সৌরভ ভট্টাচার্য
11 March 2017
দুটো বই একই সাথে প্রায় হাতে এসে পড়ল - 'চেনা পথ অচেনা পথিক' আর 'পাঠক রবীন্দ্রনাথ'। অসামান্য দুটো বই। দুটো বইয়ের একটা যোগসূত্রও আছে, মহাপ্রভু।
প্রথম বইটার কথায় আগে আসি। লেখিকা, নন্দিনী চট্টোপাধ্যায়। মহাপ্রভুর উপরে বইয়ের সংখ্যা অজস্র। তবে এই বইটার বিশেষত্ব কি? বিশেষত্ব এর পটভূমিকা। সেই সময়ের বাংলা সমাজ। তাত্ত্বিক দৃষ্টিতে নয়। নানান চরিত্রের মাধ্যমে উঠে আসছে খণ্ড খণ্ড রূপ সেই সময়ের। কোনো মহাপুরুষকে জানতে হলে, তাঁর সময়টাকে না বুঝলে তাঁর কাজের তাৎপর্য বোঝা শক্ত। একটা গভীর নিম্নচাপ সৃষ্টি না হলে যেমন শুষ্ক ধরণীর বুকে বর্ষা আনয়নকারী মেঘের সঞ্চার হয় না, ঠিক তেমন সমাজের একটা দারুন সংকট না তৈরি হলে একজন মহাপ্রাণের আবির্ভাবও হয় না। সেদিন বাংলার ঘরে ঘরে যে কান্না, হাহাকার, অসহায়তা, ধর্মের নামে অমানবিকতা জমে উঠছিল ধীরে ধীরে তার অসামান্য বর্ণনা লেখিকার চোখে দেখতে পেলুম। মনে হল কিছু দিন যেন সেই সময়ে সেই সমাজে কাটিয়ে এলুম।
“সকলের দ্বারা সব কাজ সম্পন্ন হয় না ভাই। তুমিই পারবে এ কাজ। গৌড়বঙ্গ অধর্মের পাপে হতশ্রী। বৌদ্ধধর্মাবলম্বীরা তন্ত্রচারী হয়ে পড়ছে, তন্ত্রচারীরা ব্যভিচারী। উৎকট বিকৃতির স্রোত বইছে সমাজে। দলে দলে মানুষ যবন ধর্ম পালনের দিকে ঝুঁকে পড়েছে।... ধর্ম হল সেই দ্রব্য যা জাতিকে ধারণ করে।... নিত্যানন্দ, ভাই শত শত নামগোত্রহীন, পতিত, লাঞ্ছিত, নির্যাতিত মানুষকে আশ্রয় দাও তোমার বাহুপুটে।"
প্রথম বইটার কথায় আগে আসি। লেখিকা, নন্দিনী চট্টোপাধ্যায়। মহাপ্রভুর উপরে বইয়ের সংখ্যা অজস্র। তবে এই বইটার বিশেষত্ব কি? বিশেষত্ব এর পটভূমিকা। সেই সময়ের বাংলা সমাজ। তাত্ত্বিক দৃষ্টিতে নয়। নানান চরিত্রের মাধ্যমে উঠে আসছে খণ্ড খণ্ড রূপ সেই সময়ের। কোনো মহাপুরুষকে জানতে হলে, তাঁর সময়টাকে না বুঝলে তাঁর কাজের তাৎপর্য বোঝা শক্ত। একটা গভীর নিম্নচাপ সৃষ্টি না হলে যেমন শুষ্ক ধরণীর বুকে বর্ষা আনয়নকারী মেঘের সঞ্চার হয় না, ঠিক তেমন সমাজের একটা দারুন সংকট না তৈরি হলে একজন মহাপ্রাণের আবির্ভাবও হয় না। সেদিন বাংলার ঘরে ঘরে যে কান্না, হাহাকার, অসহায়তা, ধর্মের নামে অমানবিকতা জমে উঠছিল ধীরে ধীরে তার অসামান্য বর্ণনা লেখিকার চোখে দেখতে পেলুম। মনে হল কিছু দিন যেন সেই সময়ে সেই সমাজে কাটিয়ে এলুম।
