Skip to main content



---

অনেকেই অনেক সময় প্রশ্ন করেন - কি ভালো লাগে - সমুদ্র না পাহাড়? কি উত্তর দেব বুঝে পাই না। আমার তো সবই ভালো লাগে নদী-পাহাড়-সমুদ্র-জঙ্গল...শহর-গ্রাম-বাজার-মাঠ...সব। ভালো লাগে না শুধু বাড়ির চার দেওয়ালের শাসন অনেকদিন একটানা। 
এবারেও লাগল না। সেরকম কাউকে কিছু না বলে কয়ে, আচমকা কয়েকজন বন্ধু মিলে চললাম উত্তরবঙ্গে। অবিশ্যি ফিসিফিসানি ছিলই কানে কানে বেশ কিছুদিন ধরেই...উত্তরবঙ্গ...কাঞ্চনজঙ্ঘা...।
গন্তব্য - লাভা। উদ্দেশ্য - কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখা। কতলোক কত করে বলল, “ওরে এসময় দেখা যায় না, যায় না। যাস না, যাস না।” কে কার কথা শোনে? কানে বেজেছে...অনুগ্রহ করে শুনবেন...১৩১৪৯...শিয়ালদহ থেকে আলিপুরদুয়ার যাওয়ার ট্রেন...
অগত্যা বসে পড়লাম সদলবলে। ভিতরে ভিতরে তো সবাই জানি, কাঞ্চনজঙ্ঘা একটা ছুতো... (সংসারী মানুষদের মোটা দাগের একটা উদ্দেশ্য না বোঝালে যুক্তিটা ঠিক খোলতাই হয় না কিনা!)
পৌঁছালাম লাভা। কুয়াশা কুয়াশা চারদিক। তার সাথে শীতল কনকনে ঠাণ্ডা। দাঁত-কপাটি লাগার জোগাড়। ঘড়িতে বাজে সাড়ে তিনটে প্রায়। খাওয়া-দাওয়া শেষ। চললাম বুদ্ধের মনাস্ট্রি। দুর্বোধ্য ভাষায়, শিঙ্গা ফুঁকে চলছে কি সব মন্ত্রপাঠ। ঘন কুয়াশার মতই অস্পষ্ট। বললুম বই পাওয়া যায় - হিন্দী বা ইংরাজীতে? তারা বললেন -উঁহু...মনে যে কোনো খেদ হল তাদের তাও মনে হল না। বুঝলাম এনারা জাগতিক সব ব্যাপারের বহু ঊর্দ্ধে। যা হোক ওদের না ঘাটিয়ে আর শুরু হল শহর পরিভ্রমণ। 
পরের দিন চললাম নেওড়া ভ্যালি জঙ্গল পরিদর্শনে। হাতে লাঠি। পাতে জুতো। চড়াই পথ, হাপরের মত বুক করছে - ফোঁসফোঁস...যেন বলছে - রোস রোস। ঘন জঙ্গল। কল্পলোকে যতই বাঘ-ভাল্লুক-হাতি-গন্ডার থাকুক, বাস্তব লোকে তারা খাঁচায় আর টিভির পর্দাতেই থাকুক তাই ভালো। ইতিউতি তাকাতে তাকাতে একটা পিক পয়েন্টে নিয়ে গিয়ে গাইড বলল, দ্যাখেন। 
বাপ রে! ওই অত্ত উঁচু থেকে দ্যাখনের কি আসে? তাও হেঁটে আসতে হল শিকড়ের তৈরী সাঁকো দিয়ে। শিকড় জল পরিবহন করবে এ মানা যায় ( উদ্ভিদবিদ্যার ছাত্র হয়ে), মানুষ পরিবহন করবে তা বলে! যা হোক, জিভ-ঠোঁট শুকিয়ে দেখলাম সামনের দিগন্ত ঢাকা মেঘ আর জঙ্গল। 
ফিরে আসতে না আসতেই - ছেঙ্গী ফলস রব উঠল। দুপুরের আহারাদি সেরে চললুম। পথের কথা না বলাই ভালো। নেহাত শরীরের হাড়গোড়গুলোর সাথে পেশী মাংসের একটা নমনীয় সম্পক্ক আছে। না হলে যে কোনো মুহুর্তে বিচ্ছিন্ন হওয়ার পূর্ণ অবকাশ আছে। গাড়ি যেখানে ছেড়ে দেয়, তার থেকে নামতে হয় অনেকখানি নীচে। পায়ে হেঁটে। সে পথ ভূমিকম্পে আর বৃষ্টিতে এমন অবস্থা, যে কোনো মুহুর্তে যমরাজের ট্র্যাভেল এজেন্টের সাথে দেখা হয়ে যেতে পারে। তিনি হয় তো একগাল হেসে হাতটা বাড়িয়ে দিয়ে বলবেন, -কত্তা আর ওদিকে যাওনের দরকার নাই, যা একখান অধঃপতন হইসে আপনার এদিকের টিকিট কনফার্ম এক্কেবারে। ( জন্ম অবধি অবিশ্যি ওদিকের টিকিট ওয়েটিং লিস্ট বা আরএসি তে তো থাকেই) । 
