মাথার উপর ছাতা। সর্বক্ষণ। রোদজল কিছুই গায়ে লাগে না। উপরে তাকালে দেখে কালো ছাতা। নীচে দেখে ছাতার ছায়া। সেই ছায়ার বাইরে যা কিছু, সে বলে অনাবশ্যক। আমার কি তাতে?
সে ছাতার নীচেই ঘুমায়। ছাতা মেলেই খায়। শৌচাদিও ছাতার নীচেই।
একদিন সে বাজার করে ফিরছে, এক পাখি কোত্থেকে এসে ঠুকরে দিল তার ছাতা। ছাতায় হল ফুটো। সে ফুটো দিয়ে এসে পড়ল রোদ। রাতে দেখা গেল তারা। লোকটা ভাবল এত কিসের আবর্জনা বাইরে? ছাতার বাইরে এত বড় জগৎ? এত বাড়তি? এত অতিরিক্ত? কোনো সংহতি নেই?
সে ভীষণ রেগে গিয়ে বলল, সারা বিশ্বব্রহ্মাণ্ডকে আনবো ছাতার তলায়। ছায়ার নীচে। সে নানা ভাষার সংকেত আবিষ্কার করল। ছাতার ঘের বাড়ালো, যা ধরতে দশজন ষণ্ডামার্কা লোক চলে এলো। সে ছিদ্র দিয়ে বাইরের জগতের একটা মাপ নিল। সেই ছিদ্র দিয়ে যা-ই দেখে তার একটা নক্সা তার ছাতার ভিতরের দিকে এঁকে রাখল। ক্রমে তার ছাতার তলা হল বিচিত্র নক্সা কল্কে আঁকা এক অদ্ভুত জিনিস।
লোকে ভাবল, বাহ! এ তো বেশ! অনেক লোক তার ছাতার তলায় ভিড় করতে লাগল। তার ছাতার তলায় আঁকা নক্সা দেখে শ্রদ্ধা জন্মালো। তার আবিষ্কার করা নানা শব্দসম্ভারে ভক্তি বাড়ল। আরো বিশ্বাস বাড়ল ওই দশজন ষণ্ডামার্কা মানুষদের দেখে। এইভাবে একটা প্রকাণ্ড মানুষের দল তৈরি হল ছাতার নীচে।
তুমি কি ভাবছ, সারা বিশ্বে এই একটাই ছাতা? উঁহু। আরো আরো ছাতাওয়ালা জন্মালো। তারা বলে জগত দেখো না, এই ছাতা দেখলেই হবে। ওতেই সব আঁকা আছে। এরপর যখন মরে যাবে, উই উপরে চলে যাবে, সেখানে তোমার ছাতার নাম জিজ্ঞাসা করবে। ছাতার রঙ জিজ্ঞাসা করবে। বলতে পারলেই তোমায় এমন ছাতার তলায় রাখবে যে দুঃখ বলে কিছু মালুমই হবে না। আর যদি এই নীচের দিকে নিয়ে যায়, ছাতাদ্বেষীদের যেখানে নিয়ে যায় আর কি, সেখানে গেলে দেখবে কোনো ছাতা নেই। শুধু দুঃখ তীরের মত বিঁধছে সারা শরীর।
যুগের পর যুগ গেল। ছাতার ঘের বাড়ল। নক্সা বাড়ল। নতুন ছাতাওয়ালা জন্মালো। আবার এ ছাতার সঙ্গে সে ছাতার দলের লোকেদের কত মারামারি হয়ে গেল। এ ছাতার আঁকা টুকে সে ছাতার লোকেরা নতুন ছাতা বানালো। দিনে দিনে হল কি জানো? ছাতায় ছাতায় মাটি ছেয়ে যেতে লাগল। তবে সব ছাতাওয়ালার মিল কোথায় জানো? তারা কেউ আকাশের দিকে কাউকে তাকাতে দেয় না। রোদজল গায়ে মাখতে দেয় না।
আর যারা ছাতার বাইরে থাকে, কি ছাতার ভিতর থেকে হঠাৎ দম আটকে আসে বলে, বলে ওঠে, "বাইরে যাব"… অমনি কেউ কেউ তার দেহখানা ছিন্নভিন্ন করে দেয়, কেউ তার ধোপানাপিত বন্ধ করে দেয়, কেউ তার নামে আজগুবি সব কুৎসা রটায়, কেউ বলে সে নাকি আরেক অদৃশ্য ছাতার তলায় আছে, আসলে সে আরো চালাক।
কি সমস্যা হচ্ছে জানো, এই ছাতাজীবী মানুষগুলো এমন এক ছাতার জগত বানিয়েছে, অনেকে ভুলেই গেছে যে ছাতার বাইরে একটা আকাশ আছে। তার চারদিকে অসীম জগত আছে।
যদি এসব তুমি বলতে যাও, তারা বলবে, কেন ভাই? আমরা কি মানুষকে ছাতার তলায় নিয়ে এসে তাকে সুখশান্তি দিইনি? জীবনের অর্থ যে সব এই ছাতা রহস্যে লুকিয়ে আমরা কি বলিনি? তোমরা কি দেবে? খানিক উত্তর না পাওয়া সংশয়ের ঝুড়ি।
তাকে যদি বলো, ভাই, এই খোলা আকাশের নীচে থাকতে থাকতে, রোদজলে বাড়তে বাড়তে মানুষ আপনিই একটা এই সব কিছুর সঙ্গে সামঞ্জস্য করে নেয়। সুরটা ঠিক খুঁজে পায়… অমনি তারা কানে আঙুল দেবে… বলবে ওহে, তোমার কোনো সংস্কৃতি, সংস্কার নেই? যত্তসব অলুক্ষুণে কথা? এতবড় সংসারে রক্ষা পেতে যদি এই ছাতাখানা মেলে না ধরতেন আমাদের সেই ছাতার প্রদর্শক!
তাকে যদি বলো সেই ছাতার তলায় তার চিত্তের মরণ ঘটছে অহরহ.. সে ঘাবড়ে গিয়ে বলবে, ওই শব্দটা যখন তখন বলো কেন? চিত্তকে শুদ্ধি না করে চিত্তের নাম মুখে আনতে নেই জানো না?
যদি জিজ্ঞাসা করো সেই শুদ্ধি কেমন?
সে বলবে, চিত্তকে ছাতাগামী করে তোলাই শুদ্ধি… তখনই সে দলে আসে…. ঠাঁই পায়..
তুমি যদি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলো, তাই সে বিশ্বানুগ হয় না..
তারা বলবে, ওসব কথা আমাদের ছাতাশাস্ত্রে লেখা নেই… এই জগতের স্রষ্টা আমাদের পূর্বপুরুষকে এই ছাতা দিয়ে বলেছিলেন জগতের সব নিয়ম এই ছাতার তলায় রইল… ছাতার মধ্যে সব সত্য, বাইরে সব মিথ্যা… এমনকি আমাকেও যদি ছাতার বাইরে দেখো জানবে সে ভ্রম… বুঝলে?
মানে আর কি তারা বলতে চাইল… মানলে?
বোঝা আর মানার দ্বন্দ্ব ঘুচাতে তুমি হাল পাবে না…. কারণ বুঝতে যত বেগ পেতে হয়… মানতে নয়… আর কোনো কিছু মেনে নেওয়াকে যারা ব্যাখ্যা করে বোঝাতে চায়… তারা বোঝার আগেই বুঝে থাকে… বাকিটা শুধু শব্দ নিয়ে একটা গোল টানে… যার কেন্দ্রে থাকে প্রকাণ্ড একটা ছাতা… তাই ছাতার থেকে রেহাই নেই… বুঝলে ভায়া….