বাড়িতে সেদিন অনেকেই এসেছেন। জন্মদিনের নেমন্তন্ন। সন্ধ্যেবেলা বসার ঘরে হইচই, গান, আলোচনা ইত্যাদি ইত্যাদি হচ্ছে।
যিনি বাসন মাজেন, তিনিও এলেন। সঙ্গে এলো একটা বাচ্চা মেয়ে। যিনি বাসন মাজেন ওঁর দিদির মেয়ে। গ্রাম থেকে এসেছে। মাসি নেমন্তন্ন খেতে যাচ্ছে শুনে সেও এসেছে।
মা তাদের দুজনকে বসতে বললেন। তারা ছাদে ওঠার সিঁড়ির প্রথম ধাপের উপর বসল দুজন। মেয়েটা ক্লাস থ্রিতে পড়ে। সে মাসির সঙ্গে সিঁটিয়ে বসে। মাটির দিকে তাকিয়ে। কারুর দিকে তাকাচ্ছে না।
মা একটা প্লেটে দুটো কেকের টুকরো সাজিয়ে দিদির হাতে দিলেন। বাচ্চা মেয়েটা নিজের থেকেই কেকের টুকরোটা হাতে তুলে নিল।
হঠাৎ খোলা জানলা দিয়ে একটা চামচিকে ঢুকে পড়ল। ঢুকেই সারাটা ঘর গোল গোল ঘুরতে শুরু করে দিল। ঘরের মধ্যে হইহই পড়ে গেল। যে যেদিকে পারল দৌড়ালো। কেউ কেউ টয়লেটে গিয়ে দরজা দিল। কেউ শোয়ার ঘরের দিকে। কেউ নীচে নামতে শুরু করল। কেউ চলন্ত পাখা দুটোর সুইচ খোঁজার চেষ্টা করল। বন্ধ করতে হবে।
বাচ্চা মেয়েটা একটা কোণে দাঁড়িয়ে সমস্ত মনটা দিয়ে কেকটা যত ধীরে খাওয়া যায়, সবার ধাক্কাধাক্কি বাঁচিয়ে, সেই ভাবে খেয়ে যাচ্ছে। যত দৌড়াদৌড়ি বাড়ছে সে তত কোণায় নিজেকে নিয়ে যাচ্ছে। সুরক্ষিত করতে।
চামচিকেটা বেরিয়ে গেল। দেখতে দেখতে আবার সব ঘরে এসে বসল। চামচিকে নিয়ে নানারকম আলোচনা শুরু হল। প্রাণীবিজ্ঞান থেকে রাজনীতি সব বিষয় চামচিকেময় হয়ে উঠল।
মেয়েটা তখনও কোণে দাঁড়িয়ে। অবশিষ্ট কেকের টুকরোটার দিকে তাকিয়ে। ওটা শেষ হলে হয় তো ওর মনেও থাকবে না ঘরে কখন চামচিকে এসেছিল। কখন গেল। কত হইহট্টগোল হল। কত আলোচনা, কত শলাপরামর্শ হল। আবার ঘটনাত্তোর কত বিশ্লেষণ হল।
ঘটনাটা অনেকদিনের। আজও খবরের কাগজ খুলে যখন নানা ঘটনা, আলোচনা ইত্যাদি পড়ি, আমার ওই কেক হাতে মেয়েটার কথা মনে পড়ে। ওর হাতের কেকটাকে সুরক্ষিত না করলে, আদৌ কি অবশেষে কোনো কিছুর কোনো মানে হবে? নিজেকেই প্রশ্ন করি। উত্তরটা বড্ড দরকারি। কিন্তু তার চাইতেও অন্য কিছু যেন বেশি দরকারি এমন সাজানো সব।
যা স্পষ্ট তা-ই কি সত্য? অনেক সময় ছায়া ভীষণ স্পষ্ট হয়, আলোকে আড়াল করে। তাই বলে সেই ছায়াময় অন্ধকারই সত্য? তা তো নয়।