সত্য সময়জাত। মিথ্যা কল্পনাজাত। ভ্রম বাসনাজাত।
কিন্তু এসবে তার কী দরকার? তার তো কোথাও গেলেও হয়, না গেলেও হয়। কোথাও তো পৌঁছানোর তাড়া নেই তার।
সে একটা মস্ত ছায়া। গঙ্গার ধারে যে বিশাল বাড়িটা, এখন যেটা ভগ্নস্তূপ গো, ওই বাড়িটার ছায়ার কথা বলছি। সেই বাড়িটা একদম গঙ্গার ধারে না? লোকে আবর্জনা ফেলে যায় এদিক ওদিক। সেই বাড়িটার যে ছায়া পড়ে, এ তার কথা। সে ছায়া যখন সূর্য ওঠে তখন শুধু সবুজ মাঠের উপর পড়ে। আরেকটু বেলা গড়ালে ছায়াটা বাঁকতে বাঁকতে গঙ্গায় গিয়ে পড়ে। তারপর সূর্যের সঙ্গে ঘুরতে ঘুরতে ওদিক থেকে এদিকে এসে পড়ে। এদিকে তো গঙ্গা নেই। গলি, আর গলি, আর দুদিকে নতুন সব বাড়ি।
ছায়াটা সকালে জন্মায় আবার সন্ধ্যের আগেই মিলিয়ে যায়। আবার পরেরদিন জন্মায়। মেঘলা দিনে স্পষ্ট দেখা যায় না, কিন্তু জন্মায়, আবছায়া হয়ে।
ছায়াটা আজ যেন আটকে আছে। একটা মনসাগাছের তলায় এসে দাঁড়িয়ে পড়েছে। আজ এদিকে কেউ আসবে না। সবাই পুজো নিয়ে ব্যস্ত তো। কটা কুকুর আসবে। আর কিছু নেশাড়ু আসবে। বাকি কেউ আসবে না। কেউ যদি আসত, তবে সে খেয়াল করত সকাল থেকে ছায়াটা নড়েইনি।
ছায়া বাড়িটার দিকে তাকিয়ে বলল, আর কতদিন কিছু জানো?
বাড়িটা বলল, মামলা চলছে তো। শেষ হলেই এখানে পার্ক হবে না ফ্ল্যাট হবে ওরা ঠিক করবে। তুমি হারিয়ে যাবে।
ছায়া বলল, আমি তো অর্ধেক হারিয়েই আছি। তুমি আছ বলে আসতেই হয়। যেদিন তোমার খুব দিন ছিল সেদিন আমাকে চোখে পড়ত তোমার?
বাড়িটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, চোখে পড়ত। যখন তুমি গঙ্গা ছুঁতে, আমি আশ্চর্য হয়ে যেতাম আমার আকার দেখে। গর্ব হত। এখন ভয় হয়।
ভয় কেন হয়?
সেদিন আমার ঐশ্বর্য ছিল। সম্পদ ছিল। গৌরব ছিল। তার ছায়াকেও লোকে মান্যি করত। এখন এই ভগ্নস্তূপের এত বিরাট ছায়া….কী অর্থহীন….কী বালাই বলো তো…. অবশ্য তোমার কোনো দোষ দিই না….আমি আছি বলেই যে না তুমি আছ…..
দুপুর গড়িয়ে গেল। তাও ছায়াটা মনসাতলা ছেড়ে গেল না। ইতিমধ্যে গঙ্গার জল দুবার চলকে পাড়ে উঠে জিজ্ঞাসা করে গেছে….কই গো, এলে না?
ছায়া অপ্রস্তুত হয়ে পড়েছে। ইতস্তত করে বলেছে, এই তো আসছি…..
কিন্তু আসেনি তো।
বাড়িটায় কেউ থাকে না। তাই সচল মানুষের ছায়াও পড়ে না। আগে পড়ত। বাড়ির ছায়ায় তাদের ছায়া পড়ত, আবার ছাড়িয়েও যেত।
ছায়া তার আগের দিনের কথা ভাবতে ভাবতে আকাশের দিকে তাকালো। ঘন মেঘ করে আসছে গঙ্গার ওপার থেকে। মানে আজ তার তাড়াতাড়ি ছুটি হবে। কিন্তু যাবেই বা কোথায়?
এক নেশাড়ু এসে গেল। এসে ছায়ার মধ্যে বসল। গাঁজা ধরালো। দেখতে দেখতে তার চোখদুটো লাল হয়ে উঠল। ওপারে মেঘের দিকে তাকিয়ে বলল, থাম…. আসিস না এদিকে… আমার কল্কে নিভে যাবে….. খবরদার বলছি… .আসবি না….. বাবার দিব্যি….. জয় ভোলাশঙ্কর…. বাবা… বাবা….. কৃপা করো…. এ দাসকে উদ্ধার করো…..
তার চীৎকারে মনসাপাতার কয়েকটা পাতা কেঁপে উঠল। বাতাস উঠল হু হু করে। দেখতে দেখতে ঘুর্ণি তৈরি হল। এতে নেশাড়ুর কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই। সে দুটো চোখ বন্ধ করে টান দিচ্ছে। চোখের কোল বেয়ে জল গড়াচ্ছে। বিড়বিড় করে বলছে, বাবা…. সব ভেঙে দে… সব…. আমার বুকের খাঁচাটা ধ্বসে যাক…. বেরিয়ে আয় তুই… প্রজাপতির মত…. উড়ে বেড়া……
ছায়া দেখল ঝড়ে মেঘ উড়ে যাচ্ছে। রোদ উজ্জ্বল হয়ে উঠল আরো। নেশাড়ুর বুক থেকে একটা প্রজাপতি বেরিয়ে এলো। প্রজাপতির রঙ নীল। গায়ে হলুদ বিন্দু বিন্দু। সে উড়ে লোকটার ময়লা পাঞ্জাবির উপর বসল। ডানা মেলল দুবার। তারপর উড়ে তার হাতে বসল। আঙুলগুলো নিয়ে খেলা করল। তার নাকে বসল। চোখের পাতায় বসল। নেশাড়ুর ঠোঁটের কোণে আদুরে হাসির রেখা ফুটে উঠল। সে বলল, এসেছিস মা….. আয় আয়……
ভগ্নস্তূপ বাড়িটা বলল, ওর মেয়েটার এমনই একটা ফ্রক ছিল…. মনে আছে তোমার?
ছায়ার সব মনে আছে। মনে রাখতে চায় না, কিন্তু তবু মনে থাকে। সে বলল, আমি গঙ্গায় নামি…. তুমি এগোও…. আমাকে জলে নামিয়ে দাও…..
ঝড়ের হাওয়া প্রবল হল। মনসা উঠল দুলে। মনসাতলায় পুজো দেওয়া জবাগুলো উড়ে ছায়ার হাত ধরে বলল, আমাদেরও নিয়ে যাও জলে…. ভাসি…..
ছায়া গঙ্গায় নামতে নামতে দেখল লোকটার দুই চোখের ধারায় প্রজাপতির নীল ডানা যাচ্ছে ভিজে। লোকটা দুটো হাত জড়ো করে, বন্ধ চোখে বলছে, মা মা…. মা আমার…. যাস না আমায় ছেড়ে…. যাস না……
ছায়া গঙ্গায় ডুব দিল। জবাফুলগুলো ভেসে যেতে যেতে বলল, আসি গো….
মনসা উদাস চোখে তাকিয়ে বলল, আয়।