বন্ধু-বান্ধব ছবি তুলছে। আমি সুমনকে কইলাম, ভাইরে নামতে যত সোজা উঠতে তত নয়! সব মহাপুরুষজন কইসে...চল সে কথাটা মেনে চড়তে শুরু করি, ওরা ধীরে ধীরে আসুক। ওঠো। আমার আগে খান কয়েক রামছাগল। বাঙালী রামছাগল না, নেপালী রামছাগল। আমাদের দেখেই অদ্ভুত স্বরে ডেকে উঠল, আর আগে আগে উঠতে লাগল। হাসল কি না বলতে পারি না। যুধিষ্ঠিরের সাথে কুকুর উঠেছিল শাস্ত্রে লেখে, আমার আর সুমনের সাথে উঠতে লাগল রামছাগল! যত উঠি, একটা একটা করে গরম পোশাক খুলি। ঘেমেনেয়ে অস্থির, যতটা না শ্রমে, তার থেকে বেশি ভয়ে। মোটামুটি চক্ষুলজ্জার খাতিরে যতটা না পরলেই নয়, সে বস্ত্রটুকু অঙ্গে ধারণ করে উঠলুম। 
হোটেলে ফিরে দুঃসংবাদ, এক ফটোগ্রাফার বন্ধুর ক্যামেরা বিগড়িয়েছে। কোথাও ঠিক হবে? কালিঙপং। আমাদের কথা ছিল যাব রিশপ ট্রেক করে। সাথে সাথে প্ল্যান বদলে হল - কালিঙপং। আসলে ওই যে বললুম, উদ্দেশ্য নাতো রিশপ, না তো কাঞ্চনজঙ্ঘা। উদ্দেশ্য তো একসাথে বাঁধন আলগা করে দেওয়া। তারপর ভাসো হাওয়ার টানে। 
ন জন মানুষকে পেটে পুরে দুটো গাড়ি চলল কালিঙপং মুড়ির টিনের মত বাঁ-ডাঁ ঘোরাতে ঘোরাতে। চালক - করণ। নেপালী। বয়েস তিরিশের নীচে। সে আমাদের সাথে অবশ্য সেই ট্রেন থেকে নামা থেকেই আছে। আলাপ জমল এই কালিংপঙের পথে। করণ উপাখ্যান।
করণ ছোট বয়েস থেকেই পড়ার বইয়ের থেকে বেশি ভালোবাসল প্রকৃতিকে। উঁহু, সেই প্রকৃতি না? এ শাস্ত্রীয় প্রকৃতি, মানে রমণী। এমন মজে গেল যে সকালবেলায় সে নাকি আর স্কুলেই আসতে পারত না। চোখ ঢুলুঢুলু করত। অগত্যা স্কুল ছেড়ে ড্রাইভারী, অতি অল্প বয়েস থেকেই। প্রেমে পড়বি পড়, এক আর্মির মেয়ে। তাকে তিন বারের অধ্যবসয়ে অপহরণ করে বিয়ে করতে সফল হয়। এখন তাদের চার বছরের বাচ্চা। এরপরে করণের কথা বাঁক নিল আদিরসের দিকে। নেপালী ছেলে মেয়ের মিলন। তার নিজের জীবনের নানান রঙীন রাতের প্রায় পুঙ্খানুপুঙ্খ ব্যাখা। তাকে থামায় কার বাপের সাধ্যি। গাড়ি চালানোর হাত তার অসাধারণ! থেকে থেকেই বলে - চলুন জুলুক, চলুন গুরুদম্বা...জানেন আমি বরফ ঢাকা রাস্তায় গাড়িতে চেন লাগিয়ে পর্যন্ত্য পার্টিকে নিয়ে গেছি। লোকে বলেছে তুই মরবি করণ...আমি বলেছি পৌঁছাতে যদি না পারো পার্টিকে, তবে টাকা নাও কেন? মিথ্যা আশ্বাস দাও কেন? 
