Skip to main content
 
 
 
 
 
 
 
 
 
চেনা জগতে আঘাত লাগল। চেতনায় রঙ লাগল। প্রেম এলো। প্রেম এলে ঘরের দরজা মেলার দিকে খোলে। তখন এড়িয়ে যাওয়ার সময় নয়, ঝাঁপিয়ে পড়ার সময়। বেরোলাম। মানুষের ভিড়ে। রাস্তা দেখালো ভালোবাসা। হাত বাড়ালো বন্ধুত্ব। এগোবার শক্তি দিল বিশ্বাস। দাঁড়াবার জায়গা দিল আস্থা। 
 
হাজার মানুষের ভিড়ে দাঁড়ালাম। ছটপূজো। অবাঙালীদের পূজো। হাজার হাজার লোক চারদিকে। আবালবৃদ্ধবনিতা। অন্যরকম শাড়ীর রঙ। সিঁদুরের রঙ অন্য। ভাষা অন্য। প্রথমে নিজেকে একটু বহিরাগত মনে হল। আমি কি অবাঞ্ছিত? চলতে ফিরতে সঙ্কোচ। মনের মধ্যে আমরা-ওরার দ্বন্দ্ব। রাস্তায় ভিড়। গাড়ির যানজট। উন্নাসিক বাঙালীর সঙ্কুচিত, উপেক্ষা উদ্যত নাসিকা। বুঝলাম আমার বাধছে কোথায়। বুঝতেই বাধা কাটল। মনে ছিল অহং। উচ্চ সংস্কৃতিমনস্ক বাঙালী সঙ্কীর্ণতার ছদ্ম জাত্যাভিমান। বুঝতেই খসে পড়ল সে আবরণ। মেলা বাইরে থেকে ভিতরে এলো। আমি আমাকে ছেড়ে সবার মাঝে এলাম। 
 
ও কে রাস্তায় শুয়ে শুয়ে এগোচ্ছে? ওর মানত। কার কাছে? দেবতার কাছে? কোন দেবতা সে? চিনি না। এত মানুষের মধ্যে যিনি, তিনি কে? কোন সূত্রে সব একত্রিত? জানি না। বাজি ফাটছে। বিস্ফারিত চোখে বাচ্চাটা বাবার কোল থেকে নামতে চাইছে না। ওই যে বৃদ্ধা একমনে জলের মধ্যে দাঁড়িয়ে কাকে জোড়হাতে কি বলছেন মনে মনে। ওই দেখো আরো কত মহিলা জলের মধ্যে ওর পাশে দাঁড়িয়ে। ছোটবেলা থেকে উনি এমনই আসছেন এই দিনে, এরকম করে উপোস রেখে। দেবতা খুঁজতে না। নিজেকে খুঁজতে। 
 
তা কি করে হয়? হয় হয় ভেবে দেখো। যখন বহু নরনারী কালে কালে একই উৎসবের মাধ্যমে নিজেদের একসাথে খুঁজে পায় তখন তাকেই কি মিলনক্ষেত্র বলে না? সেকি শুধু একদিনের একবেলার আয়োজন? বাইরে থেকে তা মনে হতে পারে। কিন্তু ওই যে রমণী জলে দাঁড়িয়ে চোখবুজে...তুমি ওর মনের জলে নেমে দেখো, সেখানে অতীত বর্তমান ভবিষ্যত সব একজলে মিশে একাকার। ও নিজেকে একা ভাবছে না এখন। ও ভাবছে ও চিরকালের সবার। এই বোধটা দেয় উৎসব, প্রথা। সে অতীতের সাথে বর্তমানের পরিচয় ঘটায়। একের সাথে বহুর মিলন ঘটায়। তাই এ তীর্থ।
 
ওই সেই বৃদ্ধাকে দেখো। তিনি কোমর জলে দাঁড়িয়ে। ক্রমে ক্রমে তার দুই ছেলে, তাদের স্ত্রীরা, নাতিনাতনিরা, সব শেষে তার স্বামী দেওর গিয়ে একে একে জল দিচ্ছে ওর আঁচলে ধরে থাকা দেবতার অর্ঘ্যে। বৃদ্ধার মুখের হাসিটা দেখো। ওই হাসিটার জন্য তপস্যা করেছিলেন আজ। খাননি সারাদিন। কিচ্ছু পেটে না দিয়ে এতটা রাস্তা দণ্ডী কেটে এসেছেন। শুধু এই প্রসন্ন ক্ষণটিকে নিজের জীবনে সার্থক করবেন বলে। তার পরিবারেই তার মুক্তি। হাজার বন্ধনের মধ্যেই তার প্রভুর আসার পথ। সবাইকে বাদ দিয়ে নয়, সবাইকে নিয়েই। 
 
গান শুনছ? মানে বুঝছি না। আমিও বুঝছি না। গান গাণিতিক সূত্র না। মানে না বুঝলেও হবে। মনে লাগলেই হল। মনে লাগছে? হ্যাঁ। কেমন লাগছে? কি যেন বলতে চাইছে। কি বলতে চাইছে? বুঝছি না। বুঝছ, বলতে পারছ না। বলতে চাইছে, ‘আমি ভালোবাসি, আমি বিশ্বাস করি। এই আমি তোমার। আমায় বৃহতের মধ্যে স্থান দাও।‘ 
 
