সময় ওয়াটস অ্যাপে মেসেজ আসার আওয়াজ হল। তিয়াষা। তার কলেজের বন্ধু। তারপর রিতেশ, পারমিতা, বিপুল ইত্যাদি একটার পর একটা মেসেজ আসতে শুরু করেছে। কাকলি নাকি তার ছোটবেলার একটা ছবি ফেসবুকে আপলোড করেছে। রাতুল তাড়াতড়ি ফেসবুক অন করল।
রাত হল। খেতে গেল। ফিরে আবার ফেসবুকে বসল। পরেরদিন শনিবার। আইভিদের বাড়িতে একটা হোল নাইট পার্টি সেরে রবিবার ফিরল। আঁকার খাতাটা টেবিলের ওপর পড়ে থাকতে থাকতে খবরের কাগজের নীচে চলে গেল। ডাঁই করা খবরের কাগজের নীচে সে অপেক্ষা করতে লাগল রাতুলের। যদিও ভাগ্য তার মুদিখানার দোকানে ঠোঙা হতে টানছে।
দিন গেল, মাস গেল। সেই নাবিক এখনো মাঝসমুদ্রে বিনা রঙে, বিনা দিশায় ভেসেই চলেছে, ভেসেই চলেছে।
(ছবিঃ অরিজিৎ দাস)