হাতপাখার হাওয়া খেতে খেতে নিরাবরণ স্তনের দিকে আঙুল দেখিয়ে শৈব্যা বলল, তোর বাবা… এই খেয়ে বড় হয়েছে…. মা জানে… বুঝলি শুধু মা জানে নাড়ির টান কাকে বলে…..
শৈব্যার শ্বাসকষ্ট হচ্ছে। যথেষ্ট হচ্ছে। গায়ে কাপড় রাখতে পারছে না। স্থূল শরীর ঘেমে জবজব। বাড়ির সবাই বলাবলি করছে এই অবস্থায় পড়ে থাকলে বেডসোর অবশ্যম্ভাবী।
=====
ছাদে পায়চারি করছে শিবনাথ। কোনো চিন্তা দানা বাঁধছে না। মিল বন্ধ। উপার্জন নেই বললেই চলে। চানাচুর-বিস্কুট বিক্রি করে কি হয়? মা যাক। কিন্তু বাড়িতেই। তাড়াতাড়ি। হাসপাতালে না। বড় কষ্ট পাবে।
শৈব্যার আশি ছুঁই ছুঁই। শিবনাথ বাষট্টি।
=====
টান কমছে না। বাড়ছে। রাত সাড়ে তিনটে। শৈব্যার মাথার কাছে বসে শিবনাথ। কারেন্ট নেই। গুমোট ঘর। শিবনাথ ডাকল, মা, মা…
শৈব্যা চোখ খুলল। অন্ধকারে ছেলের মুখের দিকে তাকালো। বলল, আরেকটু, যাস না। উঠিস না।
=====
সাড়ে পাঁচটা। শিবনাথ মায়ের পাশে শুয়ে। মায়ের সারা শরীর ঠাণ্ডা। শিবনাথ জানে না।
একে একে সবাই জানল। চায়ের জল চাপালো মুক্তি। চোখদুটো লাল। শাশুড়ি মা এখনো ঘরে। আর কিছুক্ষণ। কিচ্ছু পেল না মানুষটা। কিচ্ছু না।
=====
শিবনাথ ছাদে। সূর্য উঠেছে। শিবনাথ সূর্যের আলো ধরে বর্ডারের ওপারে ভিটের সামনে দাঁড়িয়ে। মায়ের হাত ধরে। বাবাকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। মাস হল। আর থাকা যাবে না। মা শিবনাথের হাতটা শক্ত করে ধরে বলল, চল। মা আর তাকালো না। শুকনো চোখে বলল, আমার যদি কিছু হয়ে যায়, কেউ যদি ধরে নিয়ে যায়… পালাবি…. দৌড়াবি… নদীতে ঝাঁপ দিবি…. যতক্ষণ না বর্ডারে পৌঁছাচ্ছিস….
"আর তুমি? ওদিকে কে আছে মা?"
নিজেদের লোক।
কে? কাকা, মামা? কে?
গেলেই দেখতে পাবি।
=====
মা বস্তির অন্ধকার ঘরে ঢুকেছে। ইণ্ডিয়া। সামনে মাটির ঢিবিতে তুলসীগাছ। শিবনাথ মিষ্টির দোকানে কাজ পেয়েছে। ভোরে দুধ আনতে যায় ভ্যানে করে। পড়ে। মা সেলাই করে। পড়ায়। মা রান্না করে। পড়ায়। শিবনাথ বাজারে কাজ নিয়েছে। পড়েছে। শিবনাথ লেবু বিক্রি করেছে। পড়েছে। গামছা বিক্রি করেছে। পড়েছে।
=====
মায়ের মাথাটা খারাপ হল। মিল বন্ধ হওয়ার পর। পূর্বপুরুষেরা, দেবতারা ঘরে আসতে শুরু করল। মা তখন কাস্তে-হাতুড়ি চিহ্ন দেখলে প্রণাম করে। মিলের খোঁজ নেয়। দেশের খোঁজ নেয়। ধানের খোঁজ নেয়। দুধের খোঁজ নেয়। মুক্তি উত্তর দেয়। মুক্তির বাড়িও ওদেশে ছিল। মুক্তি গান শোনায়। মুক্তি মুড়ি ভাজে। মুক্তি ভোট দেয়।
=====
একটা ছেলে। বিশ্বনাথ। কম্পাউণ্ডার শীতল ডাক্তারের। পার্টি করে। বিশ্বাস করে একদিন চেতনা জাগবে। বিপ্লব আসবে। খোলা চোখে স্বপ্ন দেখে। গান গায় গণনাট্যের। মুক্তি অবাক হয়ে শোনে। এত বিশ্বাস!
মারা গেল। বোমে হাত উড়ল প্রথমে। তারপর একদিন এনকাউণ্টার। শিবনাথ দেখেছে, ছেলের রক্তের রঙ সত্যিই লাল। খাঁটি লাল। শৈব্যা জিজ্ঞাসা করেছে, বাবু কখন ফিরবে। মুক্তি বলেছে, সকালে। শৈব্যা জিজ্ঞাসা করেছে, বাবু কখন ফিরবে? মুক্তি বলেছে, রাতে। শৈব্যা জিজ্ঞাসা করেছে, বাবু কখন ফিরবে? মুক্তি বলেছে, পুজোর আগে। শৈব্যা জিজ্ঞাসা করেছে, ও ফিরেছে? মুক্তি জিজ্ঞাসা করেছে, কে? শৈব্যা বলেছে, ও…. শিবুর বাবা…. মুক্তি বলেছে.. না। শৈব্যা চুপ করে থেকেছে।
=====
শৈব্যা মারা যাওয়ার দিন আগে, দু'দিন ধরে তার দুই পাশে বসে নাতি আর স্বামী - বিশ্বনাথ আর নরেন্দ্রনাথ। শৈব্যা একবারও নরেন্দ্রনাথের দিকে তাকায়নি। জানে তার খোলা বুকে মাথা রেখে, শুয়ে, তাকে জড়িয়ে নরেন্দ্রনাথ, তার সারা শরীরে শিশিরের মত রক্তবিন্দু জমে। বিশ্বনাথকে তাই বলছে, এই এই বুকের দুধ খাইয়ে মানুষ করেছি তোর বাবাকে…. ও কি জানে নাড়ির টান…..
বিশ্বনাথের মাথা ফুঁড়ে কালো গর্ত। এদিক ওদিক দেখা যায়। শৈব্যা বিশ্বনাথের মাথার ফুঁটোতে চোখ রেখে বলছে…. দেশের আকাশ…. দেশের মাটি….
=====
শিবনাথের পাশে চা নিয়ে এসে দাঁড়ালো মুক্তি। শিবনাথ ফুঁপিয়ে উঠে বলল, মা চলে যাবে নাগো…. সব ফাঁকা হয়ে যাবে… সব….
শিবনাথ বসে পড়ল, মুক্তির পা জড়িয়ে ধরে, মুক্তির হাঁটুতে মাথা রেখে কাঁদছে…. মুক্তি শক্ত করে চায়ের কাপটা ধরে আছে…. যাতে গরম চা শিবনাথের খালি পিঠে না পড়ে যায়….
মুক্তি শুকনো চোখে আকাশের দিকে তাকিয়ে। সাদা বক উড়ছে কয়েকটা। আর পায়রা ক'টা। রাজনীতি না, ধর্ম না, কি ক্ষমতা আছে বোঝার…. শক্ত করে ধরে চায়ের কাপ…যেন পুড়ে না যায়…. মানুষটা… সংসারটা…. ঘরগুলো….