ঘনশ্যাম আর সুনয়না ঘরের মধ্যে ঢুকলেন। ঘুটঘুটে অন্ধকার চারদিক। আজ ভূতচতুর্দশী। কেউ চোদ্দ প্রদীপ জ্বালার নেই। সবাই বেড়াতে গেছে। ঘনশ্যাম খাটে বসলেন। সুনয়না নিজেদের ছবিটা খুঁজলেন এ দেওয়াল, সে দেওয়াল। নেই। অবশেষে বাথরুমের পাশের জুতোর র্যাকের নীচ থেকে ভাঙা ছবিটা বার করলেন। কত পুরোনো ছবি।
ঘনশ্যাম খাটে শুয়ে আছেন। পা দুটো নীচের দিকে অন্ধকারে মিশে। সুনয়না ঘরে এলেন। পা ছড়িয়ে খাটে বসলেন। জানলা খুলে দিল কে এসে হঠাৎ। ভুতো। তাদের বিশ্বস্ত কাজের লোক। তাদের পরলোকগমনের দু বছর আগে সে পরলোকগত হয়।
"আমি প্রদীপগুলো জ্বালাচ্ছি মা। আপনারা বসেন", বলে ভুতো বেরিয়ে গেলো।
সুনয়না নিধুবাবুর টপ্পা গাইলেন, "ভালোবাসিবে বলে ভালোবাসিনে"। রামপ্রসাদী গাইলেন, "মন কেন মায়ের চরণ ছাড়া"। অতুলপ্রসাদ গাইলেন, "একা মোর গানের তরী"। রজনীকান্ত গাইলেন, "কেন বঞ্চিত হব চরণে"। দ্বিজেন্দ্রগীতি গাইলেন, "আমি চেয়ে থাকি দূর সন্ধ্যাগগনে"। শেষে দুজনেই রবীন্দ্রনাথের গান গাইলেন একসাথে, " এ পথে আমি যে গেছি বারবার"।
ভুতো প্রদীপ জ্বেলে পায়ের কাছে বসল। চোখ মুছল। গান শুনল। ফের চোখ মুছল।
বাড়ির লোক ফিরল চারদিন পর। একি! পোড়া প্রদীপ পড়ে এখানে সেখানে! আলমারি? না, সব যেমন ছিল তেমন। সায়কের মাথা ভোঁ ভোঁ করছে। তার স্ত্রী পাড়াপড়শির বাড়ি দৌড়ালো খোঁজ খবর আনতে। আট বছরের তিন্নী শুধু কাউকে কিছু না বলে ছাদে উঠল। একটা পোড়া প্রদীপ হাতে নিল। গান গাইল, "মোরা এমনি এসে ভেসে যাই"। পুরোনো গান। তার বন্ধুরা জানে না। তার ঠাম্মির গলা ক্যাসেট করা ছিল। তাই থেকে শিখেছে।
আচমকা তার হাতের প্রদীপ জ্বলে উঠল এমনি এমনি। সে অবাক হল না। খুশী হল। ছাদের কোণে প্রদীপটা রেখে সে একটার পর একটা গান গাইতে লাগল। ক্যাসেট থেকে শুনে শেখা ঠাম্মুর গলায়।
তিন্নী মনে মনে দেখল, সব পোড়া প্রদীপগুলো জ্বলছে। ঠাম্মু দাঁড়িয়ে যেন ঠাকুর ঘরের সামনে। লালপেড়ে শাড়ি, বড় সিঁদুরটিপ কপালে। ঠাম্মু হাসছে। ছবির মত। কিন্তু তবু ছবি নয়।