সৌরভ ভট্টাচার্য
14 April 2019
একটা বটগাছ। এই জঙ্গলে এই একটাই বটগাছ। আকাশবাণী হয়েছে, গাছটা কাল মারা যাবে। বাকি গাছেরা মন খারাপ করে আছে। সন্ধ্যা হব হব। পাখিরা ক্লান্ত শরীরে তাদের নীড়ে ফিরছে। কিন্তু তাদেরও মনটা আজকে খারাপ। তারাও খবরটা জানে। জানে না শুধু মানুষেরা। তারা একটু দূরেই গ্রামে থাকে। পাখিরা পনেরো দিন আরো সময় পাবে নতুন বাসা দেখে নেওয়ার। কিন্তু বড়রা বলছে তাড়াতাড়ি বাসা ছেড়ে দিতে, কারণ মানুষেরা আজকাল খুব লোভী, যেই না খবর পাবে গাছটা মারা গেছে, সব দা-কুড়ুল নিয়ে চলে আসবে।
বটগাছটা সব বুঝতে পারছে, তবু চুপ করেই আছে। তার বয়েস হল দুশো তিপ্পান্ন বছর আটমাস ন’দিন। সূর্য ডোবা দেখতে দেখতে তার ছোটোবেলার কথা মনে পড়ল অনেকক্ষণ। ভালো লাগল। কিন্তু ভালো লাগাটা মিলিয়ে গেল। যত বয়েস হয়েছে তত তার মনে হয়েছে কিছু একটা গোলমাল হচ্ছে মাটিতে আকাশে বাতাসে। কিন্তু কি যে সে গোলমালটা বুঝে উঠতে পারছে না। তার শিকড়গুলো অবশ হয়ে আসছে ধীরে ধীরে, টের পাচ্ছে। একটু কষ্ট হচ্ছে দাঁড়িয়ে থাকতে। তবু দাঁড়িয়ে তো তাকে থাকতে হবেই, এমনই একটা দৃঢ়তা ওর নিজের সিদ্ধান্তে। কোনোদিন নিজের দুর্বলতাকে সে কারোর কাছে প্রকাশ করেনি। নিজের ভিতর ধৈর্য ধরে সামলে নিয়েছে সব, একা। তাই তো জঙ্গলে তাকে এত ভরসা করে সবাই।
সূর্য ডুবে গেল। কিন্তু জঙ্গলে আজ কোনো কোলাহল নেই। কেউ ঘুমায়নি। সবাই চুপ করে অপেক্ষা করছে। বটের সাথে কত স্মৃতি মনে আসছে তাদের। তারা কান্না চাপছে, মাঝে মাঝে কিছু একটা মজার কথা ভেবে হেসে উঠছে। কিন্তু বাইরে কোনো শব্দ নেই। দেখতে দেখতে আকাশে তারা উঠে গেল সব কটাই। গরম কাল। হাওয়াটা বেশ ঠাণ্ডা। কোথাও বৃষ্টি হয়েছে হয়ত। দূরে যদিও বিদ্যুতের রেখা আকাশে দেখা যাচ্ছে। ওটা কে আসছে লণ্ঠন হাতে? এই সময়ে মানুষ?
একটা বাচ্চা মেয়ে এলো। তার লণ্ঠনের একটা দিকের কাঁচ কালো হয়ে পুড়ে গেছে। মেয়েটা এসে একটু হাঁপাতে হাঁপাতে লণ্ঠনটা তুলে কি যেন খুঁজল। তারপর বটের গুঁড়ির পাশে আলোটা কাছে এনে বসল। মেয়েটা একাই এসেছে। ওর মনের মধ্যে ও একা নয়। অনেক কথা নিয়ে এসেছে। ওর সৎ মা। ঠিক মত খেতে দেয় না। জামা দেয় না পুজোয়। ক্লাস সিক্সে পড়ে, পুরোনো বই নিয়েই পড়ে, খাতা চাইলে দেয় না। কিন্তু এসবের মধ্যেও ওর একটা আনন্দ আছে। ওর নিজের মা ওর কাছে রোজ আসে রাতে। ওর মা নয়না এই বটগাছের নীচেই সাপে কেটে মরেছিল। মেয়েটার নাম সুজানা। ওর বাবার নাম সুশান্ত। সেই সু দিয়ে নাম মেলানো হয়েছিল। ওর বাবা শহরে কাজ করে, অনেক দিন পর পর আসে। ওরা খুব যে গরীব তা বলা যায় না, আবার বড়লোক তো নয়ই। গ্রামে কেউই বড়লোক নেই।
সুজানা কাল যখন শুতে গেছে তখন নয়না এসে ওর পাশে শুলো, যেমন রোজ শোয়। এটা ওটা গল্প বলে। সুজানার মনের মধ্যেটা আরাম লাগতে শুরু করে। তার সৎ মা রেবাকেও তার ভালো লাগে তখন। মনে হয় হয়ত ও আসলে এমনি খারাপ নয়, আসলে ভালো, পরে ঠিক হয়ে যাবে সব। সুজানার সব চাইতে ভালো লাগে পাহাড়ের মাথায় বৃষ্টি হওয়ার গল্পটা। পাহাড়ের মাথায় নাকি মেঘেরা সব ঝোলা ভর্তি করে করে জল নিয়ে আসে। আর সে যে-সে সমুদ্রের জল নয়, সাত সমুদ্রের জল। পাহাড়ের উপরে নাকি দারুণ সুন্দর সুন্দর ফুলগাছ আছে, সেই ফুলে জল দিয়ে তারা চলে যায়। ফুলগুলো ফুটে এমন সুন্দর পাহাড়ের মাথাটা দেখায় যে নাকি যে যায় আর ফিরতে চায় না। সুজানা এই গল্পটা শুনতে শুনতে যে কতবার ঘুমিয়ে পড়েছে! স্বপ্ন দেখেছে সে সেই পাহাড়ের মধ্যে দিয়ে হাঁটছে, তার চারদিকে মেঘেরা তাকে দেখছে আর ফিসফিস করে বলছে, দ্যাখ দ্যাখ মেয়েটাকে কি সুন্দর দেখতে, যেন একটা পরীই বা হবে! এই বলে মেঘেরা তার পিছন পিছন আসছে। তারপর ফুল গাছে জল দিচ্ছে। এর মধ্যে তার মা-ও চলে এসেছে সেখানে। মা তাকে ফুলের বাগানে হাত ধরে ধরে নিয়ে ঘুরছে, চুমু খাচ্ছে, আদর করছে, আর ফুলগুলো চীৎকার করে বলছে, আমাকেও আমাকেও...ওর মা ওদেরকেও চুমু খাচ্ছে, আদর করছে।
সুজানা জানে কাল বটগাছটা মারা যাবে। নয়না বলেছে। সে তাই বটের কাছে এসেছে তাকেও যেন সে নিয়ে যায়। কারণ মারা যাওয়ার পরেই সে মায়ের কাছে রাতদিন থাকতে পারবে। কিন্তু ওর মাকে যতবার বলে, নয়না কাঁদে, বলে কি বাজে কথা বলছিস তুই! সুজানা গাছের গোড়ায় বসে সব কথা বটকে বলল। বট শুনল। তার পাশের হিজল, আম, পেয়ারা, সজনে ইত্যাদি সব গাছেরা শুনল। সবাই শুনে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, আরে ধুর, তাও হয় নাকি? কিন্তু মেয়েটা নাছোড়বান্দা। সে যতই ওদের না শোনে, ততই কেঁদে চলে। বট চুপ করে থাকে। কি বলবে সে মেয়েটাকে? এমন সময় তার মাথায় একটা বুদ্ধি খেলে গেল। সে সবাইকে বলল, ওসব কথা থাক। এসো আমরা একে একে প্রত্যেকের প্রিয় গানটা গাইব, আর সেই গানের প্রথম লাইনটা সবাই মিলে মিলে গাইব। বেশ? সবাই বটের কথায় এক সাথে বলে উঠল, হ্যাঁ হ্যাঁ, বেশ বেশ বেশ। আসলে তারা বটকে ভীষণ শ্রদ্ধা করত তো সবাই। তাই রাজী হয়ে গেল আর কি।
সবার শুরুতে গাইল আম গাছ। সুজানা ভাষা বুঝছে না, কিন্তু দারুণ লাগছে শুনতে তার। এই গানের ব্যাপারটা শুরুতে শুনে তার মনে হচ্ছিল তাকে এড়িয়ে যাচ্ছে ওরা, তারপর ভাবল কিন্তু এড়িয়ে যাবে কোথায়? সে তো এখানেই বসে থাকবে। এতক্ষণ আকাশটা পরিষ্কার ছিল। হঠাৎ কোত্থেকে কালো মেঘ চলে এলো। বট তার অবশ হয়ে যাওয়া শরীরটা দুলিয়েই ঝড় তুলে দিল। মেয়েটাকে আড়াল করে নিল একটা বড় ডালের ঘেরে। মেয়েটার লণ্ঠনটা গেছে নিভে। সে গুটিসুটি দিয়ে বটের কোলের আড়ালে শুয়ে গান শুনছে। এখন গাইছে একটা লতাগাছ। সবাই গলা মেলাচ্ছে। দেখতে দেখতে তার চোখ জুড়িয়ে এলো। সে দেখছে মেঘেরা জল ভরে ভরে ফুলগাছেদের কাছে এসেছে। ওই তো তার মা দাঁড়িয়ে। সে ছুট্টে গিয়ে তার মাকে গিয়ে জড়িয়ে ধরল। ফুলগাছগুলোও তার মায়ের কাছে আসতে চাইছে। মেঘেরা কোলে করে করে তাদের এনে দিচ্ছে। তার মায়ের গলায় একটা মস্ত হীরে, সেই হীরে দুলালেই বিদ্যুৎ চমকে উঠছে। তার মা হাত তালি দিলেই মেঘ ডেকে উঠছে। তার মা চুল ঝাড়া দিলেই বৃষ্টি হচ্ছে। আরে এতক্ষণ তো সে খেয়ালই করেনি, এই চুলের ভিতর থেকেই তো জন্মাচ্ছে মেঘ। সে তার মাকে বলল, তুমিই মেঘ বানাও? মা বলল, হ্যাঁ তো। তুমিই বৃষ্টি বানাও, বিদ্যুৎ আনো? মা বলল, হ্যাঁ তো। তবে ফুলেরা? তার মা বলল, তুমিই তো সেই ফুল। আর যত বাচ্চারা আছে তারাও। আর বড়রা? মা বলল, কেউ পাথর, কেউ দেওয়াল, মাটির ঢিবি, কেউ নদী এরকম। মেয়েটা মাকে জড়িয়ে কত্ত আদর করল। হঠাৎ মনে হল তার যেন গরম লাগছে পায়ে।
সকাল হয়ে গেছে। তার ঘুম ভাঙল। সূর্যের আলো তার পায়ে এসে পড়েছে। চারদিক লণ্ডভণ্ড। বটগাছটা মারা গেছে। সে উঠে দাঁড়াতে যাবে, এমন সময় দেখে তার পায়ের কাছে একটা ছোট্টো বটগাছের চারা। সুজানা ঝুঁকে গাছটার গায়ে হাত বোলালো। হাওয়া ফিসফিস করে তার কানে বলে গেল, এই গাছটা তোমার। একে বড় করলেই মেঘ হবে, ফুল হবে, বৃষ্টি হবে। সুজানা বলল, জানি, মা বলেছে আমায়।
(আমার গল্পটা এখানেই শেষ। আমাদের বাংলাভাষার চারাটা যে সব সুজানাদের হাতে তাদের দিকে তাকিয়ে আছি। আমাদের দুর্ভাগ্য দুই বাংলার দুটি ভিন্নদিনে নববর্ষ। সে যাই হোক, দুপক্ষকেই আমার আন্তরিক শুভেচ্ছা। যারা নানাভাবে আমাদের বাংলাভাষায় লেখালেখি, পড়তে উৎসাহ দেওয়া, বই হাতের কাছে এনে দেওয়া ইত্যাদির জন্য লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন তাদের এই অবসরে জানাই আন্তরিক কৃতজ্ঞতা। সবাই ভালো থাকুন। স্বভাষায়, স্বমতে, স্বভাবে – সবার সাথে থাকি আমরা, এই কামনা।)