মন্দিরের দরজায় তালা লাগিয়ে, মঠের দরজায় তালা লাগিয়ে সাধু নিজের ঘরে গিয়ে বসলেন। একাই বসে। কোনো ভক্ত সমাগম নেই। খাঁ খাঁ করছে মন্দির প্রাঙ্গণ। কি এক রোগ এলো!
জপের মালা হাতে পদ্মাসনে বসলেন। চোখ বন্ধ করলেন। সার সার জ্বলন্ত চিতা। অসহায় মানুষের কান্না। ছটফটানি। ঈশ্বরের মুখটা কই? তাঁর চরণযুগলই বা কই? কিছুতেই কোনো মন নেই। চারদিকে শুধু হাহাকার আর কান্না। মানুষের কাছে যাওয়া যাবে না? না, যাওয়া যাবে না। অথচ বন্যায়, খরায়, ঝড়ে কত কত দুর্যোগে মানুষের কাছে গেছেন। চাঁদা তুলে খাবার, পোশাক, ওষুধ দিয়ে এসেছেন। এইবার?
চিকিৎসক, পুলিশ, দোকানি, গাড়ির চালক, এরকম কত কত মানুষের কথা মনে পড়ছে। তারা মানুষের কাছে। কত কাছে যাচ্ছে। তিনি কেন দরজা দিয়ে বসে? কেন? তবে এতদিনের সাধনা, বিশ্বাস সব কোথায়? যদি সেবার যোগ্যতাই না রইল, তবে আর বসে বসে মালা ফিরিয়ে লাভ কি? ঈশ্বর কি চান? আমার মালার আবর্তন? আমার মনের বারবার তাঁকে স্মরণ? আর আজ যারা রাস্তায় নিজের জীবন ঝুঁকি নিয়ে মানুষের পাশে, মানুষের সেবায়?
উঠে এলেন। গঙ্গার ধারে এসে বসলেন। কত কত যুগ ধরে এ নদী বয়ে চলেছে। কত মহামারীর সাক্ষী এ। এমন যুগে যুগে মানুষ মারা গেছে। মৃতদেহের স্তূপ হয়েছে। আবার সব ভেসে গেছে সময়ের সঙ্গে। মানুষ সব ভুলে গেছে। এদিনও চলে যাবে। আবার সব ভুলে যাবে মানুষ। মানুষ তো আত্মা। মৃত্যুর পারে সে। সে আত্মা অমর। আত্মার জন্ম মরণ হয় না। আত্মা চির অবিনাশী।
মনটা হালকা হল। মাথার উপরে চাঁদ উঠেছে। আজ পূর্ণিমা। যুগ যুগ ধরে এ চাঁদ এমনিই উঠে আসছে। হাজার বছর পরেও উঠবে। এ মহামারীর স্পর্শ সেখানেও নেই।
হাতে জপের মালা ঘুরতে শুরু করল। মন সমস্ত কিছু থেকে উঠে যাচ্ছে। মন অনন্তে এখন। কি আনন্দ! কি আরাম! কি সুখ!
হঠাৎ মনে হল কেউ একজন পিছনে এসে দাঁড়ালো। মালা থামিয়ে পিছনে ফিরে তাকালেন। ফোন হাতে দাঁড়িয়ে তার সেবক। ধীরে ধীরে বলল, অনন্তর মা।
সন্ন্যাসী ফোনটা নিলেন। ওপাশ থেকে কালবৈশাখী ঝড়ের মত কান্নার আর্তনাদ ভেসে এলো..... "আমার ছেলেটা চলে গেল মহারাজ.... সব শেষ হয়ে গেল.... না একটু অক্সিজেন... না একটা বেড পেল...."
সন্ন্যাসীর হাত থেকে মালা গড়িয়ে পড়ে ঘাসে। চাঁদ, অনন্ত, আত্মা সব ডুবে যাচ্ছে, মিলিয়ে যাচ্ছে দূরের কোন আলোয়... গাল গড়িয়ে জল নামছে.... ছেলেটা কলেজে পড়ত.... তার কাছে খুব যাতায়াত ছিল... খুব স্নেহ ছিল ওর উপর..
অনেক রাত। প্রাঙ্গণের বন্ধ দরজার কাছে দাঁড়ালেন। লোহার গারদের ওপারে যে জীবন আর এপারে যে জীবন.. কোনটা বেশি সত্য? উত্তর পাচ্ছেন না। মন অনন্তের দিকে ডানা মেলুক, এই আশায় আবার ফিরলেন নিজের ঘরের দিকে। সব কান্না ভুলে না গেলে ওদিকে যাওয়া যায় না। মানুষের জীবন মানেই কান্না। মনকে মায়ার ঊর্ধ্বে না নিয়ে গেলে রাস্তা কোথায়?
মন কঠিন হচ্ছে। ধাতুর মত কঠিন। নদীর ধারে এসে দাঁড়ালেন। মালাটা খুঁজছেন। মালা পেলেন। সমস্ত মনকে তন্ময় করে ফেলতে হবে। ডুবিয়ে দিতে হবে। আপাতত কোনো ফোন নেবেন না। মন এত চঞ্চল হতে নেই। একদিন এ রোগ সারবে। অনেক বলিদানের পর সব থামবে। একদিন দরজা খুলবে আবার। আবার আসবে ভক্তের দল। চোখ মেলে তাকালেন। চারদিক অন্ধকার। চাঁদ ঢেকেছে মেঘে। কে সত্য বেশি চাঁদ না মেঘ?