Skip to main content

দীর্ঘদিন অনলাইন ক্লাস নিচ্ছি, কয়েকটা বিশেষ বৈশিষ্ট্য খেয়াল করছি ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে। তাদের ব্যবহারগুলো অনেক ক্ষেত্রে ভীষণ অসামাজিক শুধু না, ভীষণ অভদ্রোচিত। এটা কি করে হচ্ছে জানি না, নাকি আমি মফঃস্বলে থাকি বলেই এটা ফেস করছি জানি না। কয়েকটা উদাহরণ দিই--

    ১) আমি গুগুল মিটে ক্লাস করাই। ভিডিও অফ থাকে। ক্লাস শুরু করতে চলেছি, শুরুতেই যদি বলেন, শুনতে পাচ্ছিস তোরা? সবাই চুপ। দু-তিনবার জিজ্ঞাসা করার পর কেউ হয় তো বলবে, হ্যাঁ স্যার পাচ্ছি।

    ২) পড়া বোঝানো হল। আপনি জিজ্ঞাসা করলেন, বুঝেছিস তোরা? আবার সবাই চুপ। যতক্ষণ না আপনি জনে জনে নাম ধরে জিজ্ঞাসা করছেন। 

    ৩) পড়া ধরছেন। কোনো একজনের নাম ধরে তাকে পড়া বলতে বললেন, সে যদি জানে তবে বলবে, যদি না জানে, নো রেসপন্স। আপনি অপেক্ষা করে বসে আছেন, সে ওদিকে স্পিকার অফ্ করে বসে আছে। 

    এই পড়া বলা নিয়েও দারুণ অভিজ্ঞতা। বেশিরভাগ ছেলেমেয়ে সোজা বই খুলে উত্তর বলে যাচ্ছে। বই খুলে উত্তর টুকে পাঠিয়ে দিচ্ছে। আপনি কিছু বলতে পারবেন না, কারণ আপনার কাছে প্রমাণ নেই। দুটো ওয়েভের মধ্যে যখন কিছুদিন আবার সামনা সামনি ক্লাস চলছিল, তখন পড়া ধরলে বা লিখতে দিলে আশানুরূপ ফলই আসছিল। কেউ ভালো, কেউ মোটামুটি, কেউ একেবারে খারাপ। কিন্তু অনলাইন মানে সব বে-আইন। মজার কথা হচ্ছে ভালোর সংখ্যা অত্যন্ত কম। সৎ মানুষের সংখ্যাও আরো কম। যদিও সততার আশা করাটা নাকি আজকালকার দিনে অবাস্তব কিছু আশা করা, আমায় একজন গার্জেন বললেন। যারা বই খুলে উত্তর দিয়ে যাচ্ছে, বই খুলে উত্তর লিখে পাঠিয়ে দিচ্ছে তারা কোনো গুহায় বা জঙ্গলে বসে নেই, তারা বাড়িতেই বসে আছে, তাদের চারদিকে তাদের অভিভাবকেরাও আছেন। কিন্তু অনেক অভিভাবকদের যুক্তি, "অনলাইন তো স্যার, বুঝতেই পারছেন, আসল পড়া তো নয়.."

    যাদের দীর্ঘদিন শিক্ষকতার অভিজ্ঞতা আছে তারা জানেন যে কে কতটা সততার সঙ্গে পরীক্ষা দিচ্ছে সে বোঝার ক্ষমতা আপনিই জন্মে যায়। 

    যদিও মানুষ কোনোদিন স্বেচ্ছায় সৎ নয় বলেই পরীক্ষাগারে পরীক্ষক আর সিসিটিভি ইত্যাদির ব্যবস্থা থাকে, সে জানি, কিন্তু তার জন্যে ব্যবস্থা যদি অভিভাবকেরা না নেন তবে সত্যিই ভীষণ মুশকিল। স্কুল খুলছে না বলে যতই লাফালাফি করি না কেন, নিজেদের যে দায়িত্বটা এই অভাবনীয় অভূতপূর্ব সময় দাবী করছে অভিভাবকদের কাছে তা যদি সঠিক অর্থে পালন না করা যায় তবে সত্যিই ভীষণ সমস্যা আগামীদিনে। কারণ আগামীদিন আদৌ আগের দিনের মত হবে কিনা জানা নেই। সুতরাং স্কুল আর গৃহশিক্ষকের দায়ে সবটা ছেড়ে দিলে আর চলবে না। পড়াশোনার নতুন নতুন কৌশলের সঙ্গে, এই সম্পূর্ণ নতুন পরিস্থিতির সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে গেলে অভিভাবকদের দায় এখন সম্পূর্ণ অন্যভাবে ভাবতেই হবে। শুধুমাত্র স্যার ম্যাডামের মার বা শাস্তির উপর নির্ভর করেই ছেলেমেয়ে মানুষ হবে, এ অলীক বিশ্বাস ছাড়ার দিন এসেছে। সততা, ভদ্রতা শিখবে না, শুধু ভয়ে আর ত্রাসে উতরে যাবে, এ আশায় দিনযাপনের দিন আর নেই। আচমকাই সব বদলে গেছে। মাঝেমাঝেই এরকম ওয়েভের পর ওয়েভ আসবে, পড়াশোনা ক্রমে ডিজিটাল হবে, তার সঙ্গে খাপ খাইয়ে ছেলেমেয়েদের নীতিগতভাবে ঠিক আর যথার্থতার সঙ্গে শিক্ষার দিকে নিয়ে যেতেই হবে। তবেই আগামীদিনে যে নতুন ধরণের প্রতিযোগিতা আসতে চলেছে তাতে ঠাঁই পাওয়া যাবে। নইলে সবটাই ফাঁকি। 

    আরেকটা ঘটনার উল্লেখ করে শেষ করি। আমার এক ছাত্র মাধ্যমিকে ভালো ফলাফল করায় সরকারের তরফ থেকে তাকে সম্বর্ধনা দেওয়া হয়। সে সেই ছবি আমায় পাঠায়। আমি সেটা তাদের গ্রুপে পাঠাই। মজার কথা হল, এক সপ্তাহ হয়ে গেলেও কেউ একজন তাকে অভিনন্দন বা কংগ্র‍্যাচুলেশনস শব্দটা লিখল না। আমি সত্যিই অবাক হলাম। যে ছেলেমেয়েরা প্রায় সারাদিন ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম ইত্যাদি নানা ধরণের সোশ্যাল মিডিয়ায় এত সক্রিয়, তারা ব্যক্তিগত পরিসরে এত অভদ্র, এত অসামাজিক কেন? ছেলেমেয়েরা পড়াশোনায় অল্পবিস্তর ফাঁকি দেবে, এ বাস্তব, কিন্তু এমন অভদ্র হবে, এ কিরকম কথা! 

    এর উত্তর আমাদের খুঁজে পেতে হবে। আমাদের একটা কথা স্পষ্ট বুঝতে হবে। হঠাৎ করে গোটা বিশ্ব বদলে গেছে। আবারও বলছি, আবার সব আগের মত হবে তার কোনো আশা দেখা যাচ্ছে না। আগামীদিন নতুন ধরণের প্রতিযোগিতা আসছে। সেখানে আপনি যতই সরকারের নীতির সমালোচনা করে দিন কাটান, অনলাইনে পড়াশোনা হয় না বলে লাফালাফি করুন, আপাতত অন্য কোনো বিকল্প নেই। সবাই কি আর অনলাইনে পড়াশোনার সুযোগ পায়?... এই সব যুক্তিও কাজে লাগবে না, কারণ শিক্ষা আমাদের দেশে বহুকাল আগে থেকেই পণ্য হয়ে গেছে। বড়োলোকদের ইংরাজি মিডিয়াম আর খুব গরীবলোকেদের বাংলা মিডিয়ামের চল বহুদিন হল এসে গেছে। তাই এই অসাম্য নিয়েই চলবে। মেনেও নিতে হবে। কিন্তু অসাম্য এক কথা, আর অসততা আরেক কথা। একটা কথা মনে রাখা ভালো, সততা আর পরিশ্রমের কোনো বিকল্পও কিন্তু বড় ক্যানভাসে জীবনটাকে দেখলে নেই। কোনোদিন হবারও নয়। চালাকি দিয়ে, শর্টকাট খুঁজে কেউ কোনোদিন বড় রাস্তায় এসে পৌঁছায়নি আজ অবধি। গলির অন্ধকারেই কেঁদে কঁকিয়ে গোটা পৃথিবীকে অসৎ বলে গাল দিয়ে জীবন কেটেছে। 

    তবে সব বিষয়ে যেমন ব্যতিক্রম আছে, এই সবের ব্যতিক্রমও কিছু ছেলেমেয়ে, অভিভাবক আছেন। কিন্তু তারা আপাতত ট্রেণ্ড অনুযায়ী ব্যতিক্রমই।