রতিকান্ত মাথাটা পাঁচ জায়গায় ছেঁড়া গামছাটা দিয়ে মুছতে মুছতে বলল, আজ আবার ছ্যানদিদি ধরেছিল… ধুতির খোঁটা, এই বলে পেঁপেটা চৌকির উপর রাখল… গাছটা পুরো ভেঙে গেল জানো ঝড়ে…..
ভাতের হাঁড়িটা উনুন থেকে নামিয়ে ফ্যান গালতে গালতে শ্যামলী বলল, তোমাদেরই তো আলিস্যি যত… কেন গো… একবার গয়ায় গিয়ে পিণ্ডিটা দিয়ে এলেই হয়…. মানুষটা সেই কবে গলায় দড়ি দিয়েছে… আমি বিয়ে হয়ে এসেছি বছর তিরিশ হল…. সেই থেকে শুনে আসছি…. তোমাদের কোনো ভাইয়ের গা নেই…..
রতিকান্ত লুঙ্গিটা হাঁটুর উপর তুলে, চৌকিতে বসে, পিঠটা হাতের ভারে পিছন দিকে এলিয়ে দিয়ে বলল, টাকা কই গিন্নী? গয়া যেতে, পিণ্ডি দিতে কম খরচ?...
শ্যামলী কিছু বলল না…. খানিকবাদে রান্নাঘর থেকে বলল, বারান্দার টালিটা ফেটেছে বোধায় জানো…. জল পড়ছে…..
রতিকান্ত, ওফ্ফ্…, বলে চৌকিতে শুয়ে পড়ল।
বাইরে ভীষণ ঝড়বৃষ্টি চলছে। ঘরে দুটো মোমবাতি। একটাতে ছেলেটা পড়ছে। আরেকটা রান্নাঘরে। ছায়া-আলো মিলে গোটা বাড়িটা কেমন ঘোর লাগা লাগছে…. গোটা জীবনটাই তাই কেটে গেল…..
=====
রাত দেড়টা। রতিকান্ত উঠল। বৃষ্টিটা থেমেছে। আধখানা পেঁপে কেটে, লুঙ্গিটা হাঁটুর উপর তুলে ঝোপঝাড় ঠেলে রতিকান্ত শ্যাওড়া গাছটার নীচে এসে দাঁড়ালো। বলল, দিদি পেঁপেটা….
মুহূর্তে পেঁপেটা হাওয়া হয়ে গেল। খানিকবাদেই চোকলাটা পড়ার আওয়াজ হল।
রতিকান্ত বলল, মিষ্টি ছিল ছ্যানদি?
হাওয়ায় শব্দ ভেসে এলো, হুম...। যেন দীর্ঘশ্বাস।
অমাবস্যার ঘুটঘুটে অন্ধকার। রতিকান্ত সকালের দুটো রুটি খেয়েছে। ভাত মা-ছেলে খেয়েছে। অম্বলের ঢেকুর উঠল। ছ্যানদি রতিকান্তের লতায়-পাতায় দিদি। কেন গলায় দড়ি দিয়েছিল কেউ জানে না। অনেক গল্প প্রচলিত আছে যদিও। অনেকেরই রাতে ওখান দিয়ে যেতে গা ছমছম করে, গা ভারী হয়ে যায়। তবু এই একটাই রাস্তা দুটো গ্রামের মধ্যে। উপায় নেই।
=====
রতিকান্ত বলল, দিদি…. গয়ায় যাব ভাবছি…. কি বলো….
কোনো উত্তর এলো না।
রতিকান্ত বলল, দিদি তুমি কি সত্যিই যেতে চাও?
কোনো উত্তর নেই।
তুমি এমন একটা কাজ কেন করেছিলে দিদি?
কোনো উত্তর নেই। শুধু বর্ষার ভিজে বাতাস সাঁ সাঁ করে বয়ে যাচ্ছে।
হঠাৎ পিছনে খড়খড় শব্দে রতি পিছন ফিরে তাকালো।
একটা আবছা মূর্তি। গলা থেকে অন্ধকারে মিশে। সামনের দাঁত দুটো বাইরে বেরিয়ে। মাথায় চুল নেই। চোখদুটো আকাশের দিকে।
রতিকান্ত হাঁ হয়ে গেল। এই প্রথম দিদিকে দেখছে সে। বলল, প্রণাম করব দিদি?