করণের কথার ফাঁকে চোখ ঘুরছে পাহাড়ের দুর্গম বাঁকে আর পথ চলতি সব মেয়েদের দিকে নিরবচ্ছিন্নভাবে যুগপৎ। তার কথায় আমার তো পেটের খিল ব্যথা হওয়ার জোগাড়। এত নিষ্পাপভাবে মানুষ তার সব কথা কিসের জোরে এমন স্বল্প পরিচিতের কাছে উজাড় করে বলতে পারে! পারে পারে। মনের মধ্যে স্বচ্ছ ধারা বইলে পারে। গতি থাকলে পারে। যত নোংরা তো জমা জলেই। সে ধর্মেই জমুক আর অধর্মেই।


---


কালিঙপং যাওয়ার আগেই ঠিক হয়েছিল রিশপ যাচ্ছি আমরা। এসে পৌঁছালাম সন্ধ্যে হব হব। ভালো লাগল না জায়গাটা। এদিকে ফেরার ট্রেনের আরো দুদিন দেরি। কি করি? শুরু হল আমাদের ভ্রমণ উদ্যোক্তার সাথে আলোচনা, বাদ-বিতণ্ডা। শাখা- প্রশাখায় জল একবার এদিক গড়ায় একবার ওদিক। তেনজিং ছিল প্রধান পুরুষ। এবার এলো নানান উপদেবতারা, হরি একজন তাদের মধ্যে। এদিকে যতই বোঝাই দ্যাখো বাপু হয়রান কোরো না, তোমার প্রাপ্যটুকু নিয়ে রেহাই দাও। সে বলে, উঁহু! এদিকে করণ বলে আমি বাড়ি যাবো। সে মেলা দূরের পথ। আমরা তাকে কেউ কেউ আটকিয়ে 'বাবা বাছা' করে, নরমে গরমে ওদিক সামলিয়ে সন্ধ্যে সাতটা নাগাদ ঠিক করলুম লাটাগুড়ি জঙ্গলে যাব। নেটে খোঁজ নিয়ে ঘর পাওয়া গেল। নজন মিলে একটা গাড়িতে বসে বললুম - চলো। পাহাড়ি লোকেরাও বলল, আরে যেও না যেও না, অনেক রাত হবে যে! 
আর নিষেধ! মাঝে টায়ার ফাটল। গাড়ির শকার ভাঙল। সব বাধা-বিপত্তি কাটিয়ে যখন এসে পৌঁছালাম লাটাগুড়ি, প্রায় এগারোটা। করণকে কিছুতেই রাখা গেল না। সেই রাতেই সে বাড়ি ফিরবে, বউয়ের থেকে তিন দিন দূরে যে, তাও আজ ভ্যালেন্টাইন্স। অগত্যা দিলাম বিদায়। হোটেলের বয় কাম সব দেখাশোনের ভার পড়ল বসনের হাতে। পঁচিশ বছর হবে বয়েস। কালো রোগা মত ছেলেটাকে বিধাতা যেন ছেলে গড়তে গড়তে অন্যমনস্ক হয়ে গিয়ে মেয়ের মন দিয়েছেন পুরে। আমরা যখন খেতে বসি, সে পর্দার আড়ালে নিজেকে কিছুটা আবৃত রেখে খেয়াল রাখে কার কি লাগবে। ভাত ফুরোতে না ফুরোতেই ভাত দিয়ে যায়, জল ঢেলে দিয়ে শূন্য গ্লাসে না চাইতেই। আমরা যখন ফিরি সে দূর থেকে দেখতে পেয়েই খাওয়ার গরম করতে বসায়। এ করণ না, এ বসন। বাইরে দুজনেই পুরুষ। অথচ নয়ও।
কথা হল জঙ্গল সাফারিতে যাওয়ার। যাত্রা-প্রসাদ টাওয়ার। সাড়ে তিনটে স্টার্টিং। দিনে চারটে হয়। টিকিটের জন্য এগারোটায় লাইনে দাঁড়ানো গেল। টিকিট দেবে একটা থেকে। শুনলাম মারপিটও নাকি হয় টিকিটের লাইনে। এটা অফ সিজন। মার্চ থেকে হবে সিজন আবার। 