তুমি এই দেহাতি ভাষা বোঝো তবে? না রে মূর্খ। ভাষা বুঝি না, ভাব বুঝি। ওই দেখো ওই শিশুটাকে তার মা রাস্তায় শুইয়ে দিল। দেখলে? হ্যাঁ দেখলাম তো, কিন্তু কেন? আরে বুঝছ না, ওর সামনে যে পুরুষ মানুষটা দণ্ডী কেটে চলেছে তার পায়ের ধুলো নেবে বলে। কিন্তু এতো অন্ধবিশ্বাস? হ্যাঁ তো। কিন্তু তবু ওর কোনো ক্ষতি হবে না, কেন জানো? মানুষের সব ভুল শুধরে দেয় ভালোবাসা। ওর মায়ের চোখদুটো দেখো, ওই ভালোবাসায় শুদ্ধ হবে সব। তুমি অবিশ্বাসী পড়ে থাকবে এই মেলার শেষে ঝরা ফুলের ছেঁড়া পাঁপড়ির মত। না লাগলে দেব সেবায়, না মানুষের। সারাটা জীবন পায়ে ধুলো না লাগার ফিকির খুঁজে বেড়ালে। আজ এতো শুদ্ধ পা তোমার যে মাটিতে ফেলতেও ভয়! মাটিও ভয় করে তোমায়, এটা যেদিন বুঝবে, সেদিন এই মাটির বুকে আছাড়িপাছাড়ি খেয়ে কাঁদবে...মাটি আবার বুকে নেবে...
 
তার্কিক মেলা ছেড়ে উধাও হল। আমি একা দাঁড়ালাম ভিড়ের কোণে। সামনে সন্ধ্যে নামা জলাশয়ের প্রদীপ জ্বালা বুক। টলটল করছে কালো দীঘির জল। বুক টাটালো। একটা ভেলায় ভাসছে একটা প্রদীপের শিখা। আমার মন চড়ল ভেলায়। 
প্রদীপকে বললাম ভয় করছে না?
প্রদীপ বলল, কেন?
বললাম, এতবড় দীঘি, তুমি এইটুকু শিখা, যদি নিভে যাও, যদি যাও ডুবে? 
প্রদীপ স্মিত হেসে বলল, তোমার বুঝি খুব ভয়? 
আমার কান্না পেল। হ্যাঁ তো। কিন্তু সে তোমায় বলি কি করে? চুপ করে থাকলাম।
প্রদীপ বলল, দেখো, হয় তো আমি ডুবে যাব খানিক পরেই, হয় তো আমি নিভে যাব হাওয়ায়, কিন্তু তা বলে এই যে এই মুহুর্তের আমার আলো, একি ব্যর্থ হবে? এই যেটুকু আলো উদ্ভাসিত করে রেখেছি আমার চারধার, হোক সে তুচ্ছ ওই প্রকাণ্ড আলোর স্তম্ভের কাছে, তবু এইটুকু গর্বেই তো ভাসিয়েছে আমায়, আমার স্রষ্টা এই ভেলায়। আমি মুখ মলিন করে ভাসলে যে তার আমার দুজনেরই লজ্জা, নয়কি! 
আমার মনের মধ্যে চমক লাগল। সাশ্রু নয়নে ভেলার দিকে চাইলাম। আমার চোখে ঝরল একবুক কৃতজ্ঞতা।
প্রদীপ বুঝল। সে বলল, দেখো, তোমার নিজের মধ্যেও আছে এক আনন্দদীপ, তাকে জ্বালিয়ে রাখো। জেনো, এই আনন্দকে প্রকাশ করবে বলেই তোমার জন্ম। ঝড়ঝাপটায় সে আনন্দদীপকে নিভতে দিও না। আনন্দই প্রভুর স্পর্শ। আনন্দতেই তাঁর অস্তিত্ব। এত মানুষের মিলন সে আনন্দময়ের মুখের আভাস যে! দেখতে পাওনি?
 
তাকিয়ে দেখলাম এক কিশোর একটা বড় বাঁশের মাথায় নানান খেলনা বানিয়ে বিক্রী করছে। তার মুখের দিকে তাকালাম। অকারণেই হাসলাম। সেও হাসল। জানি না ওর আজ খাওয়া জুটেছে কি না, তবু ওর মুখের মধ্যে এমন এক আনন্দের আভাস দেখলাম, এমন পরিতৃপ্ত হেসে তাকালো সে, মনে হল ও তো পরিপূর্ণ, কিছুই যেন অভাব নেই! না হলে এমন মিষ্টি হাসি হাসল কি করে? 
 
সে আমার পাশ দিয়ে গেলো, বলল না, নেবে বেলুন? নেবে খেলনা?...বলল না তো...
শুধু আরেকবার হেসে তাকালো...আমি ওর মাথার মধ্যে হাতটা বুলিয়ে দিলাম...মনে মনে বললাম, আমি আবার আসব...তুমিও এসো...আমার আনন্দময়...সে আবার হাসল...আমিও হাসলাম...আমার সামনের বড় বড় আলোগুলো ঝাপসা হয়ে এলো...চোখের কোল ভারি হচ্ছে...ফিরি এবার...আমার হাতে সেই কিশোরের মাথার গন্ধ...আনন্দের গন্ধ...
 
 

 
 (ছবিঃ সুমনদেবাশিষ)