“সকলের দ্বারা সব কাজ সম্পন্ন হয় না ভাই। তুমিই পারবে এ কাজ। গৌড়বঙ্গ অধর্মের পাপে হতশ্রী। বৌদ্ধধর্মাবলম্বীরা তন্ত্রচারী হয়ে পড়ছে, তন্ত্রচারীরা ব্যভিচারী। উৎকট বিকৃতির স্রোত বইছে সমাজে। দলে দলে মানুষ যবন ধর্ম পালনের দিকে ঝুঁকে পড়েছে।... ধর্ম হল সেই দ্রব্য যা জাতিকে ধারণ করে।... নিত্যানন্দ, ভাই শত শত নামগোত্রহীন, পতিত, লাঞ্ছিত, নির্যাতিত মানুষকে আশ্রয় দাও তোমার বাহুপুটে।"
দ্বিতীয় বই, 'পাঠক রবীন্দ্রনাথ'। বইটা যখন প্রথম হাতে এলো, মনে মনে একটু ক্ষুণ্ণ হলাম, এ তো শুধুমাত্র কিছু বইয়ের কথা, 'বিদ্যাপতি থেকে ভারতচন্দ্র'। তা হলে আরো যেসব বই রবীন্দ্রনাথের পাঠ্য তালিকায় ছিল সেই বইগুলোর কথা জানতে পারব না?
"একধার হইতে বই পড়িয়া যাইতাম; যাহা বুঝিতাম এবং যাহা বুঝিতাম না দুই-ই আমার মনের উপর কাজ করিয়া যাইত" - রবীন্দ্রনাথ।
লেখক বিশ্বনাথ রায়। তার সাথে শুরু হল রবীন্দ্রনাথের নানান চিঠি আর পাণ্ডুলিপি পরিভ্রমণ। একটা কথা মনে পড়ল। যখন সক্রেটিস পড়ছি, তখন প্লেটোর থেকে জেনোফেনকে আমার মনে প্রথম দিকটায় বেশি ধরেছিল। কারণ জেনোফেনের সোজাসাপটা বর্ণনা। ভুল ভাঙালেন বার্ট্রাণ্ড রাসেল। তিনি বলছেন, যদিও জেনোফেনের বর্ণনা অতি সোজা, সরাসরি কিন্তু প্লেটোর ন্যায় অন্তর্দৃষ্টি তার নেই।
মনে ঝটকা খেলুম। তাই তো। বাজারে তো সবাই যায়, কিন্তু বাজার থেকে কে কি কিনে আনবে সে তো তার রুচি আর সামর্থ্যের উপর। যে বাজারে আমার যাওয়া হল না, তবে সেই বাজারের বড় মহাজনদের দ্বারেই যাই ভিক্ষাপাত্র হাতে। বিশ্বনাথবাবু সেই বড় মহাজন। প্রতিটা পাতায় বিস্মিত করলেন শুধু না, মাথা নীচু হয়ে এলো তাঁর অধ্যবসায়ে।
বাংলার বাউলকে সারাটা বিশ্ব চিনেছিল রবীন্দ্রনাথের অনুবাদে। লালন থেকে হাসন রাজা, অন্ধ বাউল, পথের ভিখারী বাউল ইত্যাদির নানান পদ তিনি সংগ্রহ করেছেন, অনুবাদ করেছেন। বৈষ্ণব পদাবলী সঙ্কলিত করছেন। মহাপ্রভুর উপর যতগুলো বই সম্ভব পড়েছেন শুধু না, একটা চিঠিতে সমস্ত বৈষ্ণবধর্মের মূল তত্ত্বটা কি সেটা বোঝাবার প্রয়াস পেয়েছেন।