আড়াইটের সময় দুটো জিপসিতে চেপে চললাম গরুমারার দিকে। সুন্দর মসৃণ রাস্তা। দুদিকে ঘন জঙ্গল। জিপসিতে খোলা ছাদের নীচে দাঁড়িয়ে...হু হু করে ছুটে চলেছি...সে এক থ্রিলিং অনুভূতি। জঙ্গলে ঢোকার মুখে আটকালো। বলল খুলবে সাড়ে তিনটে। তাই কথা। কি করব এই আধাঘন্টা? একটার পর একটা জিপসি এসে দাঁড়াতে লাগল লাইন দিয়ে। কি আর করা হবে...ওঠাও সেলফি। লগির মাথায় ফোন। টকটক সব ছবি উঠতে লাগল। কেউ রাস্তায় শুয়ে পড়ে তো কেউ হুমড়ি খেয়ে বুক চিতিয়ে পোজ দেয়। কেউ গার্লফ্রেণ্ডকে/ বউকে কোলে-কাঁখে-হাতে-পাশে ইত্যাদি নানান জায়গায় নিয়ে ছবি উঠছে। আমরাও তুলে ফেললাম নিজেদের ছবি। তুলে দিলামও খানিক এর ওর সাহায্যর জন্য। 
গেট খুলল। সার দিয়ে জিপসি ঢুকতে লাগল ঘন জঙ্গলের ভেতর। রাস্তার এদিকে ওদিকে ময়ূর। গলার কাছটা এমন নীল হয় কি করে? পেখমেতে এমন রঙ হয় কি করে? এক এক সময় মনে হয়, ভালোবাসার রঙ লাল না, গাঢ় নীল, অমন ময়ূরের মত নীল। করণের কথা মনে পড়ল - “এমন সুন্দর সে মেয়েটাকে দেখতে সাবজি, মানো কি, তুমি ওকে তুলে চোখে বসিয়ে নেবে তো তোমার চোখ দুখবে না"।
করণ তুমি কি কবি? ভালোবাসা কি এই জঙ্গলের মত রহস্যময়? কত মানুষ সে জঙ্গলে এসেছে। পথ হারিয়েছে। আমার সে চোখদুটোর কথা মনে পড়ল। তুমি চিতাবাঘের মত নিষ্ঠুর। অসহ্য। 
থাক সে সব কথা। মনের মধ্যে ঘন জঙ্গলে প্রেমের ইলশেগুড়ি বৃষ্টি। চুপচুপ, ওই দ্যাখো গণ্ডার। ওই দ্যাখো ময়ূরের পেখম তোলা নাচ। 
ফেরার পথে রাস্তা আগলালো বাইসন, উঁহু ইন্ডিয়ান গওর। সে যাই হোক, বাইসন। গতকালই নাকি ঢুঁসিয়েছিল একটা জিপসি। সে কি প্রকাণ্ড তার আকার, তেমনই রাজকীয় তার চাল। সব জিপসি নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে। সবাই প্রমাদ গুনছে, কার কপালে আছে আজকের ঢুঁসো। ড্রাইভারদের চোখেমুখে বেশ আতঙ্কের ছাপ, বিশেষ করে যারা সামনের দিকে। আমরা দু নম্বরে। পিছনের দল সব মোবাইল হাতে দাঁড়িয়ে, ঢুঁসো খাওয়ার ছবি তুলবে। অনেক লাইক, অনেক কমেন্টস। 
সব বিফলে গেল। বাইসন জঙ্গলে হারিয়ে গেল। আমরা হারালাম মানুষের ভিড়ে আদিবাসী নৃত্যের আসরে। নাচ হল। শহর বেড়িয়ে হোটেলে ফেরা হল। কানের মধ্যে ফিসফিসানি আবার - এবার যে ফিরতে হবে। 
হবে তো। প্রতিটা ভ্রমণ কি দেয়? অভিজ্ঞতা। প্রতিটা ক্ষণ কি দেয়? অভিজ্ঞতা। সে ভালো-মন্দ কোনোটাই না। তার একটা কেতাবী নাম আছে, আমারও প্রিয় সে নাম - শিক্ষা। আমার পরিচয়ের সাথে শিক্ষক শব্দটা জড়িয়ে। কবি অথবা লেখক বললে যেন মনে হয় অন্য কাউকে ডাকছে, অথবা আমার ভোটার কার্ডে যেন অন্যের নাম ছেপেছে, শিক্ষক শব্দটায় সেটা হয় না। কারণ একটাই, শিখতে ভালোবাসি। ওই একটা জিনিসই বাঁচার তাগিদ দেয়। সিলেবাসের ভিতরে যা না শিখেছি, তার থেকে ঢের বেশি শিখেছি আউট-অব-সিলেবাস। আমার নজন সাথীর মধ্যে একজনকে বাদ দিলে সক্কলেই কোনো না কোনো কালে আমার ছাত্র ছিল, আজ সবাই একসাথে শিখছি। সিলাবসের বাইরের জীবনটাকে। 
গুরু? পেয়েছি তো। নাম ঠিকান? খুঁজছি তো। পথে ঘরে, সজনে-বিজনে। তার একটাই শিক্ষা - অভয় আর ভালোবাসা। ফেরার ট্রেন আসছে। উঠতে হবে। কাঞ্চনজঙ্ঘা? দেখার কথা ছিল, না? আসব তো আবার...

Category