তুই ভাতটা করে নিতে পারবি? আমি এসে তরকারি করে নেব….পারবি?
অনিমা জানে উত্তরটা, তবু চুলটা ছাড়াতে ছাড়াতে তাকালো একবার ঘাড় ঘুরিয়ে।
পিনাকি উপুড় হয়ে শুয়ে। আধজাগা। একবার ‘'হুঁ” বলে আবার মুখটা কোলবালিশে গুঁজে শুয়ে পড়েছে।
অনিমা চটিটা পায়ে গলিয়ে, “আসছি” বলে দরজাটা ভেজিয়ে বেরিয়ে গেল।
ঘরে শব্দ বলতে ঘড়ির টিক টিক।
পিনাকি মাথাটা উঁচু করে ঘড়িটা দেখল। একহাতে জানলার একটা পাল্লায় ধাক্কা দিল। জানলাটা খুলতেই বাগানের সবুজ আলোয় ঘরটা ভরে গেল।
পিনাকির বাগান দেখতে ভালো লাগে। এরকম বৃষ্টিভেজা বাগান তো আরো ভালো লাগে।
পিনাকি উঠে ব্রাশে মাজন লাগিয়ে বাগানে এলো। তাদের একতলা বাড়ি। দুটো শোয়ার ঘর। একটা রান্নাঘর, বারান্দা। ছাদে ওঠার সিঁড়ি নেই। দরকার হলে মই লাগিয়ে উঠতে হয়। বাড়িটা বড় না। কিন্তু বাগানটা বড়। তিনটে আমগাছ, একটা পেয়ারা, একটা জামগাছ। আর ফুলগাছ যে কত!
পিনাকির কলেজ শেষ। অনিমা একটা ডায়গোনেস্টিক সেন্টারে কাজ করে। অনিমার ডিভোর্স হয়েছে আট বছর হল।
======
পিনাকি ব্রাশ করে চা বসালো। দু কাপ। একটু পরেই সার্থকদা আসবে। সার্থক মিত্র। জিম ট্রেনার।
সার্থক এলো। যথারীতি হাতে আজকের একটা ইংলিশ দৈনিক। ঘরে এসেই টয়লেটে গেল। পিনাকি ফ্লাশের আওয়াজ পেলো। সার্থক টাওয়েলে হাতটা মুছতে মুছতে বলল, আজ তোর আর কাকিমার কলকাতায় যাওয়া আছে না?
পিনাকি বলল, হ্যাঁ, দুপুরের ট্রেনে। মায়ের কয়েকটা কাজ আছে মিটিয়েই চলে আসবে। আমায় ভাতটা করে রাখতে বলেছে।
সার্থকের সামনে চায়ের দুটো কাপ রাখল পিনাকি।
সার্থক এক ঝলক পিনাকির দিকে তাকিয়ে বলল, মুড অফ?
পিনাকি চায়ে চুমুক দিয়ে বলল, চিনিটা বেশি হয়েছে বোধায়….দেখো তো….
সার্থক একটা চুমুক দিয়ে, ডান হাতে কাগজটায় একটা ঝাড়া দিয়ে বলল, তেমন লাগলে তুই যেতিস না….কাকিমাকে বলে দিতিস….
পিনাকি মাথাটা নীচু করে কাপের পরিধি ঘিরে ডান হাতের তর্জনীটা ঘোরাতে ঘোরাতে বলল, সেই…….
সার্থক কিছু বলল না।
======
পিনাকি ভাতটা প্রেসার কুকারেই করে। ভাতটা করে স্নানে গেল। যাওয়ার আগে মাকে ফোন করে জিজ্ঞাসা করল, তোমার কী দেরি হবে, আমি তবে স্নানে ঢুকলাম। আজ মাসি আসবে না। আমার বাসনমাজা, ঘর ঝাঁট দেওয়া কমপ্লিট।…
অনিমার দেরি হবে। পিনাকি বাথরুমে ঢুকে শর্টপ্যান্টটা খুলে একপাশে ফেলে রাখল। চুপ করে দাঁড়িয়ে বাথরুমের জানলার বাইরে তাকিয়ে থাকল। মেঘ করছে আবার। আজ সকাল থেকে উঠে একটা হিন্দি গানের সুর মাথায় খেলছে। কিন্তু মাঝের কথাগুলো মনে পড়ছে। শুরুর কথাগুলো যে কী……
পিনাকি শাওয়ারের তলায় দাঁড়িয়ে চাবিটা ঘোরালো ধীরে ধীরে। প্রথম জলের শিরশিরানিটা অদ্ভুত লাগে। পিনাকি নিজেকে দেখছে, নিজের থেকে সরে গিয়ে।
একটা ছিপছিপে শরীরের চামড়ার উপর দিয়ে জলের স্রোত নামছে। তার চামড়ার রং সাদা। নিজেকে কী মনে হচ্ছে তার, একটা গাছ, না পাহাড়। না বাড়ির ছাদ? যে ছাদে ওঠা যায় না! এত কুয়াশা তার মাথায়! কেন?