"আমি যে বাল্যকালে ইউরোপীয় সাহিত্য পড়বার ভালো সুযোগ পাইনি - এবং তার পরিবর্তে বৈষ্ণব পদাবলী পড়েছিলুম ও তার থেকে আমার লিরিকের ভঙ্গী ও ভাষা গ্রহণ করবার সুযোগ পেয়েছিলুম এটা আমার পক্ষে একটা বাঁচোয়া। নইলে আমি হয়ত নবীন সেন প্রভৃতির মত বাইরনী ছাঁচে লেখবার চেষ্টা করতুম।" আরো লিখছেন, “বৈষ্ণব সাহিত্য ও উপনিষৎ বিমিশ্রিত হইয়া আমার মনের হাওয়া তৈরি করিয়াছে।"
এছাড়াও এসেছে কৃত্তিবাস প্রসঙ্গ, ভারতচন্দ্র প্রসঙ্গ, প্রাচীন সাহিত্য প্রসঙ্গ। আরো নানান আশ্চর্যজনক সব তথ্যাবলী। বইটা পড়তে পড়তে বোঝা যায় যে আমরা কেন এমন বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছি, 'ঘরেতে পরবাসী' হয়ে লেখাপড়া করছি। খুব কম লেখাতে মাটির গন্ধ। বিশ্ববিদ্যালয় অথবা সেমিনারে হয়ত বা সে লেখা চলে যায়, একটা নির্জনে বসে পড়তে মনে দাগ কাটে না। তাই কি ধীরে ধীরে পাঠকের সংখ্যা কমছে? জানি না। তবে এটা ঠিক, খুব কম লেখা পড়েই মনে হয় ইনি না লিখলে খুব বড় একটা ক্ষতি হয়ে যেত। যে সাহিত্য শুধু সাহিত্যের খাতিরে সাহিত্য তার কথা বলছি না, যে সাহিত্য মনের সাথে মনের যোগ করার তাগিদে জন্মায় তার কথা বলছি। সে সাধনার বস্তু। নিজের মাটির গন্ধ যে মাখেনি তার ছোঁয়ায় মাটির গন্ধ থাকবে না সেই তো স্বাভাবিক। বিদেশি লেখকের চিন্তায় পুষ্ট, স্বদেশী কথার মালা, মিউজিয়ামে সিঁধোচ্ছে ধীরে ধীরে। যারা সে মিউজিয়ামে ঘোরাফেরা করে তারা জানছে। আজকাল তো অবশ্য স্বদেশ কথাটাও সঙ্কীর্ণ! তবু ফিরতে হলে সেই প্রাচীন পথ - আত্মানাং বিদ্ধি - নিজেকে জানো।
"একধার হইতে বই পড়িয়া যাইতাম; যাহা বুঝিতাম এবং যাহা বুঝিতাম না দুই-ই আমার মনের উপর কাজ করিয়া যাইত" - রবীন্দ্রনাথ।
লেখক বিশ্বনাথ রায়। তার সাথে শুরু হল রবীন্দ্রনাথের নানান চিঠি আর পাণ্ডুলিপি পরিভ্রমণ। একটা কথা মনে পড়ল। যখন সক্রেটিস পড়ছি, তখন প্লেটোর থেকে জেনোফেনকে আমার মনে প্রথম দিকটায় বেশি ধরেছিল। কারণ জেনোফেনের সোজাসাপটা বর্ণনা। ভুল ভাঙালেন বার্ট্রাণ্ড রাসেল। তিনি বলছেন, যদিও জেনোফেনের বর্ণনা অতি সোজা, সরাসরি কিন্তু প্লেটোর ন্যায় অন্তর্দৃষ্টি তার নেই।
মনে ঝটকা খেলুম। তাই তো। বাজারে তো সবাই যায়, কিন্তু বাজার থেকে কে কি কিনে আনবে সে তো তার রুচি আর সামর্থ্যের উপর। যে বাজারে আমার যাওয়া হল না, তবে সেই বাজারের বড় মহাজনদের দ্বারেই যাই ভিক্ষাপাত্র হাতে। বিশ্বনাথবাবু সেই বড় মহাজন। প্রতিটা পাতায় বিস্মিত করলেন শুধু না, মাথা নীচু হয়ে এলো তাঁর অধ্যবসায়ে।
