Skip to main content

নিভা তার কাঁচাপাকা চুলগুলো গামছায় মুছছিল। হাত থেমে গেল। পরেশের নাতিটা স্নান করে বাঁধানো পুকুরঘাটে ছোটো ছোটো পায়ের ছাপ ফেলে এক দৌড়ে উঠে চলে গেল। নিভা পায়ের ছাপগুলোর দিকে তাকিয়ে। মনটা কঁকিয়ে উঠল। ভাদ্রের সূর্য বড় নিষ্ঠুর। সব ছাপ এখনই মিলিয়ে নেবে। নিভা ঘাড় তুলে রাস্তার দিকে তাকালো। কেউ নেই। নিজের ষাট ছুঁইছুঁই স্থূল শরীরটা হেঁচড়ে সামনের আবছা হয়ে আসা পায়ের ছাপটার কাছে নিয়ে এলো। ঘাড়টা নীচু করল। টাটালো। তবু জোর করে নীচু করল। খয়েরের লালে লাল হওয়া ঠোঁটটা ঠেকালো বাঁধানো ঘাটে। আবছা হয়ে আসা পায়ের ছাপে। দু ফোঁটা চোখ নিঙড়ানো জল গড়িয়ে নামল ঘাটে। ভাদ্রের সূর্য এও শুষে নেবে। বড় নিষ্ঠুর।

খিদে পাচ্ছে। স্নানের পর খিদে পাওয়া আজন্ম স্বভাব। দাহের পর নাভি জলে দিলেও খিদেতে টাটাবে। নিভার জন্য খাবার বেড়ে বসে থাকার কেউ নেই। নিভা নতুন একটা খাবার শিখেছে। ম্যাগি। যে বাড়িতে কাজ করত, তারাই শিখিয়েছিল। একা মানুষের জন্য বেশ খাবার। নিভার মনে পড়ল ম্যাগীর প্যাকেট শেষ। মুড়ি আছে। দুপুরটা চলে যাবে।

শিব মন্দিরের সামনে এসে দাঁড়ালো। মাথাটা টাল খাচ্ছে অল্প। প্রেশারটা বেড়েছে বোধহয়। ওষুধ কেনা হয়নি। ঘাড়টাও ব্যথা করছে দুদিন হল। একটু পর পরেশের নাতিটা স্কুলে যাবে। নিভা বাড়ি যাবে না। এই মন্দিরের চাতালে বসে থাকবে, দেখবে তাকে। পরেশের নাতির ভালো নাম, অঞ্জন। ডাকে অঞ্জু বলে। বাইশ বছর কাজ করেছে নিভা ওদের বাড়ি। অকারণে ছাড়িয়ে দিল। একটু মানিয়ে নিতেই পারত। কিন্তু সে নাকি ভীষণ ‘স্লো’ হয়ে যাচ্ছিল। পরেশের বউমা বলল। ছাড়িয়ে দিল। এখন পুজোয় একটা শাড়ি দেয় আর পাঁচশো টাকা। পরেশ এসেই দিয়ে যায়। সে গেলে আর কেউ দেবে না, জানে নিভা।

ছেলেটা গেল না কেন?

আধঘন্টা হয়ে গেল। নিভা ভুরু দুটো কুঁচকে চাতালে বসে। এত তো দেরি করে না। একাই যায়।

নিভা উঠল। পরেশের বাড়ির দিকে এগোতেই কানে হইহট্টোগোলের আওয়াজ এলো। আনন্দের আওয়াজ। কি হল?

দরজার কাছে এসে দাঁড়াতে চোখ পড়ল পরেশের চোখে। পরেশ এগিয়ে এসে বলল, আরে দিদি এসো এসো… আজ তো অঞ্জুর জন্মদিন… ওর মামারা এসেছে আমেরিকা থেকে। তোমাকে বলাই হয়নি… ছি ছি… এসো এসো।

নিভার নিজের উপর রাগ হল। তাই তো, আজ পনেরোই ভাদ্র। আজই তো… ছি ছি। সত্যিই তার কিছুর যোগ্যতা নেই আর।

পরেশের বৌমা এসে বলল, তুমি এসেছ পিসি… একটু চন্দনটা বেটে দাও না গো।

নিভা এ বাড়ির আনাচকানাচ জানে। ঠাকুরঘরে ঢুকে চন্দন বাটতে বসতে যাবে, পরেশের বৌমা এসে একটা থালায় লুচি, আলুর দম আর মিষ্টি দিয়ে গেল। বলল, আগে খেয়ে নাও পিসি। তারপর বেটো। খালি পেটে কাজ করলে আমার শাশুড়ি মা বকতেন।

নিভা লুচির থালাটা নিয়ে বাইরে বারান্দায় এসে বসল। অঞ্জু একটা লাট্টু নিয়ে খেলছে উঠানে। তাকে ঘিরে ওর মত আরো দু চারজন। আত্মীয় হবে। এদিকে তো দেখেনি কোনোদিন।

হঠাৎ দৌড়ে এলো অঞ্জু। বলল, কি খাচ্ছ পিসিদিয়া… দেখি…

নিভার বুকের মধ্যে যেন হাতুড়ির বাড়ি পড়ল। মনে হল দুটো হাতে জড়িয়ে বুকের সঙ্গে মিশিয়ে নেয়। নিজেকে সামলে বলল, লুচি, সোনাটা আমার… খাবে?

অঞ্জু তার ছোটো হাতটা বাড়িয়ে থালা থেকে একটা মিষ্টি তুলে দিল দৌড়। নিভার চোখ ঝাপসা। মাথাটা ঘুরে গেলো। সব অন্ধকার।

ঠাকুমা… ও ঠাকুমা…

চোখ খুলল। নীল আকাশ। চড়া রোদ। কোথায় সে?

জোড়া শিবমন্দিরের চাতাল। সামনে দাঁড়িয়ে রত্না। পরেশের বাড়ি কাজ করে এখন। হাতে কিছু একটা ধরা।

আমি তো ভাবলুম পটল তুললে বুঝি… সকাল থেকে খাওনি নিশ্চয়ই কিছু… এই নাও একটা মিষ্টি খাও… আজ ও বাড়ির খোকার জন্মদিন তো … মিষ্টি পাঠালো…

নিভা হাতটা বাড়ালো। রত্না একটা সন্দেশের একটু ভেঙে দিয়ে বলল, বেশি দেয়নি গো।

রত্না চলে গেল। নিভা বসে থাকল কিছুক্ষণ। জন্মদিন ভোলেনি তবে। অতটাও তো অথর্ব হয়নি তবে। ডাকল… রত্না…

রত্না ফিরে এলো। একটু ঘাবড়ে গিয়ে বলল, শরীর খারাপ লাগছে?

নিভা বলল, না রে, আমায় একটা কাজ দেখে দিবি রে বোন…

রত্না বলল, পারবে?...

নিভা একগাল হেসে বলল, পারব রে… অতটাও বুড়ি হয়নি এখনও…