=========
দমদমে মাসিদের এই ফ্ল্যাটে আগেও এসেছে। শহুরেবাসীদের বড় স্বার্থপর মনে হয় পিনাকির। যেন কিছু সুযোগ সুবিধার জন্য গাছপালাঘেরা দুনিয়া ছেড়ে এই ঘিঞ্জির মধ্যে বাস করছে এরা সব। কী হয় গোটা পৃথিবীটা গ্রামের মত নরম হলে। গ্রামের মত সবুজ হলে। এরা যেন সবাই রাতদিন রেসের মাঠে দাঁড়িয়ে আছে। দৌড়াচ্ছে তো দৌড়াচ্ছেই, কিন্তু শেষটা দেখতে পাচ্ছে না, তাই একে অন্যকে টপকে যাওয়াকেই জীবনের মূলমন্ত্র করে নিয়েছে। কী অসহ্য!
“পিনাকি এখন তুমি কী করছ?”
এর একটা বাঁধাধরা উত্তর আছে। পিনাকি সেটা ঘুমের অতল থেকেও দিতে পারে। এখনও দিয়ে যাচ্ছে। প্রশ্নকর্তার জানার আগ্রহ নেই জেনেও, তাকে বিব্রত করতে না পারার বিমর্ষতা ঢাকার চেষ্টাতাতেও তার নিজের আর কোনো উত্তেজনা নেই জেনেও।
মা তার উপর নজর রাখছে। মাকে অনেকে নিশ্চয়ই প্রশ্ন করছে, “ও কী নাচ শেখে রে? ওর চালচলনটা একটু মেয়েদের মত না? ওকে একটু শাসন করতে পারিস তো… আসলে বাবা ছাড়া বড় হয়েছে তো….বাড়িতে মেয়েদের সঙ্গে থাকতে থাকতে…..এটা হয়…..বাড়িতে একজন কড়াধাতের পুরুষ থাকলে এটা হয় না….আমি দেখেছি…..”
পিনাকি একটা কোল্ডড্রিংক্স নিয়ে বালকনিতে এসে দাঁড়িয়ে আছে। ঘরে শ্যামাসংগীত চলছে। পান্নালালের। মাসিদের বাড়িতে এটা বার্ষিক কালীপুজো। মায়ের আসা চাই-ই।
পিনাকি নিজেকে প্রশ্ন করেছে অনেকবার, সেকি ঈশ্বরে বিশ্বাস করে? উত্তর আসেনি। প্রশ্নটাই অবান্তর লেগেছে। উত্তর তো জানা।
সার্থকদার মেসেজ এলো, ঠিক আছিস?
পিনাকি লিখল, ঠিক আছি।
=======
সারাদিন পিনাকি একাই কাটালো। যদিও অনেকে গল্প করতে এসেছে। কৌতুহলে, ঠাট্টায় তাকে কোনো দলের মধ্যমণি করতে চেয়েছে। এগুলো অনেক প্রাচীন খেলা। কী করে কাটিয়ে আসতে হয় জানে পিনাকি। কত অশোভন ইঙ্গিত এমন এমন সব মানুষদের কাছ থেকে পেয়েছে যাদের বাইরে থেকে বোঝার উপায়ই নেই, তার ভিতরে এমন একটা বিকার আছে।
পিনাকি সমাজের অনেক স্তরের মানুষের মধ্যে গেছে। তার সোশ্যাল সায়েন্স ছিল অনার্স। অনেক ভালো ভালো প্রজেক্ট করেছে। নিজের তাগিদেই। সমাজের স্তর বদলালে আকার, ইঙ্গিত, চালচলন বদলায় শুধু। কিন্তু ভিতরের কাঁচা মাটিটা একই থাকে। ভাষার আবরণ, ম্যানার্সের আবরণ, চালের আবরণের আড়ালে সেই এক ভালোমন্দে মেশানো এক মানুষ। রাতদিন নিজেকে মিথ্যা বলা মানুষ। রাতদিন নিজের বায়াসনেসের কম্ফোর্টজনে বাঁচা মানুষ। এর বাইরে কী আছে? কিস্যু নেই। মিনিবাসের ফাঁকা শেষ সিটের মত আড়ালে ঘেরা আদিম মানুষ। ভীতু মানুষ।
======
নীল টিশার্ট আর জিন্স পরে আছে পিনাকি। টিশার্টটা ভ্যাপসা গরমে ঘেমে গায়ে চিপকে যাচ্ছে। শিয়ালদায় প্রচণ্ড ভিড়। ট্রেনের কিছু গোলমাল আছে নাকি। আজ নাও যেতে পারে ট্রেন।
পিনাকি হঠাৎ অনিমাকে বলল, চলো হাওড়া ব্রীজে যাবে? পুরী যাওয়ার সময়, রাতে ট্রেন ধরার জন্য যতবার ব্রীজটার উপর দিয়ে যাই মনে হয় যদি এখন এখানে দাঁড়াই…..যদি কেউ তাড়া না দেয়…..
