যখন উত্তুঙ্গ কীর্তনে মাতোয়ারা সব, এই ছোট্টো ঘরটায়, নমিতার মনে হচ্ছিল তার হৃৎপিণ্ডটা বোধায় জল ভরা বেলুনের মত ফেটে যাবে।
নমিতা বিছানায় শুয়ে আজ আট বছরের উপর। পাশ ফিরতেই দম আটকে আসে, পিঠটা এত টাটায়। নমিতার স্বামী মারা গেছে দশ বছরের উপর হল। ছেলের সব্জীর দোকান বাজারে। আজ তার এই বাবার মৃত্যুর দিনে কীর্তন দেয় ছেলে। পাড়ার কত লোক আসে। ছেলের বউ, নাতি নাতনি সকাল থেকে ঘর পরিষ্কার করে। নমিতা শুয়ে শুয়ে দেখে। মন খুশী হয়। আবার দুঃখীও হয়। হবে না? কতদিন একভাবে শুয়ে!
খোলের আওয়াজে দেওয়াল কেঁপে কেঁপে উঠছে। এমন মাতোয়ারা ভাব যে টিউবলাইটের নীচে টিকটিকিগুলো অবধি তাকিয়ে, স্থির হয়ে। টিকটিকিই তো আসবে। এখন আর ময়ূর, হরিণ কোথা থেকে আসবে?
কৃষ্ণ আর রাধার ছবির পাশে মহাপ্রভু আর নিত্যানন্দের ছবি। মহাপ্রভুর দিকে তাকিয়ে নমিতা বলছে, তোমার বাড়ি আমি গেছি। এক ঘন্টার ট্রেনের রাস্তা। যেতে যেতে শসা খেয়েছি, বাদাম খেয়েছি। হোটেলে গিয়ে মোচার ঘন্ট, আলুভাজা, পাঁচমেশালি তরকারি দিয়ে সরু চালের ভাত খেয়েছি।
নমিতার চোখ জুড়িয়ে আসছে ঘুমে। ঘরে শাঁখ বাজছে, উলু দিচ্ছে সব। খোল বাজছে উত্তাল… নমিতার চোখ ঘুমে জড়িয়ে আসছে। সরু চালের ভাত, পাঁচমেশালি তরকারি, ডাল সামনে রাখা। মহাপ্রভু খেতে বসেছেন। নমিতা ভাত বেড়ে দিচ্ছে। মহাপ্রভু জিজ্ঞাসা করছেন, এত সরু চাল কোদ্দিয়ে পেলি রে নমিতা… আহা কি স্বাদ… কি সুবাস….
নমিতা তখন বড়ি ভাজছে। তার নিজের হাতে দেওয়া বড়ি। তার এক চিলতে ছাদে আসা এক ফালি রোদে শুকানো বড়ি। নমিতা বলছে ধীরে ধীরে খাও, আমি বড়ি ভাজা আনছি।
মহাপ্রভু বললেন, আবার এত কিছু কেন করতে গেলি রে… তোর বর, ছেলে…. ওদের দেখছি না যে….
তা কি করে দেখবে গো… সব কাজে গেছে। ও গেছে আজ ছাদ ঢালাই হবে সেখানে… কাজে… আর ছেলে গেছে সব্জী নিয়ে বাজারে… বউমা তো পুকুরঘাটে গো.. আর নাতিনাতনি তো স্কুলে….
মহাপ্রভুর ডান হাত পদ্মের মত। তার তর্জনীতে দুটো ভাত লেগে। ডালে মাখা হাত। মহাপ্রভু হেসে হেসে নমিতার বড়ি ভাজা দেখছেন।
নমিতা বলল, তুমি আজ থেকে যাবে গো…. রাতে তোমায় লুচি আর ছোলার ডাল খাওয়াব… সুজি বানাব কাজুবাদাম দিয়ে। মিত্তিরদের বাড়ি চাইলেই কাজুবাদাম দেবে। তুমি এসেছ শুনে ওরা ছুটতে ছুটতে দেখতে আসবে তোমায়। থাকবে গো… বলো না….
মহাপ্রভু হাসলেন। বললেন, ধুর পাগলী…. শুতে দিবি কোথায়….
নমিতা ভাজা বড়ি মহাপ্রভুর পাতে দিতে দিতে বলল, হ্যাঁ গো হবে… আজকে আমি আর ও না হয় ছাদে শোবো…
মহাপ্রভু হাসলেন… বললেন, দেখি…..
মা ওমা…. মা…..
নমিতা চোখ খুলে তাকালো। পরিমল ডাকছে। হাতে প্রসাদের থালা। ঘরে কেউ নেই। সবাই চলে গেছে। ঘরময় চন্দন আর ধূপের গন্ধ। এত ঘুম ঘুমিয়েছিল?
পরিমল উঠে বসালো। পিঠে বালিশ দিল। একটা লুচির টুকরো ছোলার ডালে ভিজিয়ে মুখে দিল নমিতার….
নমিতার গাল গড়িয়ে চোখের জল নামল।
পরিমল, বাঁ হাতের উল্টোদিক দিয়ে চোখটা মুছিয়ে বলল, কাঁদছ কেন মা….. বাবার জন্য….
নমিতা বলল, আমি কি আর কোনোদিন ছাদে উঠব না রে….
খাওয়া শেষে নমিতাকে কোলে করে ছাদে আনল পরিমল।
নমিতা দুই হাত জড়ো করে বলল, যেও না… যেও না ঠাকুর…..
ছাদে চাঁপা গাছের ডাল এসে পড়েছে, তাতে চাঁপা ফুটে আছে থরে থরে। চাঁপার উপর পড়েছে চাঁদের আলো। সারা ছাদ সে গন্ধে ভরে আছে।
পরিমল বলল, থাকবে আর কিছুক্ষণ?
নমিতা বলল, না রে, উনি বিশ্রাম নিন।