ছ্যানদি তার দিকে তাকালো।
এমন চোখ কোনোদিন দেখেনি রতিকান্ত, যেন মাছের বাজারে গলা কাটা মাছের মাথার চোখ। ভাষা নেই, কিন্তু ব্যথা আছে।
=====
রতিকান্ত কি বলবে ভেবে পাচ্ছে না। কয়েকবার প্যাঁচা ডেকে উঠল। দুটো কুকুর ডাকতে ডাকতে এদিকে চলে এসেছিল, রতিকান্ত ঢিল ছুঁড়ে তাড়ালো। চারদিকে একটা মায়াবী আলো।
রতিকান্ত বলল, অম্বল হয়েছে দিদি…..
ছ্যানদি বলল, যা খাবি, খাওয়ার পর একটু নুন দিয়ে দিবি জিভের ডগায়…. অম্বল হবে না….
রতি দেখল ছ্যানদি কথা বলছে, অথচ মুখ খুলছে না…. সব ভাষা বাতাসে ভেসে তার কানে ঢুকে যাচ্ছে…. ঠিক কানেও না…. যেন প্রাণে ঢুকে যাচ্ছে…..
রতি বলল, আচ্ছা দিদি। তুমি কি ঘুমাবে? আমি যাই?
ছ্যানদি বলল, বোস… সারাটা দিন তো একা একাই কাটাই…. তোর বউটা ভালো…. আঁশের কিছু হলে আমাকে এদিকে দিয়ে যায় এসে…..
রতি অবাক হল… কই কোনোদিন বলেনি তো শ্যামলী তাকে….
আঁশ আর হয় কই দিদি…. যা দাম…
ছ্যানদি চুপ করে থাকল। রতির ঘুম আসছে চোখ জুড়িয়ে। একবার চোখ লেগে গেল। চোখ খুলে দেখে কেউ নেই…..
=====
সকালে শ্যামলী উনুন সাজাচ্ছে, রতিকান্ত পাশে বসে বলল, তুমি যে দিদিকে মাছটাছ হলে দাও… আমাকে বলোনি তো?
শ্যামলী রতির দিকে না তাকিয়েই বলল, ব্যানার্জিবাড়ি যে তোমাকে অপমান করে তাড়িয়ে দিয়েছে কালীপুজোর দিন… তুমি জানাওনি তো….
কথাটা সত্যি। ব্যানার্জি বাড়ির কালীপুজোর দিন রাতে ব্যানার্জি চড় মেরেছিল গালে, ছোটোজাত হয়ে পুজোর ঘট সরাতে গিয়েছিল বলে। আসলে প্রদীপটা পড়ে গিয়েছিল.. তাড়াতাড়ি ঘট, আরো যা সব ছিল সেসব না সরালে আগুন লেগে যেত কাপড়ে... অনেক নতুন কাপড় ডাঁই করা ছিল তো….
ব্যানার্জি বাড়ি থেকে তাকে চোর… শাড়ি নিতে গিয়েছিল… লোভী…. আরো কত কি বলেছিল। তাও সব শুনে খিচুড়ি নিয়েই এসেছিল বাড়ির জন্য। পাঁচকান করে লাভ কি?
=====
ফ্যালা দুটো সরু কাঠির মত পা টেনে টেনে জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। হাফপ্যান্ট ভিজে যাচ্ছে। কাল যা বৃষ্টি হয়েছে, সব ঘাস ভিজে।
ফ্যালা শ্যাওড়া গাছটার তলায় এসে দাঁড়ালো। হাত দুটো মাটিতে রেখে, ঘাড়টা উঁচু করে ডাকল, ও পিসি… পিসি.. অ্যাই পিসি….
ফ্যালার দুটো হাতে হাওয়াই চটি লাগানো। মা শিখিয়েছে। তাহলে হাত ছড়ে যায় না।
দুটো পাকা পেয়ারা পড়ল ফ্যালার দুই পাশে। ফ্যালা বলল, শোনো না পিসি… বাবা জেনে গেছে জানো তো… বাবা তোমাকে…..
জানি রে… আমিই বলেছি…
ফ্যালা গাছে হেলান দিয়ে বসে বলল, তাই বলো… আমি ভাবছি বাবা কি করে জানল। মা মাঝে মাঝেই বলে তোমার নামে গয়ায় পিণ্ডি দিয়ে আসতে। সেটা হলেই কি তুমি চলে যাবে পিসি?
