- শান্তিতে আর থাকা গেল না রে তোপসে
- কেন ফেলুদা?
- এদিকে লাগামছাড়া করোনা। ওদিকে মাস্ক ছাড়া জনতা। আবার তার উপরে ভ্যাক্সিনের রহস্যময়তা।
- কি করবে ভাবছ?
- এই ক্ষেত্রে আগে ভাবতে হবে কি কি করা যাবে না...
- যেমন?
- যেমন মাস্ক ছাড়া বাইরে যাওয়া যাবে না। ভিড়ের দিকে ঘেঁষা যাবে না। মাঝে মাঝেই হাত না ধুয়ে থাকা যাবে না। নাক, চোখ, মুখে হাত যখন তখন দেওয়া যাবে না।
- তোমার কি মনে হয়, এটা চীনের চক্রান্ত?
- হতে পারে, কিন্তু মোটিভটা কি?
- বিশ্বের বাজারটাকে ঘেঁটে দেওয়া।
- উঁহু, মজবুত পয়েন্ট না। দাঁড়া সিধুজ্যাঠাকে ফোন করি তোর একবার...
- হ্যালো.... ফেলু মিত্তির বলছি... আচ্ছা আপনার কি মনে হয় এটা চীনের চক্রান্ত...
- দেখ ফেলু, এই নিয়ে খোঁজ করার জন্য একটা দল সে দেশে গিয়েছিল। মানে চীনের উহানেই গিয়েছিল। তারা ফিরে এসে বলেছে এই রোগের সঙ্গে চীনের গবেষণাগারের কোনো যোগাযোগ নেই। তবে আমেরিকার বেশ কিছু ডাক্তার ও বিজ্ঞানী এখনও এই তথ্য বিশ্বাস করছেন না। তাদের মতে হু'র যে টিম গিয়েছিল তাদের কাজের সততা নিয়ে তাদের সন্দেহ আছে।
- বুঝলাম। তবে আপনি কোনো আপডেট পেলে আমায় জানাবেন.... প্লিজ।
- হা হা হা, সে আর বলতে? বিলক্ষণ জানাব। নিজের খেয়াল রেখো, সাবধানে থেকো।
ফেলুদা বিছানায় টানটান হয়ে চিৎ হয়ে শুলো। পা দুটো খাটের বাইরে ঝুলছে, অল্প অল্প দোলাচ্ছে। মানে কিছু একটা নিয়ে গভীরভাবে ভাবছে ফেলুদা।
- আচ্ছা তোপসে, তোর কি মনে হয়, এই দুর্যোগটা ছাড়তে কতদিন সময় লাগবে?
- বিল গেটস তো বলছে ২০২২ এর শেষের দিকে।
- হুম, পড়েছি। তোর কি বিশ্বাস হয়?
কলিংবেল বাজল।
একজন মোটা মত লোক এসে হন্তদন্ত হয়ে ঘরে ঢুকে বলল, একটু প্রদোষবাবুকে ডেকে দেবেন? আমি ভীষণ বিপদে পড়ে আসছি...
ফেলুদা একটা সিগারেট ধরিয়ে ভদ্রলোকের মুখোমুখি বসলেন। ভদ্রলোক স্থির হয়ে বসতেই পারছেন না। চোখে-মুখে একটা চাপা উদ্বিগ্নতা। রুমালে মুখটা মুছে, পকেট থেকে মোবাইলটা বার করে, স্ক্রিন অন্ করে ফেলুদার দিকে বাড়িয়ে দিলেন।
ফেলুদা মোবাইলটা হাতে নিয়ে, ভুরু কুঁচকে অনেকক্ষণ তাকিয়ে রইল স্ক্রীনের দিকে। চোয়াল দুটো শক্ত হয়ে আছে। তারপর ভদ্রলোকের হাতে মোবাইলটা দিয়ে হাতটা স্যানিটাইজ করতে করতে জিজ্ঞাসা করলেন, আপনি ওনাকে চেনেন কি করে?
