বিশ্বনাথ বক্সি নাস্তিক মানুষ। কিন্তু হলে কি হবে, ঠিক কালী মন্দিরের সামনে এসেই চটিটা ছিঁড়ে গেল। এখনও অনেকটা রাস্তা। এইবার? এদিকে মুচিও নেই, জুতোর দোকানও নেই। ওদিকে পায়ের নীচে কড়া।
বিশ্বনাথ মন্দিরের চাতালে উঠল। মন্দির ফাঁকা। বিশ্বনাথ দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণ মনে মনে কিসব হাবিজাবি ভাবল। তারপর কালীর দিকে তাকিয়ে বলল, ইয়ে মানে, চটিটার কিছু ব্যবস্থা হবে?
কেউ সাড়া দিল না। পাশের বেলগাছ থেকে একটা কাক ডেকে উঠল। দূরে কোথাও একটা কুকুর ডেকে উঠল। আর কিস্যুই তো হল না! কিন্তু এখনই হাঁটাটা শুরু না করলে ট্রেন মিস হয়ে যাবে। কিন্তু স্টেশান তো অনেক দূর। এই কড়াপড়া পা নিয়ে অদ্দুর!! উফ! পারা যায়! আর এই গ্রামেগঞ্জে চাকরি পোষায় না। বিশ্বনাথের কান্না পেয়ে গেল। বসেই পড়ল মন্দিরের চাতালে। পাশের পুকুর থেকে ফুরফুরে হাওয়া আসছে। ঘুম পেয়ে যাচ্ছে। চোখটা বুজে বিশ্বনাথ দেওয়ালে মাথা ঠেকিয়ে প্রায় সত্যি সত্যিই ঘুমিয়েই পড়ল।
হঠাৎ একটা আওয়াজ শুনে বিশ্বনাথের চমক ভাঙল। বিশ্বনাথ তাকাতেই দেখে একজন মহিলা, মন্দিরের ভিতরে। বিশ্বনাথকে দেখেই চমকে উঠল। আমতা আমতা করে বলল, না মানে পুজো দিতে এসেছিলাম। বাইরে যা রোদ, তাই একটু জিরিয়ে নিচ্ছিলাম আর কি!
আরো কি সব বলতে বলতে মহিলা একরকম দৌড়েই মন্দির থেকে চলে গেল। বিশ্বনাথের কেমন সন্দেহ হল, সে উঠে মন্দিরে ঢুকে দেখে মন্দিরের ভিতরে, চাতালে তেলের বিন্দু বিন্দু ফোঁটা পড়ে আছে। মহিলা যেদিকে গেল সেদিক বরাবর পড়ে। হ্যাঁ, যা সন্দেহ করেছিল, প্রদীপটা নেই। শুধু পিলসুজটা। ব্যাটা চুরি করতেই ঢুকেছিল। প্রদীপটা কি জ্বলছিল? আসলে চশমাটা পাশে খুলে রেখেই ঘুমাচ্ছিল বিশ্বনাথ, তাই সব কিছু পরিষ্কার দেখা হয়নি। কিন্তু তাই বলে তো ছেড়ে দেওয়া যায় না!
বিশ্বনাথ খালিপায়েই দৌড়ালো। বেশিদূর যেতে হল না, একটা বাচ্চাকে কোলে নিয়ে মহিলা ধীরেসুস্থে হেঁটে যাচ্ছে। কি আশ্চর্য দেখো, যেন কিছুই জানে না! যেন কিছুই হয়নি!
বিশ্বনাথ গিয়ে রাস্তা আটকে দাঁড়ালো। মহিলা থতমত খেয়ে বলল, কি হল বাবু?
বিশ্বনাথ ভেঙিয়ে বলল, কি হল বাবু! ন্যাকা, আমার সামনে দিয়ে তুমি প্রদীপটা চুরি করে আনলে….
মহিলা কিছু বলতে যাচ্ছিল। বাচ্চাটা বলল, মা চ… আমার জন্মদিন করবি না?
মহিলার চোখের কোল জল ভরে এলো। সে বলল, বাবু আমার এ ছেলের আজ জন্মদিন। ওকে প্রদীপ জ্বেলে যে আশীর্বাদ করব, তা তেল বাড়ন্ত। তাই মায়ের প্রদীপটা নিয়ে এলাম। ও তো মা, ও বুঝবে। এটা চুরি নয়, ধার। এক মা আরেক মায়ের কাছ থেকে ধার করেছে। কাজটা হয়ে গেলেই আমি আবার গিয়ে প্রদীপটা রেখে আসব… সকাল থেকে এর পেটে কিছু পড়েনি… অল্প একটু পায়েস করেছি… তাও মিষ্টি হবে না… মাত্র সাত-আটটা বাতাসায় কি হয়! ওই পুরোহিত প্রসাদে যা দেয় তাই জমিয়েই…
বিশ্বনাথ ঝাপসা দেখছে সব। প্রথমে ভাবল বুঝি চশমাটা খুলে পড়ে গেছে। নাকে হাত দিয়ে দেখল। চশমা পরেই আছে।
হঠাৎ বাচ্চাটা বলল, কাকুর খালি পা…
মহিলা বলল, একি খালি পা?
বিশ্বনাথ বলল, চটিটা ছিঁড়ে গেছে…. চটিটা মন্দিরের সামনেই…
মহিলা বাচ্চাটাকে কোল থেকে নামিয়ে বলল, তুই ছুটে মন্দিরের সামনে থেকে কাকুর চটিজোড়াটা নিয়ে আয়….
মহিলা সলজ্জ হেসে বলল, গরীবের ঘরে না হয় পায়ের ধুলো পড়ুক… আমার বর জুতোই তো সারায়… বাড়িতেই আছে….
বিশ্বনাথের ট্রেন মিস হল। বাচ্চাটার জামা কেনার জন্য টাকা দিয়ে এলো। এক চামচ পায়েসও খেলো। মিষ্টিটা সত্যিই কম। ফেরার সময় মন্দিরের পাশ দিয়ে আসার সময় বলল, এক জুতো সারাতে বলেছিলাম বলে এত কাণ্ড!… কি করে যে মানুষ আস্তিক হয়!..
ভস্ করে আবার নাকের কাছটা টাটিয়ে উঠল বিশ্বনাথের!