আমার একজন শিক্ষক ছিলেন। ভীষণ বামপন্থী। এমনই বাম যে হৃৎপিণ্ডের মাধ্যমে রক্তসঞ্চালন বোঝাতে গিয়ে বলেছিলেন, বাম অলিন্দ নিলয় দিয়ে শুদ্ধ রক্ত যায়, কারণ বামেরা সব সময় শুদ্ধ।
আজ দেখলাম তিনি বিজেপিতে যোগ দিলেন। সে দিতেই পারেন। বুদ্ধ বলতেন জগতে একটাই অপরিবর্তনীয় সত্য যে সব কিছুই পরিবর্তনশীল। ভালো কথা। কিন্তু সেদিনের সেই ধর্ম নিয়ে বিদ্রুপ, সেদিনের সেই ঈশ্বর বিশ্বাসকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দেওয়া। সে সবও নিশ্চয়ই পরিবর্তন হয়ে গেছে। নইলে কোটি টাকার রামমন্দিরের ব্যাখ্যা খুঁজবেন কোথায়?
জানি না। আসলে অনেক কিছুই বহুদিন হল বুঝি না। আমাদের ছোটোবেলায় পাড়ায় কিছু কসমোপলিটান কাকুদের দেখতাম। তারা অনেকেই উচ্চপদস্থ, সমাজের নানা গুরুত্বপূর্ণ কাজে জড়িত। তারা অফিস থেকে ফিরে সন্ধ্যেবেলা ক্লাবে, কি চায়ের দোকানে একটা লুঙ্গি আর ফতুয়া কিম্বা হাফ শার্ট পরে আড্ডায় বসতেন। চা, তাস ইত্যাদি থাকত। সেই আড্ডার গল্পে অনেক কিছু জানা হয়ে যেত। বিশ্বের অনেক খবর তারা রাখতেন, নিজস্ব একটা মতামত রাখতেন, দৃষ্টিভঙ্গি রাখতেন। খুব সাধারণ মানের জীবনযাপন করতেন। রাজনৈতিক বিশ্বাসও এক একজনের এক এক রকম থাকত, কিন্তু সে বিশ্বাসটা অনেকটাই বিশ্বাসের কাছাকাছি হত, মতলবী কথাটা চট করে মনে হত না। তার মানে এই নয় যে সবাই তেমন ছিলেন, অবশ্যই নয়। কিন্তু ইদানীং এই ধরণের মানুষদের আর খুঁজে পাই না। মানুষ আজকে যতটা গ্লোবাল হয়েছে, যতটা আন্তর্জাতিক বাজারের উপভোক্তা হয়েছে ততটা বিশ্বজনীন হয়নি। এ আমার মনে হয়, ভুলও হতে পারি।
খুব বদলে যাচ্ছে সবটা চারপাশে। মানুষ বিশ্বাস করে না আর কিছুতেই। নিজের পার্থিব জগতে লাভ হলেই চেয়ার বদলে ফেলে। কোনো বিশ্বাস আর মজ্জা অবধি শিকড় ছড়িয়ে দেয় না। সব বনসাই। মানুষ যেন ওয়ালপেপারের মত বদলে বদলে যাচ্ছে। যখন যেটা ভালো লাগে। এটা কখন হয়? যখন আমরা জানি আমাদের চারপাশে আসলে কেউ দেখার নেই। সবাই নিজের লাভজনক পোশাক খুঁজছে। বাসাংসি জীর্ণানি যথা বিহায়। সবাই নতুন পোশাক খুঁজছে। অথচ মানুষকে জানি আমরা লাভের থেকে বেশি কিছু বলে। যদিও সত্যটা তাই। পার্থক্যটা এই যে হঠাৎ করে আমরা আর লজ্জা পাচ্ছি না কিছুতেই। সে দুর্গার সঙ্গে রামের পিতৃপরিচয় খুঁজতেই হোক কি গরুর দুধে সোনা খুঁজেই হোক। আমরা ভুলে গেছি আমাদের সবাই দেখছে। ইতিহাস দেখছে, সময় দেখছে, গোটা বিশ্ব দেখছে। শুধু কিছু সুযোগসন্ধানী মানুষ আছে তাই তো না। কিছু মানুষ আছেই যাদের যে কোনো একটা বিশ্বাস মজ্জার ভিতর অবধি গিয়ে আছে। সব রাজনৈতিক দলেই থাকে। তারা যতটা বিশ্বাস করে ততটা ঈর্ষা করে না। যতটা এগিয়ে যেতে চায়, ততটা ঘোলা জলে মাছ ধরতে চায় না। অনেক অনেক মানুষ নিশ্চয়ই আছেন, আসবেন আবার যাদের দেখে মানুষ বলবে এরা ক্রয়যোগ্য পিচ্ছিল মানুষ না। এরা দৃঢ়চেতা, আদর্শদাঁড়া মানুষ। ধুস করে রঙ বদলে বা ডুব সাঁতারে অন্য কোথাও গিয়ে বলবে না, এই যে আমি এদিকে। বলবে আমায় খুঁজতে হলে এদিকেই আসবেন, সে আমার দিন ভালো কাটুক কি মন্দ।