আমি আর কৌতুহল চাপতে পারছি না। ফেলুদা আমার অবস্থাটা টের পেল, আমার দিকে তাকিয়ে বলল, প্রফেসর শঙ্কু উহানের ল্যাবে চলে গেছেন। একাই গেছেন। ল্যাব থেকে একটা মেল এসেছে, উনি ওখানে গিয়ে ভাইরাসে উৎসটা জেনে ফেলেছেন, তার প্রতিষেধকও আবিষ্কার করে ফেলেছেন। কিন্তু একটা সমস্যা দেখা দিয়েছে। ওই প্রতিষেধকটা নিলে মানুষের আয়ু তিনশো বছর বেড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা। তাতে সমস্ত অর্থনীতি, সামাজিক কাঠামো সব ভেঙে পড়বে।
ভদ্রলোক চলে গেলেন। ফেলুদা ওনাকে এগিয়ে দিয়ে এসে গভীর চিন্তায় ডুবে গেল। একবার শুধু বলল, ভ্যাক্সিন নিয়ে ব্লাড ক্লট করলেও সমস্যা, আয়ু বাড়লেও সমস্যা…. বুঝলি রে তোপসে।
রাত অনেক হয়েছে। বাইরে অল্প অল্প বৃষ্টি শুরু হয়েছে। হঠাৎ মনে হল কেউ যেন দরজার বাইরে আওয়াজ করছে। শব্দটা ফেলুদাও পেয়েছে। আমায় ইশারায় দেখতে বলল। আমি দরজাটা খুলে দেখি একজন ভিখারি, একটা দোতারা নিয়ে দরজার সামনের শেডের নীচে শোয়ার ব্যবস্থা করছে। আমি বললাম, এখানে কি করছেন?
সে একগাল হেসে বলল, রাতটুকু শুয়ে সকালেই চলে যাবখনে….
ফেলুদা ভিতর থেকে শুনতে পেয়েছে। ওখান থেকেই বলল, ওনাকে ভিতরে আসতে বল, আজ রাতে ঝড়ের পূর্বাভাস আছে।
ভিখারি রোগা চেহারা। মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি। ঢুকেই একগাল হেসে বলল, বিরক্ত হবেন না, আমি একটা কোণে শুয়ে রাতটা কাটিয়েই চলে যাব।
রাত বাড়ল। ঝড় শুরু হয়েছে। কারেণ্ট চলে গেল। আমি আর ফেলুদা একটা মোমবাতি জ্বালিয়ে টেবিলে খেতে বসেছি। শুনি সে ভিখারি গাইছে, কতই রঙ্গ দেখি দুনিয়ায়... ও ভাইরে... কতই রঙ্গ দেখি দুনিয়ায়….
ফেলুদা অন্যমনস্ক। হঠাৎ ফোন বেজে উঠল ফেলুদার।
- হ্যালো, আমি ওই যে খানিক আগে এসেছিলাম….
- মানে বিনোদবাবু...
- হ্যাঁ, বিনোদ ঘোষ বলছি... উনি ফিরে আসছেন বুঝলেন…. ফাউচি'র আর সৌম্য স্বামিনাথনের সঙ্গে কথা হয়েছে। ওই ভ্যাক্সিনটা আপাতত নিয়ে কাজ করা যাবে না। যেগুলো আছে সেগুলো দিয়েই সব ঠিক হয়ে যাবে ওনারা সবাই মনে করছেন। তবে মানুষকে আরো সচেতন হতে হবে।
আমার জানলার বাইরে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। পাশের ঘরে ফেলুদা ঘুমাচ্ছে। বারান্দায় ভিখারিও ঘুমিয়ে পড়েছে। আমার ঘরে হঠাৎ মনে হল বিরাট লম্বা একজন মানুষ কেউ একজন হেঁটে-চলে বেড়াচ্ছে। ছায়ার মত। আমি উঠে বসতেই সে ছায়ার মত মানুষটা বিশাল গম্ভীর গলায় বলল, “মানুষকে কুসংস্কারমুক্ত করতে হবে, বুঝলে হে ছোকরা। তবে বিজ্ঞানের লোভে মনুষ্যত্বটা যেন হারিয়ে না যায় দেখবে। তবেই ভূতের রাজার বর পাবে। আজ আসি, মনে রেখো।”
[ছবিঃ সুমন]