Skip to main content
chaya

নুন-চিনি-জল খেয়ে চেয়ারে বসেই বুঝলেন, আবার যাওয়া লাগবে। 

     গেলেন। এলেন। ক্লান্ত। ডাক্তার বলেছে, এরকম হবে। কোভিডের নতুন লক্ষণ। আগে পেটে এরকম হলে একটা অনুশোচনা থাকত, আহা, ওটা বেশি খাওয়া হল, কি সেটা খাওয়া উচিত হয়নি। কিন্তু এতো আশ্চর্য কাণ্ড! কোথা থেকে কি হল! 

     কেউ আসবে না। রান্নার লোক না। ঘরদোর ঝাঁট দেওয়া, বাসন মাজার লোক না। একা মানুষ। কিন্তু এমন একা করে দেওয়া রোগ তো ভালো নয়। কতক্ষণ গান শুনে, বই পড়ে, টিভি দেখে কাটানো যায়! ফোনে বেশি কথা বলতেও ভালো লাগে না, আর কথা বলার লোকও বেশি নেই। প্রান্তিক চ্যাটুজ্জে সংসারে এসেছে একা। যাবেও একা। থাক, এই ভর সন্ধ্যেবেলা যাওয়ার কথা না হয় না-ই ভাবা গেল। ঝুলবারান্দায় বসে সূর্যাস্ত দেখতে দেখতে হঠাৎ রঙ-তুলির কথা মনে এলো। এই কর্পোরেট জগত সব খেয়েছে। আর রং তুলি! 

     হাই তুলে, গা ছেড়ে ভালো করে বসলেন। মানে আধশোয়া হলেন। মরতে ভয় কেন? বাষট্টি তো হল। বাবা পঞ্চান্নতে, মা সত্তরে, কাকা ষাটে, ঠাকুর্দা তো চল্লিশেই। তবে ভয় কেন? কাকেই বা রেখে যাচ্ছেন। কেউ নেই। এতবড় সংসারে, এই সূর্যাস্ত হচ্ছে, এই যে একটু পর অন্ধকার নামবে, এই যে তিনি এ সবের সাক্ষী থাকবেন… এসবের নিটফল কি? 

     আবার মোচড়। এই মোচড়ের সঙ্গে দার্শনিক চিন্তার একটা যোগ আছে কোথাও। 

     গেলেন। বসলেন। সামনে গীজারের উপর একটা টিকটিকি। হাসি পেল! তুই শালা বেঁচে গেলি। আমার কাশিতে তোরে কোভিডে ধরবে না। আচ্ছা টিকটিকির জ্বর হয়? গুগুল করতে হবে। ফোনটা বাইরে ঝুল বারান্দায়। ফোন সঙ্গে না থাকলে মনে হয় একটা অঙ্গহানি হয়েছে। কিন্তু এই অবস্থায় বেরোনো ঠিক না। কিছু হয়নি যদিও, তবু সংস্কার। মানতে হয়। না চাইলেও। অভ্যাস। 

     সর্বনাশ! রিং হচ্ছে। 'জগতে আনন্দযজ্ঞে', ইনস্ট্রুমেন্টাল। কেন এই টোনটা? জগতে আনন্দযজ্ঞ বলতে নাইটক্লাব। নারীসঙ্গ। ভ্রমণ। উন্নত মানের গরল। যা স্নায়ুকে বায়বীয় করে। জীবনকে মসৃণ। সব ব্রহ্মময়। 

     রিং বন্ধ হল। কিছু হল না। কিন্তু মোচড়টা যাচ্ছে না। বেরোতে ইচ্ছা করছে না। টিকটিকিটা আড়ালে চলে গেছে গীজারের। লজ্জা, না আত্মরক্ষা? 

     বাইরে এসে বসবেন। তার আগে একবার অক্সিজেন মাপলেন। ৯৭। ঠিক আছে। জ্বর নেই। প্রেশার দুপুরে দেখেছেন ১৫০/ ৯০। চলবে। 

     অন্ধকার নেমে গেছে। আকাশে নিশ্চয়ই তারাও উঠেছে। স্ট্রীটলাইটের স্পর্ধায় তা দেখার অবকাশ নেই। ক্ষুদ্র আলোর স্পর্ধা কি সাংঘাতিক! 

     ঘুম পাচ্ছে। ক্লান্তির ঘুম। 

======

     ফোন বাজল। 

     "দাদা আপনার অর্ডারটা", দরজায় খাবার নিয়ে দাঁড়িয়ে, গৃহিণী নয়, জোম্যাটো। 

     ছেলেটার হাসিমুখ হবে নিশ্চয়, না কি বিরক্তির? মাস্কে ঢাকা মুখ। জীবন মাস্কে ঢেকে গেছে। মাস্কের তলায় বে-আব্রু আবেগ। ছেলেটা ভ্যাংচাতেও পারে। যা খুশি করুক। 
টেবিলে খাবার। ঘড়িতে ন'টা পঁচিশ। অক্সিজেন ৯৮। প্রেশার ১৩৫ / ৯০। 

     খাওয়া হল। বিরিয়ানি। জিভ আর উপস্থ নিয়ে সংসার। সুখের স্বর্গ। মৃত্যু তুমি বড় নিষ্ঠুর। দারিদ্র্য তুমি বড় বেরহম। আমার দিকে তাকিও না। আমি সুখী। আমার মৃত্যু নেই। আমার জন্ম আছে। আমার সুখ আছে। আমার আমি আছি। আমার ঈশ্বর আমায় ছেড়ে গেছেন। আমি অধার্মিক। আমি ভোগী। আমি স্বার্থপর। আহা! এই তো জীবন। এই তো সত্য। এই সব! 

     খাওয়ার সময় জিভ বেয়ে রসের ধারা। সঙ্গে মনে কি আত্মবিশ্বাস! খাওয়ায় যত সুখ, মনে তত আত্মবিশ্বাস। চাইলে সব পাওয়া যায়। শুধু চাইতে হয়। চাইতে জানতে হয়। 

     রাত দুটো। ঘুম আসছে না। এও নাকি কোভিডের লক্ষ্মণ। হোক। রোগ থাকুক, মৃত্যু না থাকুক। সারা ঘর আবছা আলো। এসি চব্বিশে। দেওয়ালে বুদ্ধের মুখ। সামনে নিজের ছবি। লণ্ডনে তোলা। আরো অনেক ছবি। সাফল্যের স্কেল। শেষ হয়নি। আরো চড়া যেত। কিন্তু ভয়। পড়ে যাওয়ার ভয়। পিছলে নেমে আসার ভয়। কে? 
বসার ঘরে শব্দ। কার শব্দ? কে ওখানে? কে? 

     বাথরুমের আলো জ্বালা। খাবার টেবিলে মুখ গুঁজে শুয়ে কে? তার শরীর। হৃৎপিণ্ড থেমে। নিথর। ঘরে ঢুকে পড়েছে এক দোয়েল। তার কালো রঙের গা টিউবের আলোয় চকচক করছে। 

     ম্যাসিভ অ্যাটাক। এও হয়। কারোর কারোর হয়। ধমনীর মধ্যে পুঞ্জীভূত সুখ। দীর্ঘদিন ধরে। রক্ত চলাচল বন্ধ। সাময়িক আগে হয়েছে। এবার পুরো থেমে গেল। 

     যাব? না। কেন যাব? এ সবে আমার সুখ। আমার সব। আমি যাব না। আমি কোথাও যাব না। এ ঘরবাড়ি নিলাম হয় হোক। আমি যাব না। আমি সুখ। আমি সাফল্য। আমি সব। আমার আগে, পিছে কেউ নেই। আমায় আমি ছেড়ে এভাবে চলে যেতে পারি? না তো। 

     ভোর হল। আমি ঝুলবারান্দায় বসে। আমার দিকে তাকিয়ে আছি। আমি মুখ থুবড়ে বিরিয়ানিতে পড়ে। আমার নাকের কাছে মাছি। নাকের মধ্যে ভাত ঢুকে। সুগন্ধ পাও? তুমি না খাদ্যরসিক! পাও? 

     সূর্য উঠছে। এ দিন আমার নয়। এ জগত আমার নয়। আমার কান্না পাচ্ছে। সব এভাবে শেষ হয়? ওই তো ভিখারিটা চায়ের দোকানের সামনে বসে। ওই তো একটা বিস্কুটের আশায় বসে লাল ঘেয়ো কুকুরটা। আমারই বাড়ির ছায়া পড়েছে ওদের গায়ে। যে বাড়ি আমার গর্ব, আমার সাফল্যের চূড়া! সব ভাঙবে! সব? 
ধুলোঝড় উঠছে। সূর্য ঢেকে যাচ্ছে। আমি একা! আমার একাকীত্বকেও আমি আর অনুভব করতে পারছি না কেন? সব ধুলো হয়ে যাচ্ছে। সব সব সব। আমিও ধুলোয় মিশে লক্ষ লক্ষ অণু-পরমাণু হয়ে যাচ্ছি। ধুলো… ধুলো… ধুলো চারদিক…. এইভাবে শেষ হয় সব! নাকি শুরু হয়? কে বলবে?

 

(ছবি Suman)