হাওয়ায় উত্তর এলো, তোকে ছেড়ে আমি যাব না রে…. আমারটাও তোর মত হয়েছিল…. পুকুরে ডুবে গেল… আমি পাশের বাড়ি গিয়েছিলাম ওদের বিয়ের শাড়িটাড়ি দেখতে…. এর মধ্যে ও ঘর থেকে বেরিয়ে গিয়ে উঠানে হামা দিয়ে… আসলে কেউ দেখেও দেখেনি…. জানত তো পঙ্গু হবে…..
ফ্যালা বলল, আমিই কি সেই… হ্যাঁ পিসি…. তোমার ছেলে ছিলাম?
ছেলে না রে…. মেয়ে ছিল আমার… অতসী…..
ফ্যালা বলল, হ্যাঁ হ্যাঁ…. আমি বারবার ভুলে যাই… আসলে আমার মাথাটার মধ্যে শুধু গোবর পিসি…..
ফ্যালা গাছে হেলান দিয়ে বসে। খুব ভালো করে তাকালে দেখা যাবে পাশের ঘাসগুলো মেঝেতে নুয়ে আছে। ছ্যানদি বসে আছে পাশে। ফ্যালার একমাত্র সঙ্গী।
=====
হ্যাঁ গো, বাবু আবার ওই জঙ্গলে গেছে….. তুমি ওকে বুঝিও…. আর কিছু থাক না থাক…. সাপখোপ তো আছে……
"কই হে…. রতি আছিস….?"
যতীন বাড়ুজ্জ্যে। বয়েস আশি ছুঁই ছুঁই।
রতিকান্ত বেরিয়ে এসে বলল, কি দাদা?
হ্যাঁ রে… ছি ছি… গাছটা পুরো ভেঙে গেল রে…. কি মিষ্টি পেঁপে হত রে রতি…. আহা!…. সারা গ্রামে এমন পেঁপে আর একটাও নেই রে……
হ্যাঁ দাদা…. ঝড়ে….
ঝড়ে না রে… ওই মাগীটাই সব খেলে তোদের পরিবারের…. বলছি তোকে একটা হিল্লে কর ওর…. তা তোরা তো শুনবি না….. ওকে পুষে যে কি লাভ তোদের….. চাস তো বল আমিই গিয়ে একটা বিহিত করে আসি…. আমি তারকেশ্বর যাচ্ছি এই শুক্রবার….
শ্যামলী এসে দাঁড়ালো। ঘোমটাটা টেনে বলল, থাক না দাদা… এত উপকার দিদির না হয় নাই করলেন… সে তো কারোর ক্ষতি করছে না…..
ক্ষতি করছে না বৌমা? এই যে পেঁপে গাছটা….
আর ওর মেয়েটা দাদা? আপনার চোখের সামনেই তো সবটা হয়েছিল….. আপনি বাচ্চাটাকে পুকুরের দিকে যেতে দেখেও আটকাননি…. বরং ওর কাজ করতে এসে বলেছিলেন যাক… বরং জঞ্জাল গেল…. বলেননি দাদা?.......
শ্যামলীর গলাটা চড়ে গেল। সামনের বটগাছের কয়েকটা পাতা আচমকা নড়ে উঠল। ফ্যালা ঘষটাতে ঘষটাতে এসে মায়ের পাশে দাঁড়ালো।
যতীন বাড়ুজ্জে কাউকে কিছু না বলে হাঁটতে শুরু করল।
রতি বলল, তুমি এসব জানলে কি করে গো…. এতসব….
ফ্যালা বলল, মা…. পিসি কাঁদছিল তোমার চীৎকার শুনে….
শ্যামলী কড়া গলায় বলল, তুই ঘরে যা….. রতির দিকে তাকিয়ে বলল, বাজারে যাও…. চাল বাড়ন্ত…..
রতি বলল, আজ বারের পুজোর খিচুড়ি হবে…. আনব?
শ্যামলী বলল, চাল এনে তারপর…..
ফ্যালা বলল, বাবা আমি যাব?
শ্যামলী বলল, না… যাও পিসির ওখানে গিয়ে বোস… আমি মাছভাজা নিয়ে আসছি……