বাংলার বাউলকে সারাটা বিশ্ব চিনেছিল রবীন্দ্রনাথের অনুবাদে। লালন থেকে হাসন রাজা, অন্ধ বাউল, পথের ভিখারী বাউল ইত্যাদির নানান পদ তিনি সংগ্রহ করেছেন, অনুবাদ করেছেন। বৈষ্ণব পদাবলী সঙ্কলিত করছেন। মহাপ্রভুর উপর যতগুলো বই সম্ভব পড়েছেন শুধু না, একটা চিঠিতে সমস্ত বৈষ্ণবধর্মের মূল তত্ত্বটা কি সেটা বোঝাবার প্রয়াস পেয়েছেন।
"আমি যে বাল্যকালে ইউরোপীয় সাহিত্য পড়বার ভালো সুযোগ পাইনি - এবং তার পরিবর্তে বৈষ্ণব পদাবলী পড়েছিলুম ও তার থেকে আমার লিরিকের ভঙ্গী ও ভাষা গ্রহণ করবার সুযোগ পেয়েছিলুম এটা আমার পক্ষে একটা বাঁচোয়া। নইলে আমি হয়ত নবীন সেন প্রভৃতির মত বাইরনী ছাঁচে লেখবার চেষ্টা করতুম।" আরো লিখছেন, “বৈষ্ণব সাহিত্য ও উপনিষৎ বিমিশ্রিত হইয়া আমার মনের হাওয়া তৈরি করিয়াছে।"
এছাড়াও এসেছে কৃত্তিবাস প্রসঙ্গ, ভারতচন্দ্র প্রসঙ্গ, প্রাচীন সাহিত্য প্রসঙ্গ। আরো নানান আশ্চর্যজনক সব তথ্যাবলী। বইটা পড়তে পড়তে বোঝা যায় যে আমরা কেন এমন বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছি, 'ঘরেতে পরবাসী' হয়ে লেখাপড়া করছি। খুব কম লেখাতে মাটির গন্ধ। বিশ্ববিদ্যালয় অথবা সেমিনারে হয়ত বা সে লেখা চলে যায়, একটা নির্জনে বসে পড়তে মনে দাগ কাটে না। তাই কি ধীরে ধীরে পাঠকের সংখ্যা কমছে? জানি না। তবে এটা ঠিক, খুব কম লেখা পড়েই মনে হয় ইনি না লিখলে খুব বড় একটা ক্ষতি হয়ে যেত। যে সাহিত্য শুধু সাহিত্যের খাতিরে সাহিত্য তার কথা বলছি না, যে সাহিত্য মনের সাথে মনের যোগ করার তাগিদে জন্মায় তার কথা বলছি। সে সাধনার বস্তু। নিজের মাটির গন্ধ যে মাখেনি তার ছোঁয়ায় মাটির গন্ধ থাকবে না সেই তো স্বাভাবিক। বিদেশি লেখকের চিন্তায় পুষ্ট, স্বদেশী কথার মালা, মিউজিয়ামে সিঁধোচ্ছে ধীরে ধীরে। যারা সে মিউজিয়ামে ঘোরাফেরা করে তারা জানছে। আজকাল তো অবশ্য স্বদেশ কথাটাও সঙ্কীর্ণ! তবু ফিরতে হলে সেই প্রাচীন পথ - আত্মানাং বিদ্ধি - নিজেকে জানো।
'কোথায় পাব তারে' গানের অনুবাদ, পাঠক রবীন্দ্রনাথ |
কিছু কিছু বাউল পদের অনুবাদ, পাঠক রবীন্দ্রনাথ |
|| ১ ||
'চেনা পথ অচেনা পথিক',
লেখিকা - নন্দিনী চট্টোপাধ্যায়,
প্রকাশক - দেজ, মূল্য - ২৫০/-
|| ২ ||
'পাঠক রবীন্দ্রনাথ',
লেখক - বিশ্বনাথ রায়,
প্রকাশক - সুজন প্রকাশনী, মূল্য - ২৩০/-