নিজের পিসতুতো দাদা, কাকা, মামার ছেলের অনাকাঙ্ক্ষিত স্পর্শ পেয়ে বড় হতে হতে মৌ ঠিক করেছিল, মেয়েকে নাচ-গান কিচ্ছু শেখাবে না, ক্যারাটে শেখাবে। কিন্তু সেই মেয়ে যখন যৌবনে পা দিতে না দিতে এক “নাচিয়ে” ছেলের সঙ্গে পালালো, মৌ তার সবটুকু যুক্তি-বুদ্ধির “আমি” ত্যাগ করে ভক্ত হল।
একদিন সন্ধ্যেবেলা, হিমালয়ের কোনো এক জায়গায় বসে থাকতে থাকতে দেখল, পাহাড়ের মাথার উপর বাঁকা চাঁদ উঠেছে। মৌ চোখ বন্ধ করে কল্পনা করল, সেই বাঁকা চাঁদ মাথায় করে ধ্যানমগ্ন হিমালয়, যার মাথা থেকে নামছে গঙ্গা। ওই তো গঙ্গোত্রী বয়ে চলেছে। “হর হর” বলতে বলতে। জপতে জপতে। ওই তো মহাদেব। তার চন্দ্রমৌলি।
মৌ মেয়ের মুখটা মনে করতে চায় না বলে রাতদিন নিজের মনের উপর ইরেজার দিয়ে অবাধ্য দাগ মোছার মত মুছেই যায়, মুছেই যায়। দাগ ওঠে না। শুধু ক্ষতবিক্ষত হয়।
=======
মামার ছেলে মারা গেল হঠাৎ। মৌ গিয়েছিল। মামা চুপ করে চেয়ারে বসে। মুখ ভর্তি সাদা দাড়ি। চোখের তলায় কালি। খুব নাকি ভুগেছে ছেলেটা। বৌদি দাদার পা ছুঁয়ে বসে। মৌ একটু দূরে বসে। বৌদির দিকে তাকিয়ে। কান্না আসছে না। কান্নার থেকে বেশি কিছু আসছে। দমবন্ধ অস্বস্তি।
মানুষ হাড়ের উপর যেটা বয়ে নিয়ে বেড়ায় সেটা মাংস। বুকের মধ্যে যেটা লালন করে, সেটা শরীর। দাদা বুকের ভিতর ফুটো করে দিয়েছিল। বিশ্বাস, আস্থা ধরে রাখতে পারেনি এতবড় জীবনটায়। এমনকি বিয়ের পর স্বামীর সঙ্গেও সম্পর্ক সহজ হয়নি কোনোদিন। পরেশ বুঝতে পারত না। মৌ বুঝতে দিত না। তবু পরেশ কি সত্যিই বুঝত না?
======
দাদার কাজের দিন বৈশাখী, মানে তার মেয়ে যখন মামাবাড়ি ঢুকল, মৌ কোলের বাচ্চাটার দিকে তাকিয়েছিল এক ঝলক। কথা বলার প্রশ্নই আসছে না। বাচ্চাটার নাকটা পরেশের মত। একটা দুর্বলতা ভালোলাগার মত মৌকে অবশ করার আগেই মৌ বাড়ির বাইরে এসে দাঁড়ালো। বাড়ি ফিরবে? না যাবে কোথাও? বাড়িই ফিরে এসেছিল।
বাড়ি ফিরে এসে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজের চোখ, নাক, ঠোঁট, গলা, বুক, পেট… আর নীচে দেখা যায় না। কী করল এ জীবন নিয়ে, এ শরীর নিয়ে, এ হৃদয় নিয়ে?
=======
অঘটন আর জীবন সমার্থক। ব্যাখ্যা নেই। অনুভব আছে। অভিজ্ঞতা আছে। মৌ বাসে জানলার ধারে বসে আছে। নাতিকে আনতে যাচ্ছে। মেয়ে জামাইকে নিয়েছে করোনা। পুলিশের বিশেষ অনুমতিপত্র নিয়ে যাচ্ছে। ওদের ছেলেকে আনতে। ওর বাবার তরফে নেই তেমন কেউ।
বাসে হাতে গোনা চারটে কি পাঁচটা মানুষ। মুখ দেখা যায় না। মাস্ক পরা। এত মানুষ চলে যাচ্ছে রোজ। মৌ চোখদুটো বন্ধ করে বসে। বাইরে চড়া রোদ। ধুলো লাগছে নাকে, মুখে।
খবরটা দিল থানা থেকে। মৌ রাতের খাবার, রুটি আর ডাল নিয়ে বসেছিল। ডালটা সকালের ছিল। অল্প গন্ধ বেরিয়ে গিয়েছিল। টক টক স্বাদ। খাওয়া যাবে কি? এটা ভাবতে ভাবতেই ফোন এলো। সব এলোমেলো হয়ে গেল। কান্না পেল না। দীর্ঘশ্বাস পড়ল না। শুধু মনে হল মেয়েটার উপর অবিচার করল কি? মানুষ নিজেকে নিয়ে ছাড়া সত্যিই কি অন্যকে নিয়ে ভাবে? নাকি সবটাই মনের ছল?
======
নাতি চেনে না তাকে। দুজনে বাসস্ট্যাণ্ডে বসে। ছেলেটার বয়েস পাঁচ। তাকে ঘেঁষে বসে আছে। মৌ কোনো কথা বলছে না। তবে অনেকদিন পর মনে হচ্ছে হাত,পা, পেটের মধ্যে একটা মানুষ হাড়গোড় নিয়ে বেঁচে আছে। ছিল এতদিন, সে খেয়াল করেনি।
হোটেল সব বন্ধ। বাড়িতে করা কিছু শুকনো খাবার এনেছিল। ছেলেটা খাচ্ছে। ঠোঁটের কোণে লেগে। ইচ্ছা করছে মুছে দিতে। বুকটা টাটাচ্ছে। কিন্তু হাতটা এগোচ্ছে না। হাতের আঙুলের মধ্যে দিয়ে অল্প অল্প স্নেহ গড়িয়ে আসছে। আসুক। সময় তো আছে। অপেক্ষা করলে ক্ষতি কী?
ফেরার বাসে। রাত হয়েছে। বাস যেন আত্মীয়। দরদী। বুকে আগলে নিয়ে যাচ্ছে। চাঁদ উঠেছে। পূর্ণিমার চাঁদ। ধুলো উড়ছে। ছেলেটা তার শরীরে মাথা দিয়ে ঘুমাচ্ছে। মৌ চোখটা বন্ধ করল। সারাটা শরীর জুড়ে স্নেহ গড়াচ্ছে। বুকের মধ্যে জাল পাতছে সুখ। আবার শিকার হবে মৌ। মৌ চন্দ্রমৌলির ভস্মমাখা হাতটা বুকে রাখল মনে মনে। সব ছাই হয়ে যাক। ছাই হয়ে যাওয়ার সুখটা থেকে বঞ্চিত কোরো না নাথ। স্বামী। অনেকদিন পর আজ আবার ছাই হতে সাধ।