অনিমা হেসে বলল, পুলিশে লকাপে ভরে দেবে….
দেবে না, চলো….যাবে?
এত ভিড়। এত হইহট্টগোল। এত চিৎকার-চেঁচামেচি। এত স্বার্থপর মানুষের আর্ত চীৎকারের মধ্যে দাঁড়িয়ে অনিমার মনে হল, গেলেই বা কী হয়?
========
পিনাকির ভীষণ কান্না পেল কিছুক্ষণ। অনিমা ফোনে ব্যস্ত। কাল যাবে না কাজে, এটাই বোঝাচ্ছে। পিনাকি নিজেকে সামলে নিয়ে বলল, কী বলল?
অনিমা বলল, ওই এক….সেকেণ্ড হাফে জয়েন করো……একটা মানুষের শরীর তো বল….জানোয়ার এগুলো…..
পিনাকি বলল, জানোয়ার না, পাথর….একবার গড়ালে কখন থামতে হবে জানে না….সব পিষে গেলেও গড়াতেই থাকে…..
অনিমা হাসল, বলল চাট্টি কথা জানিস…..কিন্তু এবার কী করব? সমকামী সন্তানের যন্ত্রণা সহ্য করতে না পেরে মা ও ছেলে গঙ্গায় ঝাঁপ দিয়ে আত্মঘাতী…. এমন একটা হেডলাইন তৈরি করার কথা ভাবছি না নিশ্চয়ই আমরা….নাকি ভাবছি…..
পিনাকি ঠাট্টাটার মধ্যে আঁশের মত উড়ে যাওয়া সত্যিটাকে ধরতে পারল। উড়িয়ে দিল না। সযত্নে বুকে আটকে রাখল। তাদের হাঁটার রাস্তাটা সত্যিই কতটা সরু। একদিকে খাদ, আরেকদিকে চড়াই পাহাড়। প্রতিদিন পরীক্ষা দিয়ে নিজের যোগ্যতা প্রমাণ করে বাঁচার ছাড়পত্র পাওয়া।
পিনাকি হাসল, বলল, না না, সার্থকদা গাড়িটা নিয়ে আসছে….ওই আমাকে ট্রেনের গোলমালটার কথা আগেই বলেছিল….এখানে দাঁড়ানোর প্ল্যানটাও ওর….আমার এখানে দাঁড়াতে ইচ্ছা করে জানে তো…..
বেয়াড়াভাবে গলাটা ধরে এলো। পিনাকি সামলে বলল, অসুবিধা নেই তো?
অনিমা বলল, তবে শিয়ালদায় নিয়ে গিয়েছিলি কেন মরতে?
পিনাকি প্রশ্নটার জন্য প্রস্তুত ছিল যেন, অনেকবার মনে আওড়ানো আত্মবিশ্বাসী উত্তরের মত বলল, যদি বিশ্বাস না করতে।
অনিমা বলল, সেই। আর প্রশ্ন করা যায় না। বিশ্বাসের প্রশ্নটা বড় নরম মনে জন্মায়। শক্ত মনের উপেক্ষা করার ক্ষমতায় যে দম্ভ….নরম মনের সে দম্ভ তো নেই….তার প্রাণের বিশ্বাস আছে শুধু…
খানিকক্ষণ দুজনে কোনো কথা বলল না। একটু পর অনিমা বলল, তবে তুই সার্থকদাটা বলিস না…দা'টা বড্ড কানে লাগে…..কনফিউজিং…. ও কলকাতাতেই জিম শেখাতে আসে না?...নিজের গাড়ি নিয়েই?....
প্রশ্নগুলো অবান্তর। কিন্তু বিষয়টা না। পিনাকি গঙ্গার দিকে তাকিয়ে। এদিকের আকাশ ভীষণ ঝাপসা!
অনিমা পিঠে হাত রেখে জিজ্ঞাসা করল, তুই ওর সঙ্গে ভালো থাকিস... না রে?
পিনাকির মনে হল একটা অপূর্ব ঘুঘুপাখি তার বাড়ির ছাদে এসে বসেছে। কিন্তু ছাদে ওঠার সিঁড়ি তো নেই। মই আছে। মইকে কি সিঁড়ির মত ভরসা করে মানুষ?