গতকাল মধ্যরাত থেকে যে শুভেচ্ছা আর ভালোবাসার স্রোতে ভেসে চলেছি, তার জন্য নিজে কতটা যোগ্য সত্যিই জানি না। নীরেন্দ্রনাথ মহাশয় একবার বলেছিলেন, জীবনে এমন অনেক অপমান দুঃখ পেয়েছি যা হয়ত কাম্য ছিল না, কিন্তু অন্যদিকে এমন অনেক সুখ, ভালোবাসা পেয়েছি, তারও আমি যোগ্য ছিলাম কই, তাই হরদরে হিসাবটা মিলেই যায়।
এই হরেদরে হিসাবটা আজীবন মিলেই এসেছে। এক সময় যখন মনে হয়েছে মানুষ স্বার্থপর, মানুষ আত্মসুখী, মানুষ কপট- তখন দেখেছি, যে 'মানুষ' শব্দটা উচ্চারণ করছি, তার মধ্যে আমিও পড়ি। তার বিপরীতে মানুষের মধ্যে আরেকটা মানুষ আছে, যে মানুষ অজেয়। কোনো চালাকি, কোনো অপযুক্তি, কোনো শঠতায় যে মানুষকে জিতে নেওয়া যায় না, সে মানুষের বাসও আমার এই ক্ষুদ্র স্বার্থপরতাপূর্ণ ভীরু হৃদয়েই - "এই দুয়ার দেওয়া ঘরে কভু আঁধার নাহি সরে, তবু আছ তারি পরে ও মোর দরদিয়া"। সেই দরদিয়ার বাস প্রতিটা হৃদয়েই। তাকে দেখেছি, কোথাও অস্ফুট, কোথাও অর্ধ জাগরিত, কোথাও পূর্ণ। কিন্তু সেই দরদিয়ার বাস শূন্য হৃদয় আমার একটাও চোখে পড়ল না আজ অবধি। অত্যন্ত ক্রুর, স্বার্থপর মানুষও নিজের নাতির কাছে, কিম্বা সন্তানের কাছে কেমন অসহায়ের মত সেই দরদিয়ার ভিক্ষার ঝুলি হাতে করে দাঁড়ায় দেখেছি। আমার মনটা করুণায় দ্রবীভূত হয়ে তৎক্ষণাৎ তার উপর বিদ্বেষভাব ছেড়েছে। যে চোখের উপর খানিক আগেই ধূর্ততার আভাস দেখেছি, সেই চোখেই কি মায়া, কি কোমলতা দেখেছি পরক্ষণেই। আশ্চর্য হয়ে বলেছি, সংসারে সবটুকু মাধুর্যের ভাণ্ডার আমারই জন্য খোলা থাকবে তা তো নয়, কিছু বিষ আমাকেও তো হজম করতেই হবে, বাকি যেটুকু অমৃত পাই নেব চেটেপুটে। তাই সেই ধূর্ত মানুষের ধূর্ততার শিকার না হয় আমি হলাম, কিন্তু তার স্নেহের ধারায় কেউ না কেউ তো স্নান করছেই, তবে কে বলেছে সে মানুষটা শুধুই শঠ! না হয় আমার ভাগ্যে বিষটুকুই পড়ল, কিন্তু যে মাধুর্য তার চোখেমুখে অন্য কোনো ব্যক্তির প্রতি দেখলুম, সে আমার জন্য নয় বলেই কি তাকে অস্বীকার করতে হবে? না না, সে নিতান্তই স্বার্থপর, ক্ষুদ্র দৃষ্টি।
কাল থেকে এত পেয়েছি, পেয়ে চলেছি যে আমার দুহাত উপচে পড়ছে, এ কি কম কথা! আমি তো সভাগৃহের কবি নই, আমার কোনো বই নেই, তকমা নেই। কিন্তু তবু যখন কেউ বলেন আপনার অতদিন আগের কোনো লেখা আমার চোখে জল এনেছে, আমায় ভরসা জুগিয়েছে, আমায় আনন্দ দিয়েছে - আমি অভিভূত হয়েছি। আমি ফুটপাথের কবি, আমার লেখা প্রতিদিনের তুচ্ছ, ফেলে যাওয়া ঘটনাগুলো আস্তাকুঁড় থেকে তুলে আনা অতি সামান্য বস্তু। তাও কেউ মনে রাখে, তাও কেউ উল্লেখ করে এও কি কম! গুণীজনের কদরে নাও আসি ক্ষতি নেই, মানুষের সেই দরদিয়ার দরবারে কাঙালেরও আমন্ত্রণ, সেইটুকু কিছুতেই ছাড়া যায় না, তবে বাঁচি কি নিয়ে!
মান, অভিমান, আকাঙ্ক্ষা - এরা তো রইলই। অনেক মানুষের উপেক্ষা মাথায় করে নিয়েছি, যার কাছ থেকে হয়ত কিছুটা দাবিই রেখেছিলাম, আবদারের মত করে, কষ্ট পেয়েছি, কিন্তু পরক্ষণেই দেখেছি, তিনি আমার উপর যে পরিমাণ উদাসীন, আরেকজনের উপর সেই রকম নয়, তখনই মনে সান্ত্বনা এসেছে, কেউ তো পেয়েছে, মানুষটা যে এক্কেবারে উদাসীন তা তো নয়। বীণায় সুর উঠলেই হল, আমায় দেখেই যে সে সুর উঠতে হবে তার কি মানে আছে? সুর তো উঠেছে! তাতেই শান্তি।
যাঁকে জীবনের প্রত্যুষে প্রণাম জানিয়ে যাত্রা শুরু করেছিলাম, তিনি আজও হাত ছেড়ে যায়নি, আমার শান্তিনিকেতন গড়ে দিয়েছেন বোলপুরে না, এই হালিশহরেই, তাঁকেই দিনান্তের শেষ প্রণাম জানাই তাঁরই কথায়, যা মন্ত্র, যা সঞ্জীবনী -
চাহিয়া দেখো রসের স্রোতে রঙের খেলাখানি।
চেয়ো না চেয়ো না তারে নিকটে নিতে টানি॥
রাখিতে চাহ, বাঁধিতে চাহ যাঁরে,
আঁধারে তাহা মিলায় মিলায় বারে বারে--
বাজিল যাহা প্রাণের বীণা-তারে
সে তো কেবলই গান কেবলই বাণী॥
পরশ তার নাহি রে মেলে, নাহি রে পরিমাণ--
দেবসভায় যে সুধা করে পান।
নদীর স্রোতে, ফুলের বনে বনে,
মাধুরী-মাখা হাসিতে আঁখিকোণে,
সে সুধাটুকু পিয়ো আপন-মনে--
মুক্তরূপে নিয়ো তাহারে জানি॥