Skip to main content

এত সকালে জলখাবার করলে দিদি?

আজ ছেলেটা কলকাতা যাবে গো

একজন বয়স্কা মহিলা, কলের তলায় বাসন মাজছে, আরেকজন ওর চেয়ে অল্পবয়েসি মহিলা গঙ্গার ধারে সিঁড়ির উপর বসে কথা বলছে। দুজনেই বিধবা। সামনে মা কালীর মন্দির, রাধাকৃষ্ণের মন্দির।

আর বোলো না… এই সাত সকালে ছেলেটা বেরোবে… জলখাবার করে আজ মন্দিরের কাজে লাগতে অনেক দেরি হয়ে যাবে… এমনিতেই রবিবার… ভিড় বেশি….

তাই তো দেখছি

মন্দির থেকে মা বললেন, কাল খিচুড়িতে নুন বেশি দিয়েছিলি…

বাসন মাজতে মাজতে সে বলল, আমার ছেলে খেতে পারে না অমন আলুনি…. জানোই তো….

মা বললেন, টাকা বাড়ানোর কথা বলেছিলি এদের? তোর ওষুধের যা খরচ….

সিঁড়িতে বসা মহিলা বলল, আর বললেই বা কে শুনছে মা…. এই বুড়ো হাভাতে পুরুষগুলোর গুমর দেখো না… নড়তে চড়তে বারো মাস… রেঁধে মুখের সামনে না ধরলে পেটে পিত্তি পড়ে মরবে… তাও…..

মা বললেন, আরে ধীরে বল… ইনি ঘুমাচ্ছেন… উঠলেই আবার শুরু করবেন….

বাসন মাজতে মাজতে মহিলা বলল, আমার মড়াটা আজ কি করছে গো? শরীর ছাড়া ইস্তক তো যা ডানা গজিয়েছে….

মা বললেন, ধুর… আজকাল আর অত খেয়াল রাখি না…. এদিক বল, ওদিক বল… মনের কারখানা রে…. সে শরীর থাকুক চাই না থাকুক… এই দেখ না… নথটা দেখ… কবে থেকে বাঁকা পরিয়ে রেখেছে…. সোজা করে পরাবার কথা মনে থাকে এদের?... উপরের ঝাড়লণ্ঠনটা দেখ…. জন্মের ঝুল পড়ে….

তুমি বা একটু গতর খাটিয়ে ঠিক করে নাও না কেন মা? তোমাকেও বলিহারি যাই…. সিঁড়িতে বসা মহিলা বলল।

মা বললেন, খেপেচিস… একটু ওসব দেখালে এখানে এমন ভিড় লাগাবে যে তোর বাসন মাজতে মাজতে কোমর খসে যাবে…. আর তোর এই তল্লাটে আসা ঘুচে যাবে… চারদিকে পাহারায় পাহারায় আমার প্রাণ ওষ্ঠাগত করে রেখে দেবে…. মা নিজের নথ নিজে বদলেছেন…. নিজের ঝুল নিজে ঝেড়েছেন… এমন প্রচার লাগাবে যে ইনি আমায় কৈলাসেও আর ঢুকতে দেবেন না…. বলবেন যাও গিয়ে সেলিব্রিটি হয়ে থাকো…. জানিস তো…. আজকাল…. হুজুগ তুললেই সব হত্যে দিয়ে এসে পড়বে….

তা মা সবাই যায়ই বা কোথায় বলো…. বাসনগুলো ঝাঁকায় রাখতে রাখতে বলল…

আহা যাবে না কেন… আসবে আসুক… কিন্তু আমায় একটা সোজা কথা বল অন্যকে শান্তি দিতে না চাইলে কেউ নিজে শান্তি পায়?....

=====

ছেলে বেরিয়ে গেল। দুই মহিলা বসল মন্দিরের চাতালে।

মা বললেন, ছেলে তো প্রেম করছে….

বাসন মাজা মহিলা বলল, জানি তো। নিয়ে এসেছিল না… ও.. সেদিন তো তুমি ভীষণ ব্যস্ত…. পয়লা বৈশাখ ছিল….

হঠাৎ তারস্বরে চ্যাঁচাতে চ্যাঁচাতে একজন মহিলা ঢুকল। কপালে বিরাট সিঁদুরের টিপ। স্থূল শরীর ঘেমেনেয়ে একশা।

"মা গো…. ডাকাত সব এক একটা… ডাকাত… এই মিষ্টি নাকি পঞ্চাশ টাকা নিল… বলি তোমায় প্রণামীই বা কি দেব…. আর ফেরার টোটোভাড়া…. মাগো মা…."

কপালটা সিঁড়িতে ঠুকতে ঠুকতে সে মহিলা বসে পড়ে বলল, এখনও পুরুত আসেনি গো….

বাসন মাজা মহিলা বললেন, না না… আরো আধঘন্টা…

মা বললেন, একটু বসে ঠান্ডা হ আগে….

সে বলল, আর ঠান্ডা হ… কাল তোমার জামাই মাল খেয়ে এসে…. উফ শ্বশুরে জামাইয়ে যা মিল গো মা….

মা বললেন, দেব এক থাপ্পড়… বাবাকে নিয়ে ওসব বলা… উনি একটু খান ওসব… কিন্তু আমায় অসম্মান করতে কবে দেখলি….

সিঁড়িতে বসা মহিলা বলল… তা ঠিক গো… তারপর ঘুরে আগের প্রসঙ্গে ফিরে বলল...... তা দিদি তোমার হবু বউমা কেমন?...

বাসন মাজা মহিলা বলল, ওই যেমন হয় আর কি…. ভালোই….

শ্যামসুন্দরের মন্দির থেকে শ্রীরাধা বলে উঠলেন… ইস… তাই না তাই… ও তোমার ছেলেকে খুবই ভালোবাসে…. দেখো ভালোই সংসার করবে….

বাসনমাজা মহিলা বলল, তুমি থামো রাইদিদি…. নিজে সংসার করলে বুঝতে…. ও আগে থেকে কিছুই বলা যায় না গো…. শ্যামের বাঁশিতে ডুবে আছ সেই ভালো….

শ্রীরাধিকা বললেন, তুমি ডোবোনি?

=======

বাসনমাজা মহিলা হাতের উপর হাতটা রেখে বলল, ছিল একজন জানো…. আমার দাদার বন্ধু…

শ্রীরাধা বললেন, তারপর?

সবাই কি আর জাতের বাইরে যায় গো… মুসলমান ছিল….. বাড়িতে বললে কচুকাটা করে দিত…..

শ্রীরাধা বললেন, আর তোমাদের?

স্থূল মহিলা বলল, না রাইদিদি… আমার ওসব হয়টয়নি… পনেরোতেই বাবা একজনের গলায় ঝুলিয়ে দিলেন… সেই থেকে আমি তেনাকে ধরে ঝুলে আছি… আর তিনি আমাকে ধরে কুমড়োর মত গড়াচ্ছেন…. একে যদি প্রেম বলো তো প্রেম….

সিঁড়িতে বসা মহিলা বলল, আমার একবার প্রেম হল জানো… আমার মাসির ছেলের সঙ্গে…. সে শালার আমার হৃদয়ের থেকে হৃদয়ের খোসার উপর ছুঁকছুঁক ছিল বেশি…. আমি ভাবতুম এই বুঝি প্রেম… তখন অল্প বয়স… খারাপও লাগত না…. কিন্তু মনে একটা ধন্দ লাগত ব্যাটা আমার কথা তো শোনে না… খালি ফাঁকা ঘর খোঁজার ধান্দা… বলি প্রেম কি হাগামোতা যে রাতদিন নির্জনে করতে হবে…. একদিন যেই একটু বেশি এগিয়েছে দিলুম খামচে….

স্থূল মহিলা বলল, কি দিদি?

বাসনমাজা মহিলা বলল, অ্যাই… কি সব অসভ্যতা হচ্ছে….?

স্থূল মহিলা বলল, ও… তেনারা রসে মুখ ডুবিয়ে খেয়ে গেলে দোষ নেই….. আমি মুখে শুধু বললেই অসভ্যতা…..

শ্রীরাধা বললেন, বুঝেছি… প্রেম মানে আসলে বোঝোইনি তোমরা….

তিনজনে একসঙ্গে বলে উঠল….. থাক থাক রাইদিদি… ও তোমার প্রেম বুঝে আমাদের কাজ নেই…. বৃন্দাবনে তুমি পাও প্রেম… আমাদের হনুমান সামলাতে সামলাতে প্রাণ যায়… কেন তোর চশমাটা নিয়ে গেল মনে নেই…. (বাসন মাজা মহিলা সিঁড়িতে বসা মহিলাকে বলল)..... আমাদের একটু মানইজ্জত নিয়ে জীবন কাটিয়ে দিতে পারলেই হল গো… শুধু এইটুকু আশীর্বাদ কোরো…. তবেই হবে…. সুখ চাই না গো… একটু স্বস্তি হলেই হয়…

======

অ্যাই… অ্যাই… মন্দিরে বসে কি গুলতানি হচ্ছে?

স্থূল মহিলা বলল, এই যে… এখন আসার সময় হল… আর গুলতানি কি দেখছেন? গল্প করছি….

পুরোহিত বলল, গল্প আমার ঢের জানা আছে…. সব পরনিন্দা পরচর্চা… তাও মন্দিরে বসে….

স্থূল মহিলা বলল, ঢং রাখো ঠাকুর… তোমরা চাট্টি রাজনীতি, খেলা, সিনেমা নাটক নভেল নিয়ে চর্চা করলে ওটা খুব ঠিক চর্চা হয়… ওগুলোও পরচর্চা…. আর আমরা যে এই পরনিন্দা পরচর্চা দিয়ে সংসারের কত নোংরা ন্যাতাকাতা থুপে থুপে পরিষ্কার করি সে তো বুঝতে হয় না…. সংসারের অলিতে-গলিতে ঢুকেই দেখো না…. আপসে সব বেরোবে….

মন্দিরের মা বললেন, রাখ তো… এদের বোঝানো….

শ্রীরাধা বললেন, তোমরা ভালো থেকো…. মা যদি আশীর্বাদ হয়… আমি চিত্তের অনির্বচনীয় সুখ… মনে রেখো….

স্থূল মহিলা বলল, তোমরা আমাদের প্রণাম নিও… এই জ্ঞান থাকতে থাকতে… ভুলচুক ক্ষমা কোরো… আর কি যে মনে থাকবে আর থাকবে না সে হলফ করে কি বলি রাইদিদি…. হয় তো বিছানায় হেগেমুতে পড়ে থাকলাম… নিজের নামই হয়ত মনে নেই… তা তোমাদের… তবে ওপারে এলে আমরা চিনতে না পারলেও তোমরা চিনে নিও…. আর কি বলি…

মা বললেন, যা তোরাও ওঠ… আমি মন্তর শুনি…. আর শোন…. ফেরার টোটো পেয়ে যাবি…. তোদের পাড়ার নরেন…. ও ফাঁকা আসবে এদিকে… তোকে নিয়ে নেবে….

স্থূল মহিলা বলল, মা আর লোক পেলে না… ও তো যা ছোঁচা…

শ্রীরাধা বললেন, তোমায় চায় বুঝি….

সিঁড়িতে বসা মহিলা ঠোঁটে আঙুল দিয়ে বললে, অ্যাই রাইদিদি… চুপ… কি হচ্ছে….

বাসনমাজা মহিলা বলল, যা যা মর মর..

শ্রীরাধা বললেন, বালাইষাট!