Skip to main content
 
প্রিয় ছাত্র-ছাত্রীরা,
 
       আমরা খুব অপরিচিত, অদেখা, অনিশ্চিত একটা সময়ের ভেতর দিয়ে যাচ্ছি। তোমরাও যেমন জানো না, আমরাও তেমন জানি না আগামী দিনগুলো কেমন হতে চলেছে। কবে আবার আমরা আমাদের স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারব। কবে তোমরা আবার ব্যাগ পিঠে স্কুলে, টিউশানে, খেলার মাঠে, বন্ধুদের বাড়ি যাতায়াত করতে পারবে। আমরা সবাই ভীষণ কঠিন একটা সময়ের মধ্যে দিয়ে পার হচ্ছি। তবে অনেকেই পরিস্থিতির সিরিয়াসনেসটা বুঝে উঠতে পারছি না, যেহেতু আমরা সবাই গৃহবন্দী হয়ে আছি। যা টিভিতে দেখি আর যা স্বচক্ষে দেখি তার মধ্যে অনেক পার্থক্য হয়। তাই আমাদের মনে হচ্ছে অনেকের, এটা হয় তো অমুক জায়গায় হয়েছে, আমাদের পাড়ায় হবে না, বা আমাদের বাড়িতে হবে না।
       আমার প্রিয় ছাত্র-ছাত্রীরা, এই ভাবনাটা আমাদের আশ্বস্ত করে বটে, কিন্তু এটা বাস্তব নয়। পরীক্ষার আগে যেমন আমরা ভাবি, আমরা যা পড়েছি, যেটুকু খুব ভালো লিখতে পারি, তাই যেন প্রশ্নপত্রে আসে, এই ভাবনাটাও তেমন। কিন্তু বাস্তবে কি তাই হয় বলো? যে প্রশ্ন আমাদের ভাবনাতেও আসেনি, তা-ও চলে আসে। আজকের ঘটনাটাও তেমনই। এই ভাইরাসটা ক্রমে ক্রমে অনেক মানুষকে আক্রান্ত করেই চলেছে, তার সংখ্যাটাও বেড়েই চলেছে। রোজ বাড়ছে।
       WHO বলছে ভাইরাসটা যদি নিজে থেকে go down না হয়, তবে তাকে push down করতে হবে। মানে ভাইরাসটা যদি এমনি এমনি চলে না যায়, তবে তাকে জোর করে ঠেকিয়ে রাখতে হবে। কি ভাবে? এই লকডাউন করে। এই 'লকডাউন' কথাটা কি খুব নতুন আমাদের কাছে? আমার মনে হয় না। যারা আমরা জিম করবেট পড়েছি তারা এই 'লকডাউন' নামটার সাথে পরিচিত না হলেও, ব্যাপারটার সাথে কিন্তু বেশ পরিচিত। নয় কি? জিম করবেটের অভিজ্ঞতায় আমরা কি দেখেছি মনে করো। আচ্ছা যারা জানো না তাদের জন্যেও বলে দেওয়া যাক।
       ধরো একটা গ্রাম, যা জঙ্গল থেকে খুব বেশি দূরে নয়। এখন মাঝে-মাঝেই সেই জঙ্গল থেকে কোনো নরখাদক বাঘ গ্রামে চলে আসে। বেশিরভাগ সময়েই রাতেই আসে। তবে কখনও কখনও দিনেও চলে আসে। কেউ একা রাস্তায় হাঁটছে, তাকে তুলে নিয়ে চলে গেল। কেউ বারান্দায় ঘুমাচ্ছে তাকে তুলে নিয়ে চলে গেল। এই করে গ্রামে একটা আতঙ্ক তৈরি হয়ে গেল। তখন তারা কি করল? গ্রামে সবাই বেশিরভাগ সময়েই ঘরের মধ্যে থাকতে শুরু করল। দরজা-জানলা ভালো করে এঁটে ঘুমাতে লাগল। এমন করে প্রায় কয়েক মাস তো বটেই, বছরও ঘুরে গেছে তবু সেই বাঘকে মারা যায়নি। তারপর জিম করবেট এসে বাঘটাকে মেরেছে।
       তা হলে যদ্দিন না জিম করবেট আসে, তদ্দিন কি করে কাটিয়েছে সবাই? এক রকমের লকডাউনে। যাতে বাঘ তার শিকার না পায়। আমাদেরকেও তেমন থাকতে হবে এখন যাতে ভাইরাস তার শিকার না পায়। কিন্তু এখানে দুটো মুশকিল। এক, বাঘ যেমন খালি চোখে দেখা যায়, আশেপাশে এলে গন্ধ পাওয়া যায়, গর্জন শোনা যায়, পায়ের ছাপ দেখে তার গতিপথ বোঝা যায় - ভাইরাসের বেলায় তো এসব কিচ্ছু হওয়ার জো নেই। এমনকি কে তার নিজের শরীরে ভাইরাস নিয়ে ঘুরছে তা-ও আমরা জানতে পারি না যতক্ষণ না তার শরীরে কোনো রোগের লক্ষণ দেখা যাচ্ছে - যেমন জ্বর, সর্দি, কাশি, শ্বাসকষ্ট ইত্যাদি। তবেই বোঝো কি মুশকিলের কাণ্ড!
       অতএব এখন আমাদের ধৈর্য ধরা ছাড়া আপাতত আর কোনো উপায় নেই। তবে এই সময়ে আমরা কি কি করতে পারি পড়াশোনা সংক্রান্ত বিষয়ে?
১) আমরা আমাদের আগের সিলেবাসের অঙ্কগুলো আবার করে ভালো করে প্র‍্যাক্টিস করতে পারি।
২) ইংরাজিতে লেখা, বাংলায় লেখার অভ্যাসটা বাড়িয়ে নিতে পারি, যে কাজটা অন্য সময়ে হয় না। প্রতিদিন না হোক, একদিন অন্তর একটা করে প্যারাগ্রাফ দুটো ভাষাতেই লিখে বাড়ির বড়োদের দেখাতে পারি, বা স্যারেদের পাঠাতে পারি। এতে দুটো সুবিধা হবে, এক, লেখার অভ্যাস বাড়বে; দুই, ভোকাবুলারি বাড়বে।
৩) পড়া সংক্রান্ত ছবিগুলো প্র‍্যাক্টিস করা যেতে পারে।
৪) যাদের নতুন বই হাতের কাছে এসেছে তারা নিজেরা পড়তে শুরু করতে পারো, পড়তে পড়তে আটকাবে তো নিশ্চয়। তখন স্যারেদের সাথে বা বাড়ির বড়দের সাথে আলোচনা করা যেতে পারে। সেটা পড়ার মত করে না হলেই ভালো। যেমন করে আমরা গল্প করি তেমন করে করলেই সহজ হবে।
৫) পড়ার বইয়ের বাইরে কিছু বই পড়ে দেখা যেতে পারে।
       একটা মূল কথা মাথায় রাখতেই হবে। এই মুহূর্তে আমাদের সিলেবাসের নিয়মের ধরাবাঁধা শিক্ষা হয় তো আটকে আছে, কিন্তু তা বলে আমার শেখার, জানার ইচ্ছাটাকে তো কেউ আটকাতে পারে না। সেই ইচ্ছাটাই তো আসল। তাই যে কোনোভাবে রোজ নতুন কিছু শিখতে হবে একটা, এইটা নিজেকে প্রমিস করো। আজ যেমন দেখো সারা বিশ্বের লোক হাত ধোয়া শিখছে নতুন করে। আগে আমরা এমন ঘন ঘন এত যত্ন করে হাত ধুতাম? নয় তো। আজ শিখছি। তাই এই শেখার ইচ্ছাটা আমাদের আসল, এইটা মাথায় রাখতে হবে। অনেকদিন ধরে একরকম চলছিল বলে আমরা ভাবতে শুরু করেছিলাম হয় তো স্কুল-কলেজ-কোচিং ক্লাস মানেই শিক্ষা। তা নয়। পারলে রবীন্দ্রনাথের 'তোতাকাহিনী' গল্পটা পড়ে নাও। শিক্ষা মানে অনেক বড় কিছু। আমরা সবাই তার ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ধাপ। সবটা নই। আসল কথাটা হল শেখার, জানার ইচ্ছা।
       সব শেষে একটা কথা বলে রাখি। আমাকে অনেকে বলছে অনলাইন পড়ানোর জন্য। কিন্তু সেটা আমার পক্ষে সম্ভব নয় জানো তো। কারণ আমার অনেক ছাত্রছাত্রী আছে তাদের ব্যক্তিগত স্মার্টফোন নেই, অনেকের থাকলেও এতটা করে ডেটা কেনার অবস্থা নেই। এগুলো তোমরা অনেকেই এখনই বুঝবে না, কিন্তু যত বড় হবে জানবে আমাদের মত দেশে মানুষের প্রাথমিক চাহিদাগুলোতেও অর্থের মূল্যে পার্থক্য হয় অনেক। সে থাক, আপাতত এইটুকু বোঝো যে যাদের সুবিধা আছে তাদেরই যদি শুধু পড়াই তবে অনেকের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করা হয়। সেটা আমি কর‍তে পারি না। সব ঠিক হোক। আমরা সবাই আবার 'রে রে' করে ঝাঁপিয়ে পড়ব আমাদের পড়াশোনা নিয়ে।
       ততদিন সবাই সুস্থ থাকো। ভালো থাকো। বাড়ির বাইরে বেরিয়ো না। যদ্দিন না আমাদের সাথে একজন জিম করবেটের